দিশারী ডেস্ক। ০৮ আগস্ট, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ।
সন্তানের বয়স দুই বছর হতে চলল কিন্তু তার কথা বলার কোনো লক্ষণ নেই। এমনকি অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলতে গেলেও ছেলে প্রায়ই আলাদা থাকে। কারো সঙ্গে মিশতে চায় না। চাকরিজীবী বাবা-মার ধারণা ছিল, হয়তো বাড়িতে একা থেকেই সে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। সমাধান আসবে ভেবে অন্যদের সঙ্গে বাড়ানো শুরু করলেন শিশুর মেলামেশা। তাতেও খুব একটা উন্নতি দেখা দিল না। এবার বাবা-মা পড়লেন দ্বন্দ্বে। অগ্রগতি কেন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সন্তানের ? অবশেষে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর বোঝা গেল যে শিশুটি অটিজমে আক্রান্ত। এবার শুরু হলো বাবা-মায়ের নতুন লড়াই। সন্তানকে স্বাভাবিক করার লড়াই, আবার সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই।
অটিজম কী :
সিডিসির মতে, শিশুর সামাজিক দক্ষতার অভাব থাকলে, পুনরাবৃত্তির অভ্যাস থাকলে এবং বাচনিক ও অমৌখিক দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে শিশু সমস্যার মুখে পড়লে বলা যায় শিশুটি অটিজমে আক্রান্ত।
এখন প্রায়ই শোনা যায় অটিজম শব্দটি। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) তথ্যমতে, আট বছর বয়সী প্রতি ৬৮ জন শিশুর মধ্যে একজন অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৩৬টি শিশুর একজন অটিজমে আক্রান্ত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, বিশ্বে প্রতি ১০০ শিশুর মধ্যে একজন অটিজমে আক্রান্ত। অটিজম একটি মাত্র রোগ নয়। এর কতগুলো ধরন রয়েছে। তার বেশির ভাগই জেনেটিক ও পরিবেশগত বিষয়াদি দ্বারা প্রভাবিত। অটিজমের কিছু কিছু লক্ষণ ছোটবেলাতেই টের পাওয়া যায়। কিন্তু সেসব চিহ্নিত করতে অনেক বয়স পর্যন্ত সময় লেগে যায়। অটিস্টিক প্রতিটি ব্যক্তির সক্ষমতা ও চ্যালেঞ্জ গ্রহণের ক্ষেত্রে আলাদা মনোভাব রয়েছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, অটিজম হচ্ছে পারভেসিভ ডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডার। ছোটবেলায় শিশুর যেমন মস্তিষ্কের বিকাশ হয়, শরীরের বিকাশ হয়, সামাজিক বিকাশ হয়, যৌন বিকাশ হয়, তেমন মানসিক বিকাশও হয়। কিন্তু এ সমস্যায় আক্রান্ত হলে বিকাশ অনেক বেশি বাধাগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়।
শিশুর বিকাশ প্রক্রিয়ায় তিনটি জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ বলেই উল্লেখ করেন এ বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, এ তিনটির একটি সামাজিক বিকাশ। ছোট থেকেই শিশুরা সামাজিক মিথস্ক্রিয়া করে, তারা অনেকের সঙ্গে মেশে। ভাব বিনিময় করতে হলে কারো চোখের দিকে তাকাতে হয়। কিন্তু অনেক শিশুর আই-টু-আই কনট্যাক্ট থাকে না। তারা বন্ধুবান্ধব বা অন্যদের সঙ্গে সেভাবে মিশতে পারে না। এজন্য তাদের মস্তিস্কের একটি অংশ দায়ী, যেটাকে আমরা বলি সোশ্যাল পার্ট অব দ্য ব্রেইন। মস্তিষ্কের যে অংশ সোশ্যাল মিথস্ক্রিয়া বা সামাজিক কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে, এসব শিশু বা ব্যক্তির সেখানে কিছু ত্রুটি থাকে।
এর পাশাপাশি আরো দুটি বিষয় নিয়ে কথা বলেন তাজুল ইসলাম। তার মতে, অটিস্টিক শিশুদের ভাষাগত দক্ষতা অর্জনেও দেরি হয়। সাধারণত যে বয়সে শিশুরা কথা বলা শুরু করে বা হাঁটা শুরু করে তাদের তা হয় না। কারো কারো এমন হয় যে অনেক বছর পরেও পরিপূর্ণ ভাষাগত দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। আর একটি বিষয় হচ্ছে এসব শিশু কিছু রুটিন বাধা কাজ করে। সেখানে তারা অনেক পুনরাবৃত্তিও করে। এতে অভিভাবকরা অনেক বেশি চিন্তায় পড়ে যান। তারা ভাবেন, কেন সন্তান এমন উদ্ভট কাজ-কারবার করছে। যেটা প্রয়োজনীয় না আবার ক্ষতিকর, এমনকি অনেক সময় বিপজ্জনকও সেটাই বারবার করে যাচ্ছে।
অটিজমের লক্ষণ :
অটিজমের বেশকিছু লক্ষণও রয়েছে। এর মধ্যে একটি উপধরন জিনগত ও পরিবেশগত বিষয়াদি দ্বারা অনেক বেশি প্রভাবিত। অটিজম মূলত একটি স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার। অটিজমে আক্রান্ত সবার বিশেষ কিছু ক্ষমতা থাকে। অটিস্টিক ব্যক্তিরা যেভাবে কোনো কিছু শেখে, চিন্তা করে বা সমস্যা সমাধান করে সেখানে তাদের সর্বোচ্চ দক্ষতাও কিছুটা সমস্যার মুখে পড়তে পারে। এক্ষেত্রে সাধারণ শিশুদের কিছুটা কম প্রচেষ্টা চালাতে হয়।
তাজুল ইসলামের মতে, যে রোগ যত শৈশব থেকে শুরু হয় সেখানে বুঝতে হবে তত বংশধারার প্রভাব আছে। সেটাকে আমরা জেনেটিক প্রভাব বা বংশধারার প্রভাব বলতে পারি। এছাড়া অনেক সময় বলা হয়, শিশুর সামাজিকীকরণ হয়তো ভালো হয় না। সেজন্য মা-বাবার ওপর দোষও দেয়া হয়, তবে তাদের যে খুব দোষ আছে তা নয়। এছাড়া কিছু মিনারেলস ভিটামিনের অভাবেও এমন হতে পারে।
প্রতিকার :
প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের অটিজমকে আলাদাভাবে বিবেচনা করা হয়। তাছাড়া এ রোগে আক্রান্ত প্রত্যেকেই আলাদা। তাই সবার চাহিদাও ভিন্ন ভিন্ন। সুতরাং একজনের জন্য যে চিকিৎসা খুব ভালোভাবে কাজ করে, অন্যের জন্য তা কাজ নাও করতে পারে।
অটিস্টিক শিশুদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রধানত দুটি থেরাপি ব্যবহার করা যেতে পারে। একটি হলো আচরণ এবং যোগাযোগ থেরাপি। এ থেরাপিতে শিশুকে শেখানো হয় কীভাবে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়, কীভাবে নিজেকে সামাজিক পরিবেশে খাপ খাওয়াতে হয়, কীভাবে অন্যদের সঙ্গে আচরণ করতে হয়। এটি প্রধানত ভাষা এবং যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেয়। এ থেরাপি সামাজিক দক্ষতা, ফোকাস, স্মৃতিশক্তি, মনোযোগের ক্ষেত্রে উন্নতি করে। অন্যটি হলো শিক্ষামূলক থেরাপি। অটিজমের শিকার শিশুদের বিশেষ শিক্ষা প্রদান করা হয়। এ থেরাপিতে বিশেষজ্ঞদের একটি দল শিশুদের প্রয়োজন অনুযায়ী পাঠ্যক্রমে তাদের পড়াশোনা করায়।
তাজুল ইসলাম বলেন, জেনেটিক কাউন্সেলিংও এখানে কাজে আসতে পারে। যাদের একটি সন্তান অটিজমে আক্রান্ত, তাদের অন্য সন্তান যেন আক্রান্ত না হয় সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। সেজন্য আমরা বাবা-মাকে জেনেটিক কাউন্সেলিংয়ের কথা বলি। এ কাউন্সেলিংয়ে কীভাবে এ ধরনের সন্তান নিয়ে তারা জীবন যাপন করবে বা সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করবে সে বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হয়। এ বিষয়ক অনেক গবেষণা আছে এবং অনেক রকম চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে।
তিনি যোগ করেন, একবার অটিজম হয়ে গেলে, সেটার চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে পরিবারের বা সমাজের যেমন দৃষ্টিভঙ্গি রাখা দরকার, এসব শিশুর যেমন যত্ন দরকার, পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে যে ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি দরকার তা না হলে শিশুর ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে।
আগে সারা বিশ্বে অটিজমের সংখ্যা অনেক কম ছিল, বর্তমানে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। আবার মানসিক প্রতিবন্ধী বলেও একটা রোগ আছে। মানসিক প্রতিবন্ধিতায়ও মস্তিষ্কের অনেক অংশ কাজ করে না। এদের মধ্যে পার্থক্য খুব কঠিন হওয়ায় আগে দুটিকে মিলিয়ে দেয়া হতো। এখন বিজ্ঞান অনেক এগিয়েছে, মানুষও অনেক সচেতন হয়েছে। ফলে এখন মানসিক প্রতিবন্ধিতা থেকে আলাদা করা হচ্ছে অটিজমকে। সব মিলিয়ে এর প্রকোপ যেমন বাড়ছে, সচেতনতাও বাড়ছে।
Leave a Reply