গণতন্ত্রই মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি ও মৌলিক কাঠামো

  • আপডেট সময় সোমবার, ডিসেম্বর ৪, ২০২৩
  • 123 পাঠক

ব্যারিস্টার নাজির আহমদ। ৪ ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে যে যেভাবে পারে সেভাবে বলার বা ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে তার নিজস্ব বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি ও মতাদর্শ অনুসারে। কিন্তু আসলে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা কি? যে যাই বলুক, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান ও মূল চেতনা হলো গণতন্ত্র ও বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক মুক্তি।

দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৭০ সালে টান টান উত্তেজনার মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। নির্বাচনে নিরঙ্কুশভাবে আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়ার পর মেজোরিটি পার্টির নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে ভুট্টোর যোগসাজশে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গড়িমসি করে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ ঢাকায় চালানো হয় ইতিহাসের নির্মম গণহত্যা। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ, রূপ নেয় তা জনযুদ্ধে। নির্বাচন ও গণতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যদি মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতো তাহলে ইতিহাস ভিন্ন হতো। সুতরাং গণতন্ত্র যে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান ও মূল চেতনা এটা ঐতিহাসিকভাবে প্রমানিত।

অপরদিকে পূর্ব পাকিস্তান ছিল স্রষ্টা প্রদত্ত (God gifted) অপার সম্ভাবনাময় এক ভূখণ্ড। ভৌগোলিকভাবে নীচু ও পলিমাটিতে অবস্থানের কারণে ভূমি ছিল খুবই উর্বর – যা ফলানো হতো তাই ফলতো প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। কিন্তু পাকিস্তান স্বাধীন হবার দেখা গেল পূর্ব পাকিস্তানে পাটসহ সব অর্থকরী ফসল ফলে কিন্তু তা নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। এমনকি এগুলো রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করা হয়।

কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান তার ন্যায্য হিস্যা পায় না। দশকের পর দশক এই শোষণের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ফুঁসে উঠে যার পরিসমাপ্তি ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাধ্যমে। সুতরাং গণতন্ত্রের পাশাপাশি বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক মুক্তি যে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান ও মূল চেতনা ছিল এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও আমাদের এই ভূখণ্ডের গত ৭৫ বছরের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনসমূহ ও ঐতিহাসিক দলীলগুলো ঘাটলে দেখা যাবে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার ছিল প্রধান ও মূখ্য বিষয়। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করতে অস্বীকার করাতেই শুরু হলো ভাষা আন্দোলন, জীবন দিলেন বাংলার দামাল ছেলেরা। উনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান সেখানেও মেইন স্পিরিট ছিল গণতন্ত্র। অপরদিকে ছয় দফা, ১১ দফা, স্বাধীনতার ইশতেহার ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (Proclamation of Independence) – এ সব ঐতিহাসিক দলীলগুলোতে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার ছিল প্রধান ও মূখ্য বিষয়।

মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে যে সংবিধান রচিত তার প্রস্তাবনায়ও গণতন্ত্রকে অন্যতম প্রধান মূলনীতি হিসেবে সন্নিবেশ করা হয়েছে। এরপর সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ৮ অনুচ্ছেদে গণতন্ত্রকে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ধরণ সম্পর্কে সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “The Republic shall be a democracy……” (অর্থাৎ “প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র”)।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবিধানে কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে যা কোনোভাবেই পরিবর্তনযোগ্য নয়। যেমন ফ্রান্সের সংবিধানের ৮৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “The republican form of government shall not be the object of any amendment (অর্থাৎ “সরকারের প্রজাতন্ত্রী রূপ কোনো সংশোধনীর উদ্দেশ্য হইবে না”)। ঠিক অনুরূপভাবে আমাদের সংবিধানের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যাদেরকে বলা হয় basic structure (মৌলিক কাঠামো)। এই মৌলিক কাঠামোগুলো পরিবর্তন করা যাবে না।

Anwar Hossain V Bangladesh (1989) BLD (Apl) 1 মামলায় (এটি অষ্টম সংশোধনী মামলা বলে বহুল পরিচিত) বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত গণতন্ত্রকে সংবিধানের অন্যতম basic structure (মৌলিক কাঠামো) হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং বলেছে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোগুলো অপরিবর্তনীয়।

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রাণ। আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে “Government of the people, by the people, for the people” (অর্থাৎ “জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য”)। জনগণ যদি অবাধে ভোট দিয়ে তাদের পছন্দমত প্রার্থীকে নির্বাচিত করার মাধ্যমে সরকার গঠন করাতে না পারে তাহলে সেই সরকারকে তারা কিভাবে বলবে তাদের, তাদের দ্বারা ও তাদের জন্য!

গণতন্ত্র এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্যে সম্পর্ককে ভারতীয় এক মামলায় [(2002) 8 SCC 237] ভারতের উচ্চ আদালত অত্যন্ত চমৎকার করে তুলে ধরেছেন। আদালত বলেন: ” Free, fair … elections are part of the basic structure of the Constitution .…… Democracy and free and fair elections are inseparable twins. There is almost an inseverable umbilical cord joining them. The little man’s ballot and not the bullet is the heart beat of democracy” ( অর্থাৎ “অবাধ, সুষ্ঠু… নির্বাচন সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ… গণতন্ত্র এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অবিচ্ছেদ্য যমজ। তাদের সাথে প্রায় অবিচ্ছেদ্য নাভির সংযোগ রয়েছে। ছোট মানুষের বুলেট নয় ব্যালট গণতন্ত্রের হৃদস্পন্দন“ )।

নির্বাচন কেমন হওয়া উচিৎ তা বাংলাদেশের সংবিধানেও সুন্দর করে বলা আছে। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ স্পষ্ট করে বলেছে “প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে ”। অপরদিকে সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদ স্পষ্ট করে বলেছে “ একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিন শত সদস্য লইয়া……সংসদ গঠিত হইবে…..”।

নির্বাচনের ব্যাপারে সাংবিধানিক বিধানগুলো আর বর্তমান বাস্তবতা দেখুন। এবার সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ ও ৬৫(২) অনুচ্ছেদে বর্ণিত যথাক্রমে “জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ” এবং “প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে” শব্দগুলো বা টার্মগুলোর সাথে হাল আমলের নির্বাচনগুলো ও আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের সাথে তুলনা করুন আর মনকে প্রশ্ন করুন কোথায় সংবিধান ও সংবিধানের বাধ্যবাধকতা আর কোথায় বাস্তবতা!

সংবিধান ও উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী গণতন্ত্র হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ও মৌলিক কাঠামো। অপরদিকে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের মালিক হচ্ছে জনগণ (অনুচ্ছেদ ৭)। গণতন্ত্রের প্রাণ ও অবিচ্ছেদ্য যমজ হচ্ছে নির্বাচন। সেই নির্বাচন হতে হবে প্রত্যক্ষ নির্বাচন [অনুচ্ছেদ ৬৫(২)] এবং তাতে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ থাকতে হবে (অনুচ্ছেদ ১১)।

প্রত্যক্ষ ও জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করার পরিবর্তে যদি নির্বাচনের আগেই আসন বন্টন ও ভাগাভাগি করা হয় তাহলে সেটাকে আর যাই বলুন নির্বাচন বলা যায় না। আর এমনটি হবে গণতন্ত্র ও নির্বাচনের প্রতি তামাশার শামিল। এতে রাষ্ট্রের মালিক জনগণকে বঞ্চিত করা হবে তাদের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার থেকে।

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মূল চেতনা ও সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক ঘোষিত Basic structure (মৌলিক কাঠামো) গণতন্ত্র এবং এই গণতন্ত্রের Inseparable twin (অবিচ্ছেদ্য যমজ) সুষ্ঠু নির্বাচনকে স্বাধীনতার ৫২ বছর পর আপনারা অবহেলা ও হাসির বস্তুতে পরিণত করবেন! নৈতিকতা, বিবেক ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সংশ্লিষ্টরা কি জবাব দিবেন? ইতিহাস সংশ্লিষ্টদের ক্ষমা করবে না।

গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশে জনগণ অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। প্রায় পুরো আশির দশক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে এবং নব্বই দশকে প্রায় অর্ধ সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে অনেক জীবন দিতে হয়েছে, দিতে হয়েছে অনেক রক্ত। দুটি আন্দোলেনর পর সমাধান আসলেও তা লাগসই (sustainable) হয়ে উঠেনি। স্বাধীন দেশে জনগণকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে আর কতো ত্যাগ স্বীকার করতে হবে?

নাজির আহমদ : বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।

Email: ahmedlaw2002@yahoo.co.uk

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!