তরুণরাই মাদকাসক্ততার শীর্ষে

  • আপডেট সময় রবিবার, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৪
  • 125 পাঠক

দিশারী ডেস্ক : মাদকাসক্তদের শীর্ষে দেশের তরুণ সমাজ। সর্বনাশা মাদকের মরণ ছোবলে আক্রান্ত তরুণ ও যুবসমাজ আজ ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে। দেশে মাদকের বিস্তৃৃতি আজ ভয়াবহ রূপ লাভ করেছে।

দেশের বর্তমান আর ভবিষ্যতের সব সম্ভাবনা ধ্বংসের মূলেই মাদক। বর্তমান সমাজে মাদক জন্ম দিচ্ছে একের পর এক অপরাধ। এছাড়া মাদক সেবনে কিডনি, স্নায়ুুর জটিলতাসহ শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতি হয়।

পাশাপাশি বদমেজাজ, চরম অবসাদ, আত্মহত্যার প্রবণতা, অসংলগ্ন ব্যবহার, হ্যালুসিনেশন, ভুলে যাওয়া, দুর্বলচিত্ততা, হতাশা ইত্যাদি মানসিক বিকারের শিকার হয় মাদকাসক্ত ব্যক্তি। স্ট্রোকে মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে মাদকাসক্তের সংখ্যা সর্বাধিক। বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা বেশি মাদকাসক্ত।

———————————————————————————————————
সামাজিক আন্দোলন লাগবে : বিশেষজ্ঞ। জিরো টলারেন্স নীতিতে পুলিশ : আইজিপি।

অলআউট খেলতে হবে : র‌্যাব ডিজি

—————————————————————————————————–

এছাড়া বাংলাদেশে এমন কোনো পেশা নেই, যে পেশায় মাদকসক্ত ব্যক্তি নেই। কিডনি ও স্নায়ুুর বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে যখন রোগীরা ডাক্তার কিংবা মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে যান, তখন রোগীদের অতীত ইতিহাস জানতে পেরে তারা বুঝতে পারেন যে, ওসব রোগী মাদকাসক্ত ছিলেন। মাদকাসক্ত বেশির ভাগ রোগী মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে যান।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপক হারে মাদক ঢুকছে। মাদকাসক্ত তরুণদের মধ্যে শিক্ষিতের হারই বেশি। অল্প বয়সে তারা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, অনেকে শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে যাচ্ছে। অনেক অভিভাবক এসে কান্নাকাটি করেন। তাদের করুণ কাহিনী শুনে হতবাক হয়ে যান বিশেষজ্ঞরা।

দেশের সর্বত্র মাদক এখন সহজলভ্য। শহর-নগর, গ্রামসহ মফস্বল এলাকায়ও হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজা, আফিম, চরশ, বাংলা মদ, গুল, মরফিন, কোকেন, হেরোইন, প্যাথেলিন, মারিজুয়ানা, ডেক্রপরটেন, প্যাথেড্রিন, কোকেন, ইকসটামি, এলএসডি, ইলিকসার, চোলাইমদসহ রকমারি মাদকের সঙ্গে তরুণদের সংশ্লিষ্টতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

একজন মাদকাসক্ত সন্তানের কারণে একটি পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সেই সন্তানকে নিয়ে পরিবারগুলো দিশেহারা হয়ে পড়ছে।
অভিভাবকরা বলেন, মাদকসক্ত সন্তানের কারণে সর্বস্বান্ত হয়েছেন তারা। এসব অভিভাবকের কারো সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে, মেডিক্যাল কলেজে পড়ালেখা করে, আবার কারো সন্তান স্কুল-কলেজ পড়ুয়া। ভয়ংকর পরিস্থিতির শিকার তারা। মাদকাসক্ত সন্তানরা প্রায়ই মা-বাবার সঙ্গে খারাপ আচরণ করে, এমনকি চাহিদা অনুযায়ী অর্থ না দিলে মারধরও করে। খুনখারাবির মতো জঘন্য অপরাধের মূলেও মাদক।

মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা, জরিমানা, গ্রেফতার ও শাস্তি প্রদান করেও কোনো কাজ হচ্ছে না। দিনদিন মাদকের চাহিদা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের সমন্বয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাজনীতি নিয়ে দলগত বিরোধ থাকলেও মাদক ব্যবসায় জড়িত রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা তাদের এই অবৈধ ব্যবসার ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ। বর্তমানে ক্ষমতাসীনদের একশ্রেণির নেতাকর্মীর পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীরা। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইচ্ছা করলেও মাদকের প্রসার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। ধর্মীয় সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, সব জনপ্রতিনিধি, সব দলের রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ সব পেশার মানুষ মাদক নির্মূলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে না ও না তুললে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে। প্রতি মাসে মাদকসংক্রান্ত অপরাধে গ্রেফতারকৃতদের সংখ্যাই সর্বাধিক, উদ্ধারও হচ্ছে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য। তার পরও মাদক ব্যবসা বন্ধ হচ্ছে না। পুলিশের একার পক্ষে মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। মাদক নির্মূল করতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।

র‌্যাবের মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেন বলেন, মাদক আমাদের জন্য হুমকি। এটা কারো একার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। সবাই মিলে অলআউট খেলতে হবে, সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে। মাদক সেবন ও বিক্রি যারা করবে, তাদের ধরিয়ে দিতে সর্বস্তরের মানুষের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। তরুণ সমাজ, দেশকে রক্ষা করতে হলে মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

বিশিষ্ট মনোরোগ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মোহিত কামাল বলেন, মাদকে আসক্ত করতে তরুণদের টার্গেট করা হয়। প্রথমে ছলেবলে, আলাপের ছলে বিনামূল্যে মাদক দেয়া হয়। পরে তারা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে। বিভিন্ন মার্কেটের ব্যবসায়ীদেরও একইভাবে টার্গেট করা হচ্ছে। এই কায়দায় মাদক বিক্রির জন্য আসক্তের সংখ্যা বাড়ানো হয়। এই ধরনের অনেক রোগী তার কাছে চিকিৎসার জন্য এসে আসক্ত হওয়ার তথ্য এই চিকিৎসককে জানান।

মাদকাসক্তদের মধ্যে সব পেশার মানুষই রয়েছে। তবে বেশি আসক্ত তরুণরা। তাদের মেজাজ খিটখিটে থাকে, ঘুম হয় না। সব ধরনের রোগে তারা আক্রান্ত হয়। স্থায়ীভাবে যৌন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তিনি বলেন, মাদকের কারণে মানবিক বিপর্যয় ঘটছে। দেশের তরুণ সমাজকে রক্ষা করতে হলে মাদকের বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের যুগ্ম-পরিচালক অধ্যাপক ডা. বদরুল আলম বলেন, স্কুল-কলেজ পড়–য়া অনেক রোগী নিউরো জটিলতা নিয়ে আসছে। তারা মূলত মাদকাসক্ত। বিভিন্ন মানসিক জটিলতা নিয়েও শিক্ষার্থীরা আসেন। অনেকে অল্প বয়সে স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন। কৌকেন, ইয়াবা, ফেনসিডিল সেবন করলে দ্রæত স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মাদকের কারণে রোগী যেমন বাড়ছে, তেমনি অপরাধও বাড়ছে।

তিনি বলেন, সর্বগ্রাসী মাদক কারো একার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। নইলে দেশ পরিচালনায় মেধাবীদের মারাত্মক সংকট দেখা দেবে। তরুণ সমাজকে রক্ষা করতে না পারলে দেশ রক্ষা হবে না।

অধ্যাপক ডা. বদরুল আলম একটি উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশে বংশোদ্ভূত এক জন আমেরিকান নাগরিক স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে তিন দফা তার কাছে চিকিৎসা নেন। ওষুধে তিনি সুস্থ হন না। তাকে পূর্বের ইতিহাস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে রোগী জানান, তিনি মাদক সেবন করতেন। এটা মাদকেরই কুফল। তার পরিবারের মতো অনেক পরিবার মাদকাসক্তদের চিকিৎসা করাতে গিয়ে আজ সর্বশ্বান্ত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ মাদকাসক্ত হয়েপড়ছে। তরুণদের মাদকাসক্ত হওয়ার পেছনে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যত কারণ থাকুক না কেন মাদকের সহজলভ্যতা এর প্রধান কারণ।

পাঠ্যক্রমের মধ্য দিয়ে সঠিকভাবে জীবন পরিচালিত করার উপযুক্ত বিষয়বস্তু শিক্ষার্থীদেরকে জানানো, সচেতন করা, ভূমিকা পালনের ধরন নির্ধারণে উপযুক্ত শিক্ষা পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে এই প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণের ঘাটতি আছে বলেই কেউ হতাশ হয়ে পড়লে, একাকীত্ব সৃষ্টি হলে, সম্পর্ক ভেঙে গেলে কিংবা বন্ধু বা সঙ্গীর অনুরোধে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। পরিবার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, জনপ্রতিনিধি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের মাদক প্রতিরোধে প্রচলিত কার্যক্রম সফলতার কোনো স্বাক্ষর সৃষ্টি করতে পারছে না। যতক্ষণ পর্যন্ত দেশে মাদক প্রবেশ ও অভ্যন্তরীণ মাদক উৎপাদন বন্ধ করা না ততক্ষণ পর্যন্ত মাদকের ভয়াবহতা বন্ধ হবে না।

যে বা যারা মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করবেন, মাদক প্রবেশে বাধা দিবেন এবং মাদক বাণিজ্যের সাথে জড়িতদের আইনের মুখোমুখি করবেন তাদের একটি অংশ মাদক বাণিজ্যের সাথে জড়িত। এখান থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে থাকেন। তাই যারা প্রতিরোধ করবেন তারাই সমস্যার অংশ হলে সেই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়।

সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বললেও বাস্তবিক অর্থে এর উপস্থিতি ও প্রয়োগের জায়গাটি দৃশ্যমান নয়। মাঝেমধ্যে অভিযান, মাদকের বাহক ও মাদকাসক্তকে গ্রেপ্তার করে মাদক সমস্যার সমাধান করা যাবে না।

মাদকাসক্ত তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে আগামীতে বাংলাদেশ ভয়াবহ ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। কারণ মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা একটা সময় গিয়ে নিজে অন্যের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, কর্মক্ষমতা কমে যায়, কর্ম ইচ্ছা হারিয়ে ফেলে এবং সমাজ ও পারিবারিক পর্যায়ে সম্পর্ক বিনষ্টে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে।জিরো টলারেন্স ঘোষণার চেয়ে কর্ম প্রমাণ বেশি প্রয়োজন যা বাংলাদেশ অনুপস্থিত।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মুজিবুর রহমান পাটোয়ারি বলেন, মাদক নির্মূল করতে হলে সব পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।

সম্প্রতি মাদক নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক হয়। বৈঠকে মাদক ব্যবসায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণির সদস্যের পৃষ্ঠপোষকতাসহ এই অবৈধ ব্যবসায় যারা জড়িত, তাদের তথ্য তুলে ধরা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা ঐ বৈঠকে বলেন, মাদক নির্মূলে সব রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনসহ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া এটি নির্মূল সম্ভব নয়।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!