প্রশিক্ষিত ডাক্তার ও টেকনিশিয়ান নেই হাসপাতালগুলোতে

  • আপডেট সময় শনিবার, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৪
  • 85 পাঠক

———————————————————————-
মফস্বলে পদায়ন হলেও যেতে চান না অনেকে

———————————————————————

দিশারী ডেস্ক। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।

চিকিৎসা সেবার দুর্দশার পেছনে অযোগ্যতা, অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি যেমন, তেমনি জনবলের ঘাটতিও কম দায়ী নয়। প্রশিক্ষিত ডাক্তার ও টেকনিশিয়ান নেই হাসপাতালগুলোতে। মফস্বলে পদায়ন হলেও যেতে চান না অনেকে। সারাদেশে সরকারি হাসপাতালের আশেপাশে লাখো বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে ওঠেছে। যার ৯৫ ভাগ অবৈধ। যার অধিকাংশের মালিক রাজনৈতিক দলের নেতা। এক শ্রেণীর ডাক্তাররা সরকারি হাসপাতালে ডিউটি না করে সেখানে কাজ করেন। সবমিলিয়ে সারাদেশে চিকিৎসা সেবায় চরম অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে।

উন্নতি ধরে রাখাই উন্নত থাকার প্রধান শর্ত। বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্র অতীতের তুলনায় উন্নত হলেও তা ধরে রাখার ব্যর্থতাই এখন মাথাব্যথার বিষয়। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় যত, সেবার মান ততটা উন্নত নয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় সারাদেশের হাসপাতালগুলো নিয়ন্ত্রণে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। সরকারি হাসপাতালের পরিচালক, বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য), সিভিল সার্জন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স- কোথায়ও সঠিক মনিটরিং ব্যবস্থাপনা নেই। অর্থাৎ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার গোড়াতেই গলদ।

খোদ রাজধানীর মালিবাগের চৌধুরীপাড়ার ‘জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে’ মঙ্গলবার ১০ বছর বয়সী আহনাফ তাহমিন আয়হামকে খতনা করাতে গিয়ে মারা গেছেন। বেসরকারি এই হাসপাতালের অনুমোদন ছিল না। তারপরও অপারেশন করে যাচ্ছে। এর আগে গত ৩১ ডিসেম্বর রাজধানীর ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে চিকিৎসকদের অসতর্কতা ও গাফিলতির শিকার হয়ে আয়ানের মৃত্যু হয়। দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসনের নাকের ডগায় দুই শিশুর খত্না হলো, তাহলে সারাদেশে চিকিৎসা সেবার কি চিত্র তা আর বলা উপেক্ষা রাখে না।

সরকারি হাসপাতালে রোগী গেলে পাঠিয়ে দেয়া হয় আশপাশের বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকে। সরকারি হাসপাতালে রোগীরা ওষুধ পায় না। বেশিরভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অপারেশন থিয়েটার থাকে তালাবদ্ধ। অথচ সেখানে সিজারসহ মাঝারি ধরনের অপারেশন সম্ভব। কোন উপজেলা হাসপাতালে সার্জন আছে, এনেসথেসিওলজিস্ট নেই। আবার কোথায় এনেসথেসিওলজিস্ট আছে, সার্জন নেই। অর্থাৎ অপারেশন বন্ধ।

এসব দুরবস্থায় চিত্র সব পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু বধির লোক যেমন কানে শোনে না, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের অবস্থাও যেন একই। ঢাকার বাইরে ডাক্তারদের যত পোস্টিং দেয়া হয়, তার অর্ধেক কর্মস্থলে যোগদান করে চলে আসে। সপ্তাহে একদিন যায়।

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার প্রতি মাসে মাসোহারা দেয় তারা। একদিন কর্মস্থলে এসে পুরো সপ্তাহের স্বাক্ষর দিয়ে দেন। ৯৫ ভাগ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার লাইসেন্স ছাড়াই চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। ওখান থেকে টাকার ভাগ পান এক শ্রেণীর সিভিল সার্জন, বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য)-এমনকি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পর্যন্ত যায়।

ঢাকার বাইরে সরকারি হাসপাতাগুলোতে অর্ধেক জনবল শূণ্য। আবার যাদের পোস্টিং দেয়া হয়, তারা কর্মস্থলে থাকেন না। রাজধানীর মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ি ও পুরান ঢাকায় কয়েক হাজার অবৈধ ক্লিনিক আছে। র‍্যাবের সাবেক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম প্রায় চার বছর অভিযান চালিয়ে কয়েক হাজার অবৈধ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার শনাক্ত করেন। ভূয়া ডাক্তার এনেসথেসিওলজি দিচ্ছে- এমন কয়েকটি হাতে-নাতে তিনি ধরেন। কয়েকশ লাইসেন্স বাতিলও করা হয় ওই সময়।

এতো কিছু পরের টনক নড়ে না স্বাস্থ্য বিভাগের। এটি এখন এক শ্রেণীর কর্মকর্তার ঘুষ খাওয়ার কারখানায় পরিণত হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের এক শ্রেণীর কর্মকর্তারা শুধু অর্থের পেছনে ছুটছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মালেক ড্রাইভারের শত কোটি টাকা টাকার মালিক। কেরানী আবজালও কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে কয়েকশ কোটি টাকা পাচার করেছেন। সেখানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার চিত্র কেমন হবে-সেটা সবার জানা। আবজাল-মালেকরা দুর্নীতি করেছে, সেখানে তারা সিগনেচার করেনি। ফাইল তারা অনুমোদন করে না। এতে প্রমাণিত হয়, তাদের উপরের কর্মকর্তারা যে অবৈধ কত টাকার মালিক। আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণীর কর্মকর্তার কি অবস্থা ? চিকিৎসকরাও বলেন, চিকিৎসা সেবার অব্যবস্থাপনা দেশের জন্য অশনি সংকেত।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, সারাদেশে স্বাস্থ্যের কোথায় কি ধরনের সমস্যা হচ্ছে, তা চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধান করবো। ডাক্তারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে যা যা করার করবো। অপচিকিৎসার সসাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, খত্না করাতে গিয়ে শিশুর মৃত্যুর খুবই দুঃখজনক। আমরা বিষয়টি সতর্কতার সাথে নিয়েছি। এসব বিষয় কঠোরভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে ডাক্তারদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা বেশি। তাদের যেখানে-সেখানে পোস্টিং দিতে সমস্যা হচ্ছে। জেলা-উপজেলায় নানা অজুহাতে থাকতে চান না তারা। বিবাহিত নারী ডাক্তারদের সন্তান জন্মকালীন ছুটি থাকে। স্বামী ঢাকায় থাকলে সেখানে দিতে হয়। সরকারি চাকরিতে এক জায়গায় দেয়ার বিধান আছে। তবে চিকিৎসকদের সবার মন-মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। যার যার অবস্থান থেকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। কারণ এটি মহৎ পেশা। সেই মন নিয়ে কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশ সোসাইটি অব এনেসথেসিওলজিস্টস্-এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, রোগীকে কম বা বেশি, জটিল বা সাধারণ অপারেশন-একই ব্যবস্থাপনায় এনেসথেসিয়া দিতে হয়। তবে এনেসথেসিয়া দেয়ার জন্য আগে তিনটি বিষয় নিশ্চিত হতে হবে। প্রথমে দেখতে হবে হাসপাতালে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা আছে কিনা। অপারেশন করার যন্ত্রপাতিসহ সঠিক ব্যবস্থাপনা আছে কিনা। অনেক ওষুধ রয়েছে যা প্রয়োগ করা হলে বেশিরভাগ সময় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

কিন্তু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতি হয় না। তবে আবার জটিলতা হওয়ার আশংকা রয়েছ। ওই সময় আইসিইউ এবং সিসিইউ সাপোর্টের প্রয়োজন হয়। রোগীকে এনেসথেসিয়া দেয়ার আগে এই বিষয়গুলো আগে নিশ্চিত করতে হবে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের। আর যিনি এনেসথেসিয়া দিবেন তিনি প্রকৃতপক্ষে এনেসথেসিওলজিস্ট কিনা সেটা দেখতে হবে। রোগীকে এনেসথেসিয়া দেওয়ার উপযোগী কিনা তা আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হবে। কোন কিছু পরীক্ষা না করে কথায় কথায় এনেসথেসিয়া দিলে রোগীর মৃত্যুসহ যেকোন ধরনের জটিলতার সম্ভাবনা বেশি। সারাদেশে প্রতিদিনই আয়ান ও আইহানদের মতো ভুল চিকিৎসায় রোগী মারা যাচ্ছে।

তিনি বলেন, ঢাকার বাইরে বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সিজারের নামে বাণিজ্য চলছে। অব্যবস্থাপনার মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসার বাণিজ্য চলছে। দুটি শিশু খত্না করতে গিয়ে মারা যাওয়া অব্যবস্থাপনায় দায়ী। অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, সারাদেশে এনেসথেসিওলজিস্ট আছে তিন হাজার। এটা চাহিদার তুলনায় অনেক কম।

ডাক্তারদের বড় সমস্যা সবাই ঢাকায় থাকতে চান। তবে ঢাকার বাইরে প্রাকটিস করতে যান ঠিকই। বদলি করলেও ঢাকায় থাকে। এসব ডাক্তাররা প্রভাবশালী। এক শ্রেণীর প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে ঢাকায় অবস্থান করছেন বছরের পর বছর।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, আমরা ঠিক বদলি করি, কিন্তু আদেশ কার্যকর হয় না। এদিকে আগে জুনিয়র কনসালটেন্স পদে বদলির ক্ষমতা ছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। সম্প্রতি এটা নিয়ে গেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এখন কারে কোথায় দিবে, কোথায় পদ খালি আছে-এসব বিষয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রস্তাব দেয়া হয় মন্ত্রণালয়। তবে ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে অধিদপ্তরের সেই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হয় না। পরিবর্তন হয়ে যায়। এর মূলে রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব ও মোটা অঙ্কের উৎকোচ।

অধিদপ্তরে কর্মকর্তারা বলেন, অধিদপ্তরের প্রস্তাব অনুযায়ী অনুমোদন দিলে চিকিৎসা সেবায় সংকট থাকতো না। ওটিও তালা দেয়া থাকতো না। উপজেলা পর্যায়ে অপারেশন চলতো। গ্রামের মানুষ উপযুক্ত সুচিকিৎসা পেতেন। জরুরি স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে কারোই হেলাফেলা করা উচিত না। কারণ এটা জীবন-মৃত্যুর বিষয়। যোগ্য লোককে যোগ্য জায়গায় বসাতে হবে। নইলে মৃত্যুর সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়তে থাকবে।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!