মানুষ কেন দুর্নীতি করে ?

  • আপডেট সময় শনিবার, জুলাই ১৩, ২০২৪
  • 223 পাঠক

দিশারী ডেস্ক। ১৩ জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।

মানুষের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতা দেখা যায় নানা কারণে, যা সাইকোলজির বিভিন্ন তত্ত্ব এবং গবেষণার আলোকে ব্যাখ্যা করা যায়।

লোভ এবং স্বার্থপরতা
মানুষের লোভ এবং স্বার্থপরতা একটি প্রাথমিক মনস্তাত্ত্বিক কারণ হতে পারে যা তাদেরকে দুর্নীতিতে লিপ্ত করে। লোভ মানুষকে অতিরিক্ত সম্পদ সংগ্রহ করতে প্ররোচিত করে। সাইকোলজির ভাষায়, এটি মানুষের ‘ ড্রাইভ থিওরি ’ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়।

এই তত্ত্ব অনুসারে, মানুষ সবসময় তাদের চাহিদা পূরণের জন্য তাড়না অনুভব করে হয়। যখন কেউ অতিরিক্ত সম্পদের চাহিদা অনুভব করে, তখন তারা সহজ এবং অল্প পরিশ্রমে এটি অর্জন করতে চায়। লোভের তীব্রতা মানুষের নৈতিক বিচার ক্ষমতাকে দুর্বল করতে পারে এবং তাদেরকে অবৈধ পথে সম্পদ অর্জনের দিকে প্ররোচিত করে।

ক্ষমতা এবং প্রভাব
দুর্নীতির মাধ্যমে বড়লোক হওয়া মানে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নয়, বরং ক্ষমতা এবং প্রভাব বৃদ্ধি করাও। ক্ষমতা ও প্রভাবের জন্য মানুষের মধ্যে একটি প্রাকৃতিক আগ্রহ থাকে। এটা ‘ পাওয়ার মটিভেশন থিওরি ’র সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়। এই তত্ত্ব অনুসারে, মানুষ অন্যের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য এবং প্রভাব বিস্তার করতে চায়। ক্ষমতার লোভ মানুষের মধ্যে স্বার্থপরতা এবং অনৈতিক মনোভাবের জন্ম দিতে পারে, যা তাদেরকে দুর্নীতির পথে চালিত করে।

সামাজিক তুলনা এবং প্রতিযোগিতা
মানুষ অন্যদের সাথে নিজেদের তুলনা করতে ভালবাসে। যখন কেউ দেখে যে তাদের আশেপাশের লোক দুর্নীতি করে দ্রুত ধনী হচ্ছে, তখন তাদের মধ্যেও একই কাজ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ‘ সোশ্যাল লার্নিং থিওরি ’ তত্ত্ব অনুসারে, মানুষ তাদের আশেপাশের পরিবেশ থেকে শিক্ষা নেয় এবং তা তাদের আচরণে প্রতিফলিত হয়। প্রতিযোগিতার এই মানসিকতা মানুষকে অবৈধ পথে সম্পদ অর্জনের দিকে ঠেলে দেয়।

নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাব
মানুষের মধ্যে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাবও দুর্নীতি করার একটি প্রধান কারণ হতে পারে। যাদের মধ্যে নৈতিককতা ও মূল্যবোধে দৃঢ় নয়, তাদের পক্ষে নীতি বিরুদ্ধ কাজ করা সহজ হয়। সাইকোলজির একটি বিখ্যাত তত্ত্ব হলো ‘ মোরাল ডিসএনগেজমেন্ট থিওরি ’। এই তত্ত্বানুসারে, মানুষ তাদের নিজেদের আচরণকে নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য মনে করতে বিভিন্ন যুক্তি দাঁড় করায়, যা তাদেরকে দুর্নীতির পথে চালিত করে। মূল্যবোধহীন মানুষ নৈতিক দায়িত্ববোধকে উপেক্ষা করে এবং নিজেদের স্বার্থে অবৈধ কার্যকলাপ করে।

ঝুঁকি নেয়ার প্রবণতা
কিছু মানুষ ঝুঁকি নিতে ভালোবাসে। এই ঝুঁকি গ্রহণের প্রবণতা তাদেরকে দুর্নীতি করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। এ বিষয়ে সাইকোলজির একটা গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব রয়েছে, সেটা হলো ‘ রিস্ক টেকিং বিহেভিয়ার থিওরি ’। এই তত্ত্ব বলে কিছু মানুষ ঝুঁকির মধ্যে আনন্দ খুঁজে পায় এবং তারা ঝুঁকি নিয়ে বড়লোক হওয়ার চেষ্টা করে। ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা তাদেরকে দ্রুত এবং অধিক সম্পদ অর্জনের দিকে প্ররোচিত করে।

সামাজিক এবং অর্থনৈতিক চাপ
সামাজিক এবং অর্থনৈতিক চাপও মানুষের দুর্নীতিপ্রবণ হওয়ার অন্যতম কারণ হতে পারে। অর্থনৈতিক অস্থিরতা, বেকারত্ব, এবং আর্থিক সংকট মানুষকে দুর্নীতির পথে চালিত করতে পারে। সামাজিক চাপও দূর্নীতির কারণ হতে পারে। মানুষ তাদের সামাজিক মর্যাদ বজায় রাখতে বা উন্নীত করতে দূর্নীতি করে। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যাক্তির সামাজিক বৃত্তের সবাই যখন ধনী এবং সফল, তখন সে নিজেও একই স্তরে পৌছানোর জন্য অবৈধ উপায় অবলম্বন করতে পারে।

পরিবেশগত প্রভাব
মানুষের পরিবেশ এবং সামাজিক ব্যবস্থা দুর্নীতি করার প্রবণতা বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। যদি কেউ দুর্নীতি ডুবে থাকা সমাজে বসবাস করে, যেখানে দুর্নীতি সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য এবং শাস্তির সম্ভাবনা কম, তাহলে সেই ব্যক্তি নিজেও দুর্নীতিপ্রবণ হয়ে ওঠে। সাইকোলজির ‘ সোশ্যাল কনটেক্সট থিওরি ’ অনুসারে, মানুষের আচরণ তাদের আশেপাশের সামাজিক প্রেক্ষাপট দ্বারা প্রভাবিত হয়। দুর্নীতিপূর্ণ পরিবেশ মানুষকে দূর্নীতির পথে প্রলুব্ধ করে।

ব্যক্তিগত এবং পেশাগত মূল্যায়ন
কিছু মানুষ তাদের ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনে স্বীকৃতি এবং সম্মান অর্জনের জন্য দুর্নীতি করে। তাদের কাছে অর্থ এবং সম্পদ শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, বরং সামাজিক মর্যাদা এবং পেশাগত স্বীকৃতির মাধ্যম। সাইকোলজির ‘ ইগো থিওরি ’ অনুসারে, মানুষ তাদের আত্মসম্মান এবং সামাজিক অবস্থানের উন্নতির জন্য অবৈধ কার্যকলাপ করতে পারে।

মানসিক চাপ
মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ মানুষকে দুর্নীতির পথে প্ররোচিত করতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, মানুষের মানসিক সুস্থতা দুর্নীতি করার প্রবণতা বাড়াতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, একজন ব্যক্তি যদি আর্থিক চাপ বা বেকারত্বের কারণে মানসিক অবসাদে ভোগে, তাহলে সে দ্রুত অর্থ উপার্জনের জন্য অবৈধ উপায় অবলম্বন করতে পারে।

শেষ কথা হলো, মানুষের দুর্নীতির প্রবণতার পেছনে নানা মনস্তাত্ত্বিক কারণ থাকতে পারে। লোভ, ক্ষমতা, সামাজিক তুলনা, নৈতিক মূল্যবোধের অভাব, ঝুঁকি গ্রহণের প্রবণতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপ, পরিবেশগত প্রভাব, ব্যক্তিগত এবং পেশাগত মূল্যায়ন, এবং মানসিক সুস্থতা এ সকল কারণগুলো মানুষকে দুর্নীতির পথে চালিত করতে পারে।

সাইকোলজির দৃষ্টিতে এই কারণগুলো বিশ্লেষণ করে আমরা বুঝতে পারি কেন মানুষ বড়লোক হতে দুর্নীতি করে। এই কারণগুলোকে দূরীকরণ এবং মানুষের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ বৃদ্ধির মাধ্যমে দুর্নীতির প্রবণতা কমানো সম্ভব।

তথ্যসূত্র:

1. Bandura, A. (1991). Social cognitive theory of moral thought and action. In W. M. Kurtines & J. L. Gewirtz (Eds.), **Handbook of moral behavior and development** (Vol. 1, pp. 45-103). Hillsdale, NJ: Erlbaum.
2. Festinger, L. (1954). A theory of social comparison processes. **Human Relations, 7**, 117-140.
3. McClelland, D. C. (1975). **Power: The inner experience**. Irvington.
4. Mischel, W., & Shoda, Y. (1995). A cognitive-affective system theory of personality: Reconceptualizing situations, dispositions, dynamics, and invariance in personality structure. **Psychological Review, 102**, 246-268.
5. Rotter, J. B. (1966). Generalized expectancies for internal versus external control of reinforcement. **Psychological Monographs: General and Applied, 80**, 1-28.

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!