দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞায় এ কেমন হেয়ালি ?

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, অক্টোবর ৮, ২০২৪
  • 83 পাঠক

দিশারী রিপোর্ট। ৮ অক্টোবর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। ৫ আগস্টের পর থেকে গতকাল পর্যন্ত এমপি-মন্ত্রী, আমলা, ব্যবসায়ী, ব্যাংকারসহ বিগত সরকারের শতাধিক ব্যক্তির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ তালিকায় এমন অনেকেই আছেন, যারা দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারির আগেই ভিনদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। ফলে ‘অকার্যকর’ এসব নিষেধাজ্ঞা নিয়ে নানা সমালোচনা শুরু হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন ক্ষমতাচ্যুত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী অবস্থান করছেন যুক্তরাজ্যে। সপরিবার সিঙ্গাপুরে চলে গেছেন এস আলম গ্রুপের প্রধান সাইফুল আলম। মূলত সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গেই দেশ ত্যাগ করেন তারা।

এস আলম গ্রুপের প্রধান সাইফুল আলম, স্ত্রী ফারজানা পারভীনসহ পরিবারের ১৩ সদস্যের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন ঢাকার একটি আদালত। একই দিন একই নিষেধাজ্ঞা আসে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার স্ত্রী রুকমীলা জামানের বিরুদ্ধেও। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পদ্মা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের দেশত্যাগেও নিষেধাজ্ঞা এসেছে গতকাল। আগের দিন নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রহমানের দেশত্যাগেও।

এর আগে ১ সেপ্টেম্বর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, তার স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খানসহ ১০ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তার স্ত্রী ছাড়াও এ তালিকায় রয়েছেন মেয়ে সাফিয়া তাসনিম খান, ছেলে শাফি মোদ্দাছির খান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, মোল্যা নজরুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মো. হারুন অর রশীদ বিশ্বাস, জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এপিএস মনির হোসেন।

নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও তিনি দেশে আছেন কিনা, তা নিশ্চিত নয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দুদকের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, একটি জাতীয় পত্রিকায় কয়দিন আগে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন নাফিজ সরাফাত। দেশে না থাকলে তিনি এ বিজ্ঞাপন দেয়া প্রয়োজন মনে করতেন না।

—————————————————————————————————–

দেশেই নেই, তার পরও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা !!!

—————————————————————————————————–

গত ১৯ সেপ্টেম্বর সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, সাবেক সংসদ সদস্য জান্নাত আরা হেনরি ও মূসকের (ভ্যাট) সাবেক কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এর মধ্যে হেনরিকে গত ৩০ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয়েছে।

গত ২৯ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আট মন্ত্রী ও ছয় সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন আদালত। আট মন্ত্রী হলেন জাহিদ মালেক, দীপু মনি, মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাধন চন্দ্র মজুমদার, নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, কামাল আহমেদ মজুমদার, শাহজাহান খান ও কামরুল ইসলাম।

ছয় সংসদ সদস্য হলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সালিম উদ্দিন আহমেদ শিমুল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের জিয়াউর রহমান, ময়মনসিংহ-১১ আসনের কাজীম উদ্দিন আহমেদ, মাদারীপুর-১ আসনের নুর-ই-আলম চৌধুরী লিটন, নোয়াখালী-৩ আসনের মামুনুর রশিদ কিরণ এবং খাগড়াছড়ির কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও মানিকগঞ্জ-১ আসনের সাবেক এমপি নাঈমুর রহমান দুর্জয় ও তার স্ত্রী ফারহানা রহমানের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।

বিগত সরকারের অনেকেই অবৈধ পথে ভারতে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে সিলেটের কানাইঘাট, সনাতনপুঞ্জি ও ডোনা, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, নেত্রকোনা, দিনাজপুরের হিলি, যশোরের বেনাপোল ও পুটখালী ঘাট, পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা ও লালমনিরহাটের দহগ্রাম সীমান্ত ব্যবহার করছেন। সীমান্ত পার হওয়ার পর কলকাতা, আগরতলা, ত্রিপুরা, দিল্লি, আসাম ও মেঘালয় রাজ্যে অবস্থান নিয়েছেন তারা।

ভারতে আশ্রয় নেয়া একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশির ভাগ এমপি-মন্ত্রী অবস্থান করছেন কলকাতার নিউটাউন ও সল্টলেক উপশহরে। আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক সংসদ সদস্য অসীম কুমার উকিল, মাইনুল হাসান খান নিখিল, সোলায়মান সেলিম ও অপু উকিল রয়েছেন নিউটাউন উপশহরে। একই এলাকায় আছেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেল ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়াও।

অনেকে ওঠেছেন কলকাতার সল্টলেক উপশহরে। এদের মধ্যে বাগেরহাট-১ আসনের সাবেক সদস্য শেখ হেলাল উদ্দিন ও বাগেরহাট-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সারহান নাসের তন্ময়ও আছেন। ভারতে অবস্থান নেয়া এসব অনেক ব্যক্তির নামেই দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

দেশের বাইরে চলে যাওয়ার পর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনা আগেও দেখা গেছে। সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও ছাগলকাণ্ডে আলোচিত কর্মকর্তা মতিউর রহমানের ক্ষেত্রেও এ চর্চা দেখা গেছে।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, দেশের বাইরে কেউ চলে গেলেই যে নিষেধাজ্ঞা দেয়া যাবে না, সে রকম নয়। নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কারণ হলো যেন যাতায়াত নিয়ন্ত্রিত হয়। আবার দেশে ফিরলেও তাকে যেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করতে পারে।

দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, কেউ একাধিক পাসপোর্ট ব্যবহার করেন। ইমিগ্রেশন ব্যবহার না করে সীমান্ত পার হয়ে চলে যান। সীমান্ত দিয়ে পার হয়ে গেলে তো নিষেধাজ্ঞা দিয়েও ঠেকানো যায় না।

মানবাধিকার বিষয়ক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে যাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে তাদের নথি তো সরকারের কাছে নেই। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে জানা যাচ্ছে, কারা কারা দেশের বাইরে চলে গেলেন। ফলে এটা ডকুমেন্টেড না এবং সরকারের এ ধরনের তথ্য নেই। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে এবং যেখানে সরকার মনে করছে দেশত্যাগে বাধা দেয়া দরকার, তাদের নাম ঘোষণা করে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হচ্ছে। সুনির্দিষ্টভাবে যদি সরকারের কাছে দেশত্যাগের তথ্য থাকত, তাহলে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা অকার্যকর হতো। এটা এক ধরনের তামাশাও মনে হতো।

দুদক সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন মন্ত্রী-এমপিরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কেউ কেউ গ্রেফতার হয়েছেন। তবে গ্রেফতার হোক বা না হোক, দুদকের লক্ষ্য হলো, কেউই যেন দেশত্যাগ করতে না পারে। সে কারণে বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হবে। কমিশন অনুমোদন দিলেই তালিকা আদালতে পাঠানো হবে। আদালতের আদেশ দেশের সব স্থল ও বিমানবন্দরে পাঠানো হবে।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, দালাল চক্রের মাধ্যমে চোরা পথে কেউ দেশের বাইরে গেলে সেই তথ্য তো ইমিগ্রেশনের কাছেও থাকছে না। এভাবে পালাতে গিয়ে একজন বিচারক তো ধরাও খেলেন। একজন রাজনীতিবিদ মারা গেলেন। সেটাই বেশি হচ্ছে। সরকারের কাছে ডকুমেন্টেশন না থাকলে সরকার যাতায়াত নিয়ন্ত্রণের জন্য এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের মতে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনেকে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করার চেষ্টা করেন। তাদের অনেককে পুলিশ ও বিজিবি আটক করে। তবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করতে সক্ষম হন।

সৌজন্যে : অন্য দৈনিক।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!