ঘরে সবই আছে কেবল রাকিব নেই

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ২৪, ২০২৪
  • 34 পাঠক

দিশারী ডেস্ক। ২৪ অক্টোবর ২০২৪

এখনো ফ্রিজে জমানো রয়েছে দুধ, গুড়, নারিকেল ও পুলিপিঠার পুর। নিস্তব্ধ ঘরে প্রতিটি জিনিস পরিপাটি সাজানো। টানটান করা বিছানার উপর এক পাশে বালিশ। পড়ার টেবিলে তাকে তাকে সাজানো বই।

ড্রয়িংরুমে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে প্রিয় মোটরসাইকেল। তার পাশেই কাপড় ধোয়ার মেশিন। পানিশূন্য পানির ফিল্টারের ভেতরটা শুষ্ক, আয়রনের হালকা আস্তর।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় গত ১৯ জুলাই রাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হোসেন (২৯)। রাকিব চাকরির সুবাদে ঢাকায় থাকতেন।

কিন্তু গ্রামের বাড়িতে তার ঘরটা সবসময় এমনই সাজানো গুছানো থাকতো তার অপেক্ষায়। বাড়িতে তিনজন মানুষের বসবাস। কিন্তু দু’জন মানুষ থাকলেও দেখে মনে হবে কোথাও যেন কেউ নেই। রাকিব নিহত হয়েছেন আজ ৯৪ দিন।

কিন্তু তার পরিবারের শোকের মাতম আজও থামেনি। ঝিনাইদহ জেলার সদর পৌরসভার সার্কিট হাউজ রোডের মহিষাকুণ্ডু গ্রামের বাসিন্দা বিমান বাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন অফিসার (অব.) আবু বকর সিদ্দিক (৬১) এবং হাফিজা খাতুন (৫৮) দম্পতির আদরের ধন রাকিবুল হোসেন।

তিনি ঢাকার বনানী সুপার জুট মিলে চাকরি করতেন। ঢাকার মিরপুরে-১১ নম্বরে ভাড়া বাসায় থাকতেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে রাকিব ছোট। বড় ভাই ইকবাল হোসেন (৩৭) সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসেবে ঝিনাইদহ শাখায় কর্মরত।

রাকিবের পিতা আবু বকর সিদ্দিক বলেন, আন্দোলনের সময় আমরা রাকিবকে ফোন করলে সে লোকজনের ভিড় থেকে সরে গিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলতো। সে যে আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, এটা সে আমাদের বুঝতে দিতে চাইতো না। এসব কথা রাকিবুলের সহকর্মীরা পরে আমাদের জানিয়েছে। মা হাফিজা খাতুন বলেন, ১৮ই জুলাই ঢাকায় যখন আন্দোলনে হামলা শুরু হয়, তখন থেকেই আমরা ভয়ে ছিলাম।

শুধু ভাবতাম আমার রাকিব অফিসে যাবে কীভাবে? ১৯শে জুলাই শুক্রবার রাকিবকে ফোন করে বললাম, আব্বু অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরি এসো? প্রতি উত্তরে সে বলেছিল, ‘না মা, ফেরা যাবে না।’ তবে সে ফিরেছে লাশ হয়ে। তিনি বলেন, ১৯শে জুলাই, শুক্রবার, বেলা আড়াইটার পরে আমার ছেলের সঙ্গে শেষ কথা হয়। রুটি আর ডিম ভাজি দিয়ে সকালের নাস্তা করেছিল রাকিব।

হাফিজা খাতুন বলেন, ১৯শে জুলাই মিরপুর-১১ তে মেট্রোরেল লাইনের নিচে আন্দোলনকারীদের মাঝে আমার ছেলে পানি বিতরণ করছিল। শিক্ষার্থীদের মাঝে সে যতক্ষণ ছিল, ততক্ষণ নিরাপদেই ছিল। যখনই সে পানি বিতরণ শেষে শিক্ষার্থীদের থেকে কিছুটা আলাদা হয়ে যায়, তখনই তাকে টার্গেট করে গুলি করা হয়।

আমার ছেলের সঙ্গে থাকা সহকর্মীরা জানিয়েছে, উপর থেকে গুলি এসে তার গলায় ঢুকে যায়। পরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে আমার ছেলেটা মারা যায়। আবু বকর সিদ্দিক বলেন, আমার ছেলের বন্ধু পিয়াস জানিয়েছে, সে সময় একজন বয়স্ক মহিলা দৌড়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে রাকিবের সামনে এসে পড়ে যায়। রাকিব তাকে টেনে তুলতে এগিয়ে গিয়েছিল। আর তখনই উপর থেকে নিখুঁত টার্গেটে আমার ছেলেকে গুলি করা হয়।

রাকিবের মা বলেন, ১৯ জুলাই রাত ৮টার দিকে একমাত্র ভাতিজা রাফসান (৪)-এর সঙ্গেই রাকিবের শেষ কথা হয়। রাফসান রাকিবকে ‘ছোট আব্বু’ বলে ডাকতো। ফোনে কথা বলার সময় রাফসান রাকিবকে বলেছিল- ছোট আব্বু তুমি বাড়ি চলে আসো।

গাড়ি না পেলে তোমার বাইক নিয়ে চলে আসো। না হয় তুমি এম্বুলেন্সে বাড়ি চলে আসো। কে জানতো চার বছরের অবুঝ শিশুটির সেই কথাই এমন নির্মম বাস্তবে পরিণতি পেয়ে যাবে ! রাকিব বাড়ি ফিরেছে ঠিকই। প্রিয় বাইক কিংবা গাড়িতে নয়, বরং নিথর দেহে এম্বুলেন্সে চেপেই শেষবারের মতো বাড়ি ফেরা হলো তার।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!