দিশারী রিপোর্ট। ৩১ অক্টোবর, ২০২৪
বাংলাদেশী ভ্রমণকারীদের অন্যতম গন্তব্য প্রতিবেশী দেশ ভারত। বেশির ভাগই ভ্রমণ করে চিকিৎসার জন্য, প্রায় ৮০ শতাংশ। এর বাইরে কেনাকাটার জন্য ১৫ ও অবকাশ যাপনে যায় ৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে বছরে তিন-চার লাখ বাংলাদেশী দেশটিতে ভ্রমণ করে।
তবে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এ সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে। ৫ আগস্ট থেকে কেবল আড়াই মাসেই বৈধভাবে ভারতে গেছে সাড়ে তিন লাখের মতো বাংলাদেশী। ইমিগ্রেশন সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। এর বাইরে অবৈধভাবেও বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে অনেকে ভারতে পাড়ি দিয়েছে।
ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব ট্যুর অপারেটরসের তথ্যমতে, বাংলাদেশী ভ্রমণকারীদের প্রথম পছন্দ কলকাতা। এরপর আছে সিকিম, গোয়া, কাশ্মীর, দার্জিলিং, গুজরাট, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, দিল্লি, হায়দরাবাদসহ উত্তর-পূর্ব ভারত।
তবে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী এ সময়ে গেলেও ভারতের পর্যটন কিংবা চিকিৎসা খাতে তা ভূমিকা রাখেনি। উল্টো এ দুই খাতে আগের চেয়ে পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। মূলত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর যাওয়া বাংলাদেশীদের বড় অংশই রাজনৈতিক নেতাকর্মী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আত্মগোপনে থাকা এসব নেতাকর্মী প্রায় সময়টাই অলস পার করছেন।
—————————————————————————————————–
বাংলাদেশী ভ্রমণকারীদের অন্যতম গন্তব্য প্রতিবেশী দেশ ভারত। বেশির ভাগই ভ্রমণ করে চিকিৎসার জন্য, প্রায় ৮০ শতাংশ। এর বাইরে কেনাকাটার জন্য ১৫ ও অবকাশ যাপনে যায় ৫ শতাংশ।
——————————————————————————————————
ইমিগ্রেশন সূত্র জানায়, ২০২২ সালে ভারতে যাওয়া বাংলাদেশীর সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৪ হাজার ৬৭। ২০২৩ সালে সংখ্যাটি ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৫৭০-এ দাঁড়ায়।
তবে চলতি বছর ৫ আগস্ট থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত কেবল এ আড়াই মাসেই ভারতে গেছে ৩ লাখ ৪০ হাজার বাংলাদেশী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গেছে যশোর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেটের স্থলবন্দরগুলো ব্যবহার করে।
জানতে জাইলে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির বলেন, প্রায় সাড়ে তিন লাখ বাংলাদেশীর ভারতে যাওয়াটা স্বাভাবিক কিনা সেটি বুঝতে বিগত বছরগুলোর এ সময়ের তথ্য বিশ্লেষণ করতে হবে। এ সময়ে দুর্গা পূজা ছিল। পূজার এ সময়টায় অনেকেই প্রতিবেশী দেশটিতে ভ্রমণ করে। এর বাইরে রাজনৈতিক কারণও রয়েছে। এ নিয়ে একটা অনুসন্ধান হতে পারে। ভবিষ্যতের জন্য এবং নীতিগত কারণেই তথ্যানুসন্ধান দরকার।
বছরের অন্যান্য সময় ভারতে যাওয়া বাংলাদেশীদের প্রধান গন্তব্য চিকিৎসা ও পর্যটন থাকলেও এবারের চিত্রটি একদমই ভিন্ন ছিল বলে ইমিগ্রেশন-সংশ্লিষ্ট এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, সাধারণত ভারতে যাওয়া বাংলাদেশীদের মধ্যে বড় একটি অংশই থাকে পর্যটক। এরপর চিকিৎসার জন্য দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাংলাদেশী ভারতে যায়।
তবে ৫ আগস্টের পর এ চিত্র পুরো বদলে যায়। এ সময়ের মধ্যে যেসব বাংলাদেশী প্রতিবেশী দেশটিতে গেছেন তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। এর বাইরে কিছু পুলিশ সদস্যসহ সরকারি চাকরিজীবীও রয়েছেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পর থেকেই আত্মগোপনে রয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও এমপিরা। সুযোগ বুঝে কেউ কেউ সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশে নিজেদের ভিসা আবেদন কেন্দ্রগুলোও অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। পরে সীমিত পরিসরে কার্যক্রম শুরু হলেও চিকিৎসা এবং যাদের জরুরি প্রয়োজন, তাদের বাইরে ভারতে যাওয়ার অনুমতি মিলছে না।
এদিকে ভিসা না পেয়ে অনেকেই বেছে নিচ্ছে অবৈধ পথ। দ্বারস্থ হচ্ছে অরক্ষিত সীমান্ত ঘিরে সক্রিয় থাকা চক্রের। বাংলাদেশ থেকে সহজে বৈধ ও অবৈধভাবে ভারতের বৃহৎ প্রবেশদ্বার যশোরের শার্শা সীমান্ত। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অসংখ্য নেতাকর্মী এ সীমান্ত দিয়ে দেশ ছেড়েছেন।
বেনাপোল ইমিগ্রেশনের প্রভাবশালী ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ভারতে গেছেন অর্ধশতাধিক পদধারী নেতা। এছাড়া স্থানীয় অবৈধ ঘাট নিয়ন্ত্রণকারীদের মাধ্যমেও অনেক নেতাকর্মী ও বিভিন্ন মামলার আসামি দেশ ছেড়েছেন। এর মধ্যে সর্বাধিক ভিড় লক্ষ করা গেছে শার্শার বহুল আলোচিত পুটখালী ও ঘিবা রুটে।
স্থানীয়রা জানান, যেসব নেতাকর্মী ও অপরাধী সীমান্ত পথে ভারতে পালিয়েছেন তাদের অধিকাংশেরই পাসপোর্ট ও ভিসা ছিল। তবে ইমিগ্রেশনে ধরা খাওয়ার ভয়ে তারা অবৈধ পথে সীমান্ত পাড়ি দেন। ভিসা ছাড়া যেহেতু অবস্থানের সুযোগ নেই তাই দালাল চক্র অপরাধীদের পাসপোর্টে এপার-ওপারের ইমিগ্রেশন সিল নকল করছে। আবার যাদের পাসপোর্ট কিংবা ভিসা নেই তারা কলকাতা ও তার আশপাশের বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠছেন।
এ বিষয়ে যশোর বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল সাইফুল্লা সিদ্দিকী বলেন, অপরাধীরা যাতে ভারতে যেতে না পারে, সে বিষয়ে নিরাপত্তা জোরদার হয়েছে। সীমান্ত পথ বা ইমিগ্রেশন ব্যবহার করে কোনো অপরাধী যাতে পালাতে না পারে বিজিবিকে সতর্ক রাখা হয়েছে।
অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে শুধু ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্তেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে তিন শতাধিক বাংলাদেশী। এর মধ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী ও খুলনা-৫ আসনের সাবেক সংসদ নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মেহেদী হাসান চৌধুরীও রয়েছেন।
ঝিনাইদাহসংলগ্ন মহেশপুরের যাদবপুর, মাটিলা, সামন্তা, পলিয়ানপুর, বাঘাডাঙ্গা, খোশালপুর, শ্যামকুড়, শ্রীনাথপুর, কুসুমপুর ও লড়াইঘাট সীমান্ত এলাকায় বিজিবির ১২টি ক্যাম্প রয়েছে।
মহেশপুরের খালিশপুর বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল শাহ মো. আজিজুস শহীদ বলেন, এ অঞ্চলের ৭৮ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকার ৬৮ কিলোমিটারে রয়েছে কাঁটাতারের বেড়া। ১০ কিলোমিটার সীমান্ত অনেকটা উন্মুক্ত। মাঠ-ঘাট, নদী-নালা রয়েছে বাংলাদেশের এ অংশে। অনুপ্রবেশ শতভাগ বন্ধ করতে না পারলেও তা প্রায় কাছাকাছি। বিজিবির নজরদারি পদ্ধতি বদল করা হয়েছে, যার সফলতাও এরই মধ্যে আসতে শুরু করেছে।
সীমান্তগুলো দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে যাওয়ার ক্ষেত্রে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। কাস্টমসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও সীমান্তের প্রভাবশালীরাই মূলত ভারতে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করে বড় অংকের অর্থ নিচ্ছেন।
বিজিবির দাবি, অবৈধ প্রবেশ রোধে সীমান্তে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে তারা। কোনো অপরাধী যেন ভারতে পাড়ি দিতে না পারে সেজন্য টহলও জোরদার করা হয়েছে। সীমান্ত এলাকার সড়কগুলোয় তল্লাশি করা হচ্ছে প্রতিনিয়তই। সেই সঙ্গে স্থানীয়দেরও সচেতন করছেন বিজিবি সদস্যরা।
এ বিষয়ে বিজিবি মুখপাত্র কর্নেল মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম বলেন, সীমান্তে অবৈধ যাতায়াত রোধে এরই মধ্যে বিজিবির পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকার নজরদারি ও টহল কার্যক্রম বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি আগাম গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
Leave a Reply