স্বাধীনতার গুরুত্ব ও ইসলাম

  • আপডেট সময় শনিবার, ডিসেম্বর ১৪, ২০২৪
  • 13 পাঠক

মুফতি রফিকুল ইসলাম আল মাদানী । ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪।

স্বাধীনতা মহান আল্লাহতায়ালার অনন্য একটি নিয়ামত। প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ও নারী-পুরুষনির্বিশেষে সব মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন।

মহানবী (সা.) বিদায় হজে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে দ্বীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন- ‘নিশ্চয়ই তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের মর্যাদা তোমাদের জন্য হারাম, যেমনিভাবে এ পবিত্র ঈদের দিন, এ হজের মাস ও মক্কা নগরীকে হারাম করা হয়েছে তোমাদের জন্য।’ (সহিহ বুখারি ৬৭)।

অপর হাদিসে রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ হে লোক সকল! তোমাদের প্রতিপালক এক, তোমাদের পিতা এক। শোন! অনারবের ওপর আরবের, আরবের ওপর অনারবের এবং কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শেতাঙ্গের ও শেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, তাকওয়া ব্যতীত। তোমাদের মধ্যে মর্যাদাবান সে-ই যে অধিক তাকওয়ার অধিকারী।’ (বায়হাকি-৫১৩৭)।

কোনো মানুষের অন্য কোনো ব্যক্তি বা জাতির প্রতি অত্যাচার ও শোষণ করার অধিকার নেই। নেই কারও অধিকার ক্ষুণ্ন করার অনুমতি। বরং নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য প্রচেষ্টা করা এবং আত্মরক্ষার জন্য সক্রিয় হওয়া সব মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য। আপন আপন মাতৃভূমি দেশের সব নাগরিকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ আমানত। জানমাল বিসর্জন দিয়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব।

——————————————————————————————————

মহানবী (সা.) ঘোষণা করেন, ‘ আল্লাহর রাস্তায় এক দিন সীমান্ত পাহারায় নিয়োজিত থাকা দুনিয়া এবং এর সবকিছু অপেক্ষা উত্তম।’ (সহিহ বুখারি-২৮৯২)।

——————————————————————————————————

অপর হাদিসে তিনি ইরশাদ করেন, ‘ যে ব্যক্তি নিজের সম্পদ রক্ষায় মারা যায় সে শহীদ, যে ব্যক্তি ধর্ম রক্ষায় মারা যায় সে শহীদ, যে ব্যক্তি নিজের প্রাণ রক্ষায় মারা যায় সে শহীদ, যে ব্যক্তি তার পরিবার-পরিজনের নিরাপত্তা রক্ষায় মারা যায় সে শহীদ।’ (তিরমিজি-১৪২১)।

ইসলাম প্রতিটি মানুষের চিন্তাচেতনা ও বিবেকবুদ্ধির স্বাধীনতা প্রদান করেছে। স্বাধীনতা প্রদান করেছে প্রত্যেকের মত প্রকাশ, ভৌগোলিক অবস্থান এবং শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে। ইসলাম আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীত ধর্ম, তা সত্ত্বেও মহান প্রভু সব মানুষকে আপন আপন বিবেকের চাহিদা অনুযায়ী এ বিশ্বে যে কোনো ধর্ম গ্রহণের স্বাধীনতা প্রদান করেছেন। তিনি ঘোষণা করেন, ‘ধর্ম গ্রহণের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই।’ (সুরা বাকারা-২৫৬)।

ইসলাম যেভাবে ধর্ম গ্রহণের ক্ষেত্রে বিবেকের স্বাধীনতা প্রদান করেছে, এভাবে সবকিছুতে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে। হাদিসের কিতাবে সুপ্রসিদ্ধ একটি ঘটনা, মহানবী (সা.) জনৈক মহিলা বারিরা (রা.)-কে তাঁর স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ থেকে বারণ করেছিলেন। বারিরা (রা.) রসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে জানতে চান, এটা কি আপনার নির্দেশ নাকি পরামর্শ। রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, নির্দেশ নয়, বরং পরামর্শ। বারিরা (রা.) উত্তর দেন, তাহলে আপনার পরামর্শমূলক অভিমত গ্রহণ করা ও না করার ক্ষেত্রে আমি স্বাধীন। (সহিহ বুখারি-৫২৮৩)।

স্বাধীনতা একজন মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার প্রথম অধিকার। মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে নিয়ে সর্ব প্রকার স্বাধীনতাকে ইসলাম অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে। রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সারা জীবনের মৌলিক উদ্দেশ্যের অন্যতম ছিল মজলুম জনতার স্বাধীনতা অর্জন করা এবং আল্লাহর সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ত করা।

তিনি আজ থেকে প্রায় ১৫০০ বছর আগে আইয়ামে জাহেলিয়াতের অন্ধকার ও পরাধীনতা দূর করে মদিনা নগরীতে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মদিনাকে স্বাধীন করেছিলেন ইহুদিদের কবল থেকে। স্বাধীন রাষ্ট্রের ভিতকে মজবুত করার জন্য মদিনা ও পার্শ¦বর্তী অঞ্চলের মুসলমান, ইহুদি ও পৌত্তলিকদের নিয়ে সব জাতি ও সম্প্রদায়ের মানবিক ও ধর্মীয় অধিকারকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদন করেন, যা ‘মদিনা সনদ’ নামে প্রসিদ্ধ।

একটি স্বাধীন কল্যাণ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এটিই পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান। মহানবী (সা.) সুদীর্ঘ ১৩টি বছর মক্কায় পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ ছিলেন। মদিনায় ১০ বছর অবস্থানের পর সব রকম অন্যায়-অনাচার, দুর্নীতির প্রাচীর ভেঙে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গোটা আরবে ঐতিহাসিক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র।

এ পরিসরে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনার দাবি রাখে। স্বাধীনতা বলতে জুলুম-অত্যাচার ও শোষণমুক্ত একটি পরিবেশে আপন আপন আত্মমর্যাদা নিয়ে ধর্ম, কর্ম পালন করার সুষ্ঠু ব্যবস্থাকে বোঝায়। সব ধরনের স্বায়ত্তশাসন ও স্বেচ্ছাচারিতাকে বিলুপ্ত করে আপন আপন চিন্তাচেতনা বাস্তবায়নের সুযোগ প্রবর্তন হওয়াকে স্বাধীনতা বোঝায়। যা একটি জাতি, দেশ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে বিশেষ অবস্থাকে বোঝায়, যেখানে তাদের নিজস্ব শাসনব্যবস্থা ও আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব থাকবে।

অতএব স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। যা খুশি তা করা নয়। শান্তি-শৃঙ্খলা ও রাষ্ট্রীয় বিধিবিধানকে জলাঞ্জলি দেয়া এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার নাম স্বাধীনতা নয়। নয় মহান প্রভুর বিধিনিষেধ অবজ্ঞা করা ও তাঁর প্রতি দৃষ্টতা প্রদর্শনের স্বাধীনতা।

লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা, ঢাকা

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!