ময়নাতদন্তের বেহাল চিত্র : হত্যা হয়ে যায় আত্মহত্যা

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, এপ্রিল ১৯, ২০২২
  • 357 পাঠক

নিজস্ব প্রতিনিধি

—————

সারাদেশের ময়নাতদন্তেরর চিত্র সুখকর নয়। গত কয়েক বছরে অন্তত ২৪টি ঘটনার রহস্য উন্মোচনের আগ পর্যন্ত ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে আত্মহত্যা এবং চূড়ান্ত অভিযোগপত্রে আত্মহত্যা উল্লেখের কারণে ভয়ংকর খুনিরা আড়ালেই ছিলেন দীর্ঘ সময়।

সম্প্রতি ময়নাতদন্তে মৃত্যূর কারণ কেন পাল্টে যায়, সারাদেশে ফরেনসিক বিভাগের কেন এমন বেহাল দশা? আবার কীভাবেই বা এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব ? সে সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে খোদ ‘পিবিআই’।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে পুলিশ সদর দফতরের মাধ্যমে ৭২ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে পুলিশের এই বিশেষায়িত ইউনিটটি। তাতে রয়েছে ১১টি সুপারিশমালা।

এ বিষয়ে পিবিআইর প্রধান, অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ‘আত্মহত্যা’ উল্লেখ করা অন্তত ২৪টি ঘটনায় তদন্তকারী কর্মকর্তা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। তবে আদালতের নির্দেশে পিবিআই পুনঃতদন্ত করতে গিয়ে পেয়েছি তা হত্যাকান্ড ছিল। এ জন্য ময়নাতদন্তের প্রকৃত চিত্র উল্লেখ করে এবং এর থেকে উত্তরণের সুপারিশ দিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছি আমরা। এই প্রতিবেদনটি পুলিশ সদর দফতরে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

——————————————

 পিবিআইর ১১ দফা সুপারিশ

—————————————–

দেশের চলমান ময়নাতদন্ত কার্যক্রমের চিত্র তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, সুরতহাল, ময়নাতদন্ত ও ভিসেরা কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে।

মেডিকেল কলেজগুলোতে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসকদের কাজ করার আগ্রহ কম এবং অধিকাংশ স্থানে ‘ জোড়াতালি ’ দিয়ে ময়নাতদন্ত করা হয়। চিকিৎসা শিক্ষায়ও এ শাখাটি অত্যন্ত অবহেলিত। মর্গগুলোতে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ, আলোর ব্যবস্থা, আধুনিক অবকাঠামো ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির অভাব আছে।

বর্তমানে অনেক জেলায় দিনের বেলায়ও মোমবাতি জ্বালিয়ে ময়নাতদন্ত করতে হয়। মর্গে পর্যাপ্ত দক্ষ জনবলের অভাব ও ময়নাতদন্ত বিষয়ে মর্গ সহকারী বা ে ডোমদেও কোনো মৌলিক প্রশিক্ষণ নেই। এ ছাড়াও ঢাকাসহ ব্যস্ত মর্গগুলোতে ডোম স্বল্পতাও অত্যন্ত প্রকট। লাশ সংরক্ষণে পরিবেশ ও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার অভাব আছে।

লাশের বিভিন্ন নমুনা বা ভিসেরা সংরক্ষণে মর্গগুলোতে আলাদা কোনো জায়গা নেই। এগুলো সংরক্ষণের জন্য কনটেইনার বা প্রিজারভেটিভ বা রাসায়নিক সরবরাহ অপ্রতুল। ফলে আলামত নষ্ট হওয়ার প্রবণতা বেশি। সংগৃহীত নমুনা বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়। এসব ল্যাবরেটরি থেকে রিপোর্ট আসতেও বিলম্ব হয়। যেখানে সমন্বিত ব্যবস্থাপনার অভাবের কথাও বলছে পিবিআই।

বিদেশি নাগরিকদের লাশ প্রচলিত নিয়মে হিমঘরে সংরক্ষণ করার প্রয়োজন পড়ে। অল্প সংখ্যক মর্গে ফ্রিজিং বা মর্চুয়ারি কুলার সিস্টেম থাকলেও সেগুলো প্রায়ই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর কারণে গরমে লাশ দ্রæত পচন ধরে। এ প্রক্রিয়াগুলো রক্ষণাবেক্ষণের কোনো ব্যবস্থাপনা বা তাগাদা নেই।

ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার ৯টি সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকদের একটি বৃহৎ অংশের যথাযথ ফরেনসিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেই। ব্যস্ত মর্গগুলোতে লাশের সংখ্যার আধিক্যের কারণে পর্যাপ্ত সময় না দিয়ে তাড়াহুড়ো করে ময়নাতদন্ত কাজ সম্পাদন করা হয়।

ময়নাতদন্ত সম্পাদনের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ও হিমাগারসহ স্থাপনা কিংবা অবকাঠামো প্রকট। ময়নাতদন্তের কাজে সহায়তাকারী মর্গ অ্যাসিসট্যান্ট বা ডোমের স্বল্পতা ও নিয়োগে সুনির্দিষ্ট নিয়োগবিধি নেই। মর্গ অ্যাসিসট্যান্টদেও মৌলিক ও ঝালাই প্রশিক্ষণের অভাব এবং তাদের ওপর ময়নাতদন্তকারী কর্মকর্তাদের অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা বিদ্যমান।

জটিল ও চাঞ্চল্যকর লাশের ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রে বোর্ড গঠন করে ময়নাতদন্ত করা হয় না। ভিসেরা পরীক্ষার জন্য আলামতসমূহ যথাযথ সংরক্ষণে সুবিধা নেই। বিজ্ঞ আদালতে সাক্ষী হওয়ার অনীহায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের অনেকেই ময়নাতদন্ত কাজে অংশ নিতে চান না। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রেরণে অস্বাভাবিক বিলম্ব করা হয়।

বেহাল অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ১১ দফা সুপারিশমালায় পিবিআই বলছে, একটি হত্যাকান্ডের প্রাথমিক তদন্ত থেকে শুরু করে বিচারকাজ চলা পর্যন্ত ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একসময় লাশের ময়নাতদন্ত দিনের আলোয় করার বাধ্যবাধকতা ছিল, এখন বৈদ্যুতিক আলোতে তা করা হয়।

কিন্তু কার্যক্রমের দিক থেকে বছরের পর বছর লাশ কাটা ‘অন্ধকারে’ রয়ে গেছে। ময়নাতদন্তের জন্য নির্ধারিত চিকিৎসকদের কোনো বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। যেসব জেলা শহওে মেডিকেল কলেজ নেই, সেসব শহরে আরএমও বা মেডিকেল অফিসাররা ময়নাতদন্ত করে থাকেন; তাদের প্রায় সবার এ বিষয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকে না।

পিবিআই বলছে, জেলা হাসপাতালগুলোতে ময়নাতদন্তের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বা অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় আলাদা পদ তৈরি বা সমন্বয় করে আগ্রহী চিকিৎসকদের বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ দিয়ে ওই পদের বিপরীতে পদায়ন করা যেতে পারে। তারা ময়নাতদন্তের বাইরে হাসপাতালের স্বাভাবিক সেবায় নিয়োজিত থাকবেন এবং সাধারণ নিয়মে পদোন্নতি পাবেন।

ময়নাতদন্তের চিকিৎসকরা অধিকাংশ সময়ে ডোমদের সহায়তা নিয়ে থাকেন। ডোমরা লাশ ময়নাতদন্তের জন্য প্রস্তুত করে এবং পুনরায় নির্ধারিত স্থানে লাশ সংরক্ষণ করে। তবে তাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই। অভিজ্ঞতা দিয়ে তারা কাজ শেখেন।
সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের সহায়তা করার জন্য দুটি করে ডোমের পদ আছে।

তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে একজন অনুপস্থিত বা ডেপুটেশনে অন্য বিভাগে কর্মরত থাকেন। এ ছাড়া দেশের মর্গগুলোতে নারী লাশ ময়নাতদন্ত করার জন্য নারী মর্গ সহকারী নেই। সব ক্ষেত্রেই পুরুষ মর্গ সহকারীদের মাধ্যমে ময়নাতদন্ত হয়, যা নৈতিকতার দৃষ্টিতে আপত্তিকর।

ময়নাতদন্ত স্বচ্ছরূপে সম্পাদন ও লাশ সংরক্ষণের জন্য প্রতিটি হাসপাতালে একজন মর্গ ইনচার্জেও নেতৃত্বে নারীসহ পর্যাপ্ত মর্গসহকারী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীর পদ থাকা প্রয়োজন বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা, পানিতে ডুবে, সাপে কামড়ানো ইত্যাদি মৃত্যু ছাড়া ফাঁসি, বিষ প্রয়োগ, আগুনে দগ্ধ ইত্যাদি সন্দেহজনক মৃত্যুর কারণ নির্ধারণে ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রে একাধিক বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে বোর্ড গঠন করে ময়নাতদন্ত করারও সুপারিশ করা হয়।

যেসব ক্ষেত্রে বাদীর অভিযোগ বা প্রাথমিক তদন্তের ফলাফলের সঙ্গে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক বা রাসায়নিক পরীক্ষকের মতামত ভিন্নরূপ হয়, সে ক্ষেত্রে বিশেষ বোর্ড স্থাপন করে চূড়ান্ত মতামত দেয়ারও সুপারিশ করা হয়। আবার সুরতহাল প্রতিবেদনে কোন বিষয়গুলো প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ, কোনগুলো অপ্রাসঙ্গিক সেগুলোর বিষয়ে সুরতহাল প্রস্তুতকারী পুলিশ সদস্যদের প্রাথমিক করণীয়, প্রতিবেদনে ব্যবহৃত শব্দ ও শব্দগুচ্ছের ব্যাখ্যা ইত্যাদি সম্পর্কে মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের মাধ্যমে পুলিশ সদস্যদের নিয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ বা সেমিনার আয়োজনের সুযোগ সৃষ্টি করার কথাও বলা হয়।

এ ছাড়া অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ময়নাতদন্ত ও ভিসেরা রিপোর্টেও ক্ষেত্রে অভিন্ন নীতিমালা ও কবর থেকে লাশ উত্তোলনের জন্য নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়।

পাশাপাশি আদালতের প্রয়োজনে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের ভার্চুয়াল সাক্ষ্য প্রদানের বিষয়টিও বিবেচনা করার কথা উল্লেখ করে মেডিকেল কলেজগুলোর সঙ্গে আদালতের আইটি বিভাগের সমন্বয় সাধনের পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয় সুপারিশে। ময়নাতদন্ত বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। একাডেমিক সাইড থেকে এটা একটি স্পেশালাইজড জব। কিন্তু আধুনিকতার জায়গাটায় এখনো আসেনি।

তবে ময়নাতদন্তের বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে নেয়া উচিত। তারাই দেশব্যাপী প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসক এবং তাদের সহকারী নিয়োগ দেবে। তাদের উচ্চতর প্রশিক্ষণসহ সব বিষয়াদি দেখভাল করবে। নয়তো এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটার অবকাশ রয়েছে বলে মন্তব্য এই বিশেষজ্ঞের।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!