জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির আলোচনা এখন সরকারি টেবিলে

  • আপডেট সময় সোমবার, জুলাই ১১, ২০২২
  • 311 পাঠক

দিশারী রিপোর্ট
———-

নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দামের মধ্যেই জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির আলোচনা এখন সরকারি টেবিলে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম অত্যধিক বাড়ায় দেশের বাজারেও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সর্বশেষ বৃহস্পতিবার ইঙ্গিত দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী।

তিনি বলেছেন, আমরা বলে আসছি প্রথম থেকেই যে তেলের দামে অ্যাডজাস্টমেন্টে যাবো। আমরা নিজেদের অর্থে দিয়ে যাচ্ছি ভর্তুকিটা। অন্যদিকে আগামী মাসে বাড়ানো হতে পারে বিদ্যুতের দামও। তবে কত বাড়বে তা নিয়ে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) পর্যালোচনা চলছে।

বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে গণশুনানি হলেও খুচরা কোম্পানিগুলোও দাম বাড়ানোর প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে বলে কমিশনের একজন সদস্য জানিয়েছেন।

গত ৭ জুলাই গণমাধ্যমে পাঠানো এক অডিও বার্তায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ আন্তর্জাতিক বাজারে দাম অত্যধিক বাড়ায় দেশের বাজারেও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন। এর আগেও ১৪ই জুন এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে একই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি।

অডিও বার্তায় প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা লক্ষ্য করছি প্রায় ৬ থেকে ৭ মাস ধরে প্রচণ্ডভাবে ঊর্ধ্বগতি চলছে তেলের মূল্যের। যে তেল আমরা ৭০ থেকে ৭১ ডলারে কিনতাম সেটা এখন ১৭১ ডলার হয়ে গেছে। সেটা সব সময় বাড়তির দিকেই যাচ্ছে।

আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি যে, তেলের দামে অ্যাডজাস্টমেন্টে যাবো। আমরা নিজেদের অর্থে দিয়ে যাচ্ছি ভর্তুকিটা। তার পরও আমার মনে হয়, আমাদের একটা সময় প্রাইসে অ্যাডজাস্টমেন্টে যেতে হবে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তেলের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। তেলের দাম তারা সমন্বয় করেছে।

ভারতের কথাই বলি-পার্শ্ববর্তী দেশ। তাদের প্রায় ৩৫ থেকে ৫০ টাকা ডিফারেন্স লিটারপ্রতি বিভিন্ন তেলের ক্ষেত্রে। গ্যাস দিয়ে আমাদের ৬৪ শতাংশ বিদ্যুৎ চলে। আমাদের নিজস্ব যে গ্যাস আমরা দিন দিন বাড়াচ্ছি আবার দিন দিন কমছেও। দুটো দিকই আছে। আমরা বাড়াচ্ছি, খনিগুলো থেকে আমরা পাচ্ছি, সেটা স্বল্প পরিমাণে পাচ্ছি। আর যেটা কমছে সেটা কমছে দ্রুত গতিতে। সেটাও আমরা প্রায় ১০ বছর থেকে বলে আসছি, আস্তে আস্তে গ্যাস কিন্তু ডিকলাইনের দিকে যাবে।

নসরুল হামিদ আরও বলেন, সেটা বড় কথা না, বড় কথা হলো- আমরা যে অ্যাডজাস্টমেন্টটা করতাম, যে ঘাটতিটা ছিল গ্যাসে সেটা আমরা ইমপোর্ট গ্যাস দিয়ে পূরণ করতাম। এর মধ্যে আমার দু’টি ধারা, একটি হলো লংটার্ম কনট্যাক্ট, সেই প্রাইসটা ফিক্স করা। তুলনামূলক এই দামটা তেলের সঙ্গে ওঠানামা করে। আরেকটা হলো- স্পট মার্কেট। এই মার্কেটের ডিমান্ড বেড়ে গেছে প্রচণ্ডভাবে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তেল এবং গ্যাসের দাম প্রচণ্ডভাবে এফেক্ট করেছে।

এদিকে করোনা মহামারির মন্দা অর্থনীতির মধ্যে আবারো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি র দাম বাড়লে সব কিছুতেই এর প্রভাব পড়বে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা আরও নাভিশ্বাস হয়ে ওঠবে। ইতোমধ্যে গ্যাসের দাম বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে ভোক্তা অধিকার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠন ও বিশেষজ্ঞদের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও জ্বালানি তেলের দাম লিটারপ্রতি ১০ থেকে ৩০ টাকা বাড়াতে পারে সরকার। যদি অর্থ মন্ত্রণালয় ভর্তুকি দেয় তাহলে নাও বাড়তে পারে জ্বালানি তেলের দাম।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বলছে, প্রতিদিন জ্বালানি তেলে তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। তারাও পেরে উঠতে পারছে না।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মানুষ যখন তীব্র মূল্যস্ফীতির সঙ্গে টিকে থাকার সংগ্রাম করছে, তখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে আবারো বাড়বে পরিবহন ব্যয়। পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণে বাজারে নিত্যপণ্যের দামও বাড়বে। কৃষি, শিল্প উৎপাদনসহ তেলের মূল্য বৃদ্ধি হলে অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলবে বলেও আশঙ্কা করছেন ভোক্তা এবং অর্থনীতিবিদরা।

করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি যেমন থমকে গিয়েছিল, একইভাবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আয়ের ওপরও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন, অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়েছে। ফলে আয় কমে এসেছে দেশের একটি বড় অংশের মানুষের। যদি জ্বালানি তেলের দাম আবার বাড়ানো হয় তাহলে সাধারণ মানুষের ওপর বিপর্যয় নেমে আসবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে জ্বালানি বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা গত ২৭শে জুন পরিবহন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দামের অস্থিতিশীলতার কারণে জুনে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) প্রতিদিন গড়ে ১০০ কোটি ১৮ লাখ টাকা করে লোকসান করছে।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো ছাড়া তাদের কাছে আর কোনো বিকল্প নেই। জ্বালানি তেলের দাম ১০, ২০ অথবা ৩০ টাকা বাড়ানো হলে পরিবহন খরচ কত বাড়তে পারে, বৈঠকে এ সংশ্লিষ্ট একটি বর্ণনা উপস্থাপন করা হয়।

গত নভেম্বরে ডিজেলের দাম প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর ফলে সরকার কত টাকা দাম বৃদ্ধি করেছিল, তার ওপর ভিত্তি করে এই প্রাক্কলন করা হয়েছে। ওই উপস্থাপন বলছে, যদি ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ১০ টাকা বাড়ানো হয়, তাহলে ঢাকা ও চট্টগ্রামে স্বল্প দূরত্বের বাস ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ২ টাকা ১৫ পয়সা থেকে বেড়ে ২ টাকা ২৩ পয়সা হবে। দূরপাল্লার বাসের ক্ষেত্রে ১ টাকা ৮০ পয়সা থেকে বেড়ে ১ টাকা ৮৯ পয়সা হবে। একইভাবে, ডিজেলের দাম ২০ ও ৩০ টাকা বাড়ানো হলে পরিবহন খরচ প্রতি কিলোমিটারে যথাক্রমে ১৬ পয়সা ও ২৪ পয়সা করে বাড়বে।

তবে, ভোক্তা অধিকার সংগঠনের মতে, পরিবহন সংস্থাগুলো কখনোই সরকারের নির্ধারিত ভাড়া মানে না। এতে যাত্রীদের অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েই যাতায়াত করতে হয়। মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, পরিবহন মালিকদের সঙ্গে এটি ছিল প্রাথমিক বৈঠক। তাদের সঙ্গে আরও বৈঠক হবে। কারণ তেলের দাম বাড়ালে পরিবহনগুলো অনেক বেশি ভাড়া আদায় করে। এতে দেশে নৈরাজ তৈরি হবে। এজন্যই পরিবহন মালিকদের সঙ্গে আরও বৈঠক হবে।

এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, বিপিসি বা জ্বালানি বিভাগের তেলের দাম নির্ধারণের কোনো এখতিয়ার নেই। কারণ বিপিসি নিজেই এখানে ব্যবসা করে। তাদের হিসাবনিকাশেও অনেক ধরনের চুরি ও গোঁজামিল রয়েছে।

ডিজেল ও কেরোসিনসহ জ্বালানির মূল্য নির্ধারণে প্রশাসিনক প্রতিকার না পেলে উচ্চ আদালতের দারস্থ হবে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। জ্বালানি বিভাগ এবং বিপিসি অবৈধভাবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ালে ক্যাব মানবে না।

অন্যদিকে, বিদ্যুতের দাম বাড়াতে গত মে মাসে গণশুনানি সম্পন্ন করেছে বিইআরসি। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে বিইআরসি’র কারিগরি কমিটি সুপারিশও করেছে। বিইআরসি’র টেকনিক্যাল কমিটি ২ দশমিক ৯৯ টাকা বাড়ানোর সুপারিশ করে। অর্থাৎ প্রায় ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে ওই কমিটি। নিয়ম অনুযায়ী শুনানির পরবর্তী তিন মাসের মধ্যেই দাম বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

এ বিষয়ে বিইআরসি’র সদস্য মোহাম্মদ বজলুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী শুনানির পরবর্তী তিন মাসের মধ্যেই দাম বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কমিশন পর্যালোচনা চলছে। ন্যূনতম বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে কমিশন চেষ্টা করবে। তবে কত বাড়বে তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

গত ১৮ মে বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর বিষয়ে শুনানি হয়েছে।ইতোমধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুতর দাম বাড়ানোর দিকেই এগোচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। ভোক্তা সংগঠনগুলো বলছে, এই মুহূর্তে দাম বাড়ানো হলে তা জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কোনোভাবে দাম বাড়ানো যৌক্তিক হবে না। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের ওপর শুনানিতে অংশ নিয়ে গ্রাহকরা দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করেন।

পাইকারিভাবে বিদ্যুতের দাম ৩ টাকা ৩৯ পয়সা বাড়িয়ে ৮ টাকা ৫৬ পয়সা করার প্রস্তাব করেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। এতদিন সরকার ৩ টাকা ৩৯ পয়সা ভর্তুকি দিয়ে আসছিল। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রস্তাব গ্রহণ করলে সরকারের আর ভর্তুকি দেয়ার প্রয়োজন পড়ছে না।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) বর্তমান দর ইউনিট প্রতি ৫.১৭ টাকা থেকে ৬৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৮.৫৮ টাকা করার প্রস্তাব করেছে। বিপিডিবি’র এই প্রস্তাব গ্যাসের বর্তমান দর বিবেচনায়।

বিইআরসি সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিদ্যুতের পাইকারি দর ইউনিট প্রতি ৫.১৭ টাকা নির্ধারণ করে। বিদ্যুতের একক পাইকারি বিক্রেতা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। বিপিডিবি’র পাইকারি দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, চাহিদামতো গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে খরচ বেড়ে গেছে।

২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদ্যুতে গড় উৎপাদন খরচ ছিল ২.১৩ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.১৬ টাকায়। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, কয়লার মূসক বৃদ্ধির কারণে ২০২২ সালে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন খরচ দাঁড়াবে ৪.২৪ টাকায়। পাইকারি দাম না বাড়লে ২০২২ সালে ৩০ হাজার ২৫১ কোটি ৮০ লাখ টাকা লোকসান হবে বিপিডিবি’র।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!