ডেস্ক, দৈনিক দিশারী
———————
নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার কলেজপাড়া এলাকার বাসিন্দা ৭৮ বছর বয়সী লালনি কান্ত ২০২১ সালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে নওগাঁ সদর হাসপাতালে ভর্তি হন। শাররিক অবস্থার অবনতি হলে ডাক্তাররা তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেয়ার পরামর্শ দেন। নওগাঁ সদর হাসপাতালে আইসিইউ না থাকায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথেই মারা যান লালনি কান্ত।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর থেকেই সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁয় সংক্রমণ, রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু বেড়েছিল। তখন আইসিইউ নির্মাণে নওগাঁ সদর জেনারেল হাসপাতালে দুই শয্যার জন্য সরঞ্জাম পাঠায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু সেসব এখনো রয়েছে বাক্সবন্দি অবস্থায়। ওই সময় করোনা ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক শাপলা খাতুন জানিয়েছিলেন, আইসিইউ সুবিধা না থাকায় অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রেই কিছু করার থাকছে না, মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।
দেশের হাসপাতালগুলোয় আইসিইউর অভাব প্রকট আকারে ধরা পড়ে করোনাকালে। আইসিইউতে শয্যা পাওয়ার জন্য সেখানে থাকা কারও মৃত্যু অথবা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে অন্য রোগীদের। করোনার দৌরাত্ম্য কমলেও আইসিইউর অভাব আবার বোঝা যায় গত বছর ডেঙ্গুর প্রকোপের সময়।
মিরপুর থেকে আট মাসের সাফওয়ান ভর্তি ছিল বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে (শ্যামলী শিশু হাসপাতাল)। সাফওয়ানের অবস্থা জটিল হওয়ায় তাকে আইসিইউতে নিতে বলেন চিকিৎসক। শিশু হাসপাতালের আইসিইউতে শয্যা ফাঁকা ছিল না। বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়ার মতো আর্থিক অবস্থাও ছিল না সাফওয়ানের পরিবারের। শেষ পর্যন্ত তাকে সাধারণ ওয়ার্ডেই চিকিৎসা নিতে হয়।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, সরকারি হাসপাতালে মোট শয্যার ১০ শতাংশ আইসিইউ থাকতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ যেন সোনার হরিণ। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৩৪টি সদর হাসপাতালে আইসিইউ নেই। করোনাকালে আইসিইউর জন্য যখন দেশজুড়ে হাহাকার, তখন ২০২০ সালের ২ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ দেন। আড়াই বছর পার হলেও সে নির্দেশনা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। আইসিইউ থাকা হাসপাতালের অনেকগুলোতে নেই পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল। স্বাস্থ্য অধিপ্তর বলছে, তারা দক্ষ জনবল নিয়োগের চেষ্টা করছে। তবে একটু সময় লাগবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে আইসিইউ শয্যা রয়েছে ১ হাজার ৬৯টি। এর মধ্যে ঢাকায় ৮৩৬টি আর ঢাকার বাইরে ২৫৭টি।
ঢাকার কী অবস্থা :
দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজারের বেশি রোগী ভর্তি থাকে এই হাসপাতালে। ভর্তি থাকা এবং বহির্বিভাগের রোগীদের মধ্যে অনেকেরই আইসিইউ দরকার হয়। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের ভরসাস্থল এই হাসপাতালে আইসিইউ বেড আছে মাত্র ২৩টি। যার মধ্যে একটি নষ্ট।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিটে যত রোগী ভর্তি থাকেন, অপেক্ষায় থাকেন তার চাইতে কয়েক গুণ বেশি রোগী।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন চিকিৎসক কয়েক মাস আগে বলেন, ‘প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৭টার মধ্যে এখানে আসি, দুপুর ১টার পর ফেরত যাচ্ছি। আমি চিকিৎসক। অধ্যাপক আব্দুল্লাহ স্যার (বিএসএমএমইউর মেডিসিন বিভাগের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ) নিজে লিখে দিয়েছেন একটা আইসিইউ বেডের জন্য। অথচ আমি গত সাত দিন ধরে এখানে এসে আইসিইউ পাচ্ছি না।’
জেলায় জেলায় আইসিইউ সংকট :
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের সবচেয়ে বড় হাসপাতালগুলোয় আইসিইউয়ের যে সংকট সেখানে জেলা সদর হাসপাতাল তো আরও দূরের কথা।
ঢাকা বিভাগের মোট ১৩টি জেলার মধ্যে ছয় জেলার কোনো হাসপাতালেই আইসিইউর ব্যবস্থা নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঢাকার বিভাগীয় পরিচালক ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা বলেন, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, নারায়ণগঞ্জে আইসিইউ ইউনিট তৈরি হচ্ছে। রাজবাড়ি ও নরসিংদীতে হবে, শরীয়তপুরে এখনই হচ্ছে না।
মাদারীপুর সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘মাদারীপুর জেলা সদর হাসপাতালে এত দিন আইসিইউ ছিল না। তবে নতুন ভবন তৈরি হচ্ছে, সেখানে আইসিইউ রাখা হবে। শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক বলেন, তাদের হাসপাতালে আইসিইউ করার মতো জায়গাই নেই।
চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলার মধ্যে তিন পাবর্ত্য জেলায় আইসিইউ নেই। দেশের ৬৪ জেলায় আইসিইউ স্থাপনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কথা স্মরণ করিয়ে দিলে বিভাগীয় পরিচালক ডা. সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ‘এটা চলমান প্রক্রিয়া। আর আইসিইউ একটি প্রকল্পের অধীনে নির্মাণ হচ্ছে, সেখানে কিছু সমস্যা হওয়ায় সব জেলায় এখনো আইসিইউ নেই।’ তিনি বলেন, ‘নোয়াখালী জেলায় স্থাপিত হওয়া আইসিউ এখনো চালু হয়নি আর লক্ষ্মীপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এখনো প্রস্তুত হয়নি।’
ময়মনসিংহ বিভাগের চার জেলার মধ্যে আইসিইউ রয়েছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং জামালপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বাকি নেত্রকোনা ও শেরপুরে আইসিইউ নেই।
ময়মনসিংহয়ের বিভাগীয় পরিচালক ডা. মো. শফিউর রহমান বলেন, ময়মনসিংহ ও জামালপুরের দুই হাসপাতালের আইসিইউতে জায়গা না পেলে রোগীরা ঢাকা অথবা বেসরকারি হাসপাতালে যেতে বাধ্য হয়, অপেক্ষায় থাকতে হয় একটি বেড ফাঁকা হওয়ার জন্য।
নেত্রকোনা ও শেরপুর জেলায় আইসিইউ হয়নি কেন প্রশ্ন করলে শফিউর রহমান বলেন, ‘এটা আমি বলতে পারব না। সিদ্ধান্ত হয় কেন্দ্র থেকে, এটা তাদের সিদ্ধান্ত বা উদ্যোগ।’
বরিশাল বিভাগের ছয় জেলার মধ্যে বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলায় আইসিইউ রয়েছে। ভোলা, ঝালকাঠি, বরগুনা ও পিরোজপুর জেলা হাসপাতালে আইসিইউ থাকলেও দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে তা চালু নেই বলে জানিয়েছেন বরিশাল বিভাগের বিভাগীয় পরিচালক ডা. হুমায়ূন শাহীন খান।
তিনি বলেন, ‘করোনার সময় এখানে আইসিইউ নির্মাণ করা হয়। সংযুক্তিতে লোকবল দেয়া হয়। কিন্তু করোনা চলে যাবার পর চুক্তি বাতিল হলে তারা নিজ নিজ কর্মস্থলে ফেরত যান।’
বরিশালের সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, ‘হাসপাতালে ১২ শয্যার আইসিইউ ইউনিট আছে। কিন্তু সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, প্রয়োজনীয় নার্স এবং অন্য জনবল নেই।’
এই চিকিৎসক বলেন, ‘আইসিইউর ডাক্তার-স্টাফ কিছুই আমাদের নেই। আইসিইউ ব্যবস্থাপনা নিয়ে একজন অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের সাত দিনের প্রশিক্ষণ রয়েছে তাকেই আমরা আইসিইউ চিকিৎসক মনে করি।’
সিলেট বিভাগের চার জেলার মধ্যে শুধু ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউ রয়েছে। মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলায় আইসিইউ নেই।
সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন আহম্মদ হোসেন বলেন, ‘আইসিইউ নেই এখানে। কাজ চলছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক বলেন, ‘সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতালের তৃতীয় তলার আইসিইউ ও সিসিইউ লেখা দুটি রুম রয়েছে। কিন্তু সে রুম আজ পর্যন্ত খোলা হয়নি।’
রাজশাহী বিভাগের আটটি জেলার মধ্যে রাজশাহী ও বগুড়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউ রয়েছে। নাটোর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, জয়পুরহাট, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে নেই। তবে জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর ও সিরাজগঞ্জে বর্তমানে কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন রাজশাহীর বিভাগীয় পরিচালক ডা. হাবিবুল্লাহ আহসান তালুকদার।
জয়পুরহাট জেলার সিভিল সার্জন ডা. ওয়াজেদ আলী বলেন, ‘আইসিইউর জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং যন্ত্রপাতি প্রস্তুত থাকলেও আধুনিক জেলা হাসপাতালে আইসিইউ চালু করার মতো জনবল নেই।’ তিনি বলেন, ‘গত তিন মাস আগে সবকিছু প্রস্তুত করা হলেও চিকিৎসকসহ অন্য জনবলের অভাবে আইসিইউ চালু করা যায়নি। ১০ শয্যার আইসিইউর জন্য কমপক্ষে আটজন অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট দরকার। কিন্তু আছেন মাত্র দুজন। কার্ডিওলজিস্টের প্রয়োজন থাকলেও তা নেই। জনবল সংকটের কথা জানিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কয়েকবার চাহিদাপত্র দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রধান সমস্যা হচ্ছে এখানে পদ তৈরি করতে হবে। সেটা হচ্ছে না।’
খুলনা বিভাগের ১০ জেলার মধ্যে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউ রয়েছে। এর বাইরে বিশেষায়িত শহীদ শেখ আবু নাসের হাসপাতালে আইসিইউ আছে। জেলা হাসপাতালগুলোর ভেতরে যশোর, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া এবং ঝিনাইদহে আইসিইউ রয়েছে। তবে এগুলো হয়েছে করোনার সময়। খুলনা ২৫০ শয্যা সদর হাসপাতাল, মাগুরা, বাগেরহাট এবং নড়াইল জেলা হাসপাতালে এখনো আইসিইউ নেই।
রংপুর বিভাগের আট জেলার মধ্যে শুধু রংপুর ও দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউ রয়েছে। কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী ও গাইবান্ধা জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ নেই।
২৫০ শয্যা ঠাকুরগাঁও আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. সাদাত শাহরীয়ার বলেন, ‘হাসপাতালে আইসিইউ প্রতিষ্ঠার জন্য জায়গা রয়েছে। কিন্তু সেখানে যন্ত্রপাতি, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্সসহ প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবলের অভাবে আইসিইউ করা যাচ্ছে না।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, করোনাকালে আমরা কাজ শুরু করেছি। কোথাও কোথাও তৈরি হয়েছে, আবার কোথাও তৈরি হচ্ছে। যেসব ঘাটতি রয়েছে সেগুলো পূরণ করতে চেষ্টা করছি। হয়তো সময় লাগবে, তবে আইসিইউ হয়ে যাবে।’
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার এত দিন পরও আইসিইউ প্রস্তুত না হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যান্ডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস প্রকল্পের পরিচালক ডা. শাহ গোলাম নবী তুহিন বলেন, ‘আমাদের ১০টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ চলতি জানুয়ারির মধ্যে চালু হয়ে যাবে। সঙ্গে যে জেলাগুলোতে আইসিইউ হবার কথা, তার মধ্যে ১৩টি জেলা হাসপাতালের আইসিইউ একদম রেডি হয়ে যাবে। বাকি জেলাগুলোতে আইসিইউর জন্য ভবন প্রস্তুত করছে গণপূর্ত বিভাগ। ভবন প্রস্তুত হলে কেনাকাটা শুরু করে দেব।’
Leave a Reply