সব খরচ বাড়ছে, মানুষের দামই কমছে

  • আপডেট সময় রবিবার, জানুয়ারি ১৫, ২০২৩
  • 170 পাঠক

তারিক চয়ন

————
নতুন বছরের একেবারে শুরুতে দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত কয়েকটি খবর বেশ চমকপ্রদ এবং একইসাথে খুব ভয়ঙ্কর। বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত এমন কয়েকটি খবরের দিকে চোখ বুলানো যাক।

===============

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

==============

১. দেশের শিক্ষা খাতে ব্যয়ের শতকরা ৭১ ভাগই বহন করতে হচ্ছে পরিবারগুলোকে! জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের যৌথ গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।

দক্ষিণ এশিয়ার শিক্ষায় বেসরকারি খাতের ভূমিকা-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে প্রস্তুত করা ইউনেস্কো গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট’ শীর্ষক তাদের প্রতিবেদন দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রকাশ করার ধারাবাহিকতায় গত ৩রা জানুয়ারি বাংলাদেশের রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান এবং প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।

প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরেন ইউনেস্কোর পরিচালক মানস এন্তনিস এবং ব্র্যাকের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যয়ের ৭১ শতাংশই বহন করে শিক্ষার্থীদের পরিবার। উল্টো করে লিখলে, বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যয়ের মাত্র ২৯ শতাংশ বহন করে সরকার। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়- শিক্ষা ব্যয় সবচেয়ে বেশি হয় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এসব প্রতিষ্ঠানে সরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় তিনগুণ শিক্ষা ব্যয় বহন করতে হয় অভিভাবকদের। বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনের ক্ষেত্রে এ ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় নয়গুণ।

‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’র মতো তথ্য হলো, পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানের ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল।

অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষার মান উন্নয়ন ছিল একথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে শিক্ষার মান বাড়ানো এবং জ্ঞানভিত্তিক নতুন শিক্ষাক্রম চালুর কথা বললেও শিক্ষায় সরকারি বরাদ্দ বাড়ানো বিষয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি। এসব নিয়ে প্রথম আলোর এক সম্পাদকীয়তে বেশ যৌক্তিকভাবেই লেখা হয়েছে। তাহলে সরকার এত ঢাকঢোল পিটিয়ে শিক্ষার উন্নয়নের যেসব ফিরিস্তি দিচ্ছে, তা শুভঙ্করের ফাঁকি কি-না, সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে যখন শিক্ষায় অভিভাবকের অতিরিক্ত ব্যয় বহনের খবর এসেছে, তখন শিক্ষা খাতে সরকারি বরাদ্দের একটি পরিসংখ্যানও নেয়া যেতে পারে। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা যখন শিক্ষা খাতে বাড়তি বরাদ্দের দাবি জানিয়ে আসছিলেন, তখন শিক্ষা খাতে বরাদ্দের হার ক্রমেই কমে যাওয়ার খবরটি খুবই উদ্বেগজনক। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিক্ষায় জিডিপির ৬ শতাংশ ব্যয় করা উচিত। বাস্তবে ব্যবহার করা হচ্ছে ২ শতাংশ। কোনো কোনো বছর তার চেয়েও কম।

২. দেশের স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় বছর বছর কমছে! এর বিপরীতে ব্যক্তিগত খরচ দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে স্বাস্থ্য ব্যয়ের তিন-চতুর্থাংশ ব্যক্তি নিজেই বহন করছেন। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট গত ৪ জানুয়ারি রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত এক কর্মশালায় ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস ১৯৯৭-২০২০’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী শেষ তিন বছরে অর্থাৎ ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে স্বাস্থ্য ব্যয়ে সরকারের অংশ ক্রমান্বয়ে কমেছে (যথাক্রমে ২৮, ২৬ ও ২৩ শতাংশ)। অন্যদিকে, ওই বছরগুলোতে চিকিৎসা করাতে গিয়ে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বেড়েছে (যথাক্রমে ৬৪, ৬৬ ও ৬৯ শতাংশ)।

ওই কর্মশালায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি, জনস্বাস্থ্যবিদ, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের নির্ধারিত আলোচক হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি বর্ধন জং রানা বলেন, মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৯ শতাংশ ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় হলে তা সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের পথে অন্তরায়।

অন্যদিকে মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে ইউনিসেফ ঢাকা কার্যালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান মায়া ভ্যানডেনেন্ট বলেন, ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বেশি হওয়ার অর্থ অনেকের জন্য তা বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয়। এই ব্যয়ের কারণে অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায় (সূত্র: প্রথম আলো)।

যদিও মায়া ভ্যানডেনেন্ট বলার আগেই এমন কথা আমরা বহুবার শুনেছি। গত বছরের ডিসেম্বরে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের পক্ষ থেকে দেয়া উপস্থাপনায় বলা হয়, বাংলাদেশে ২৪ দশমিক ৭ শতাংশ পরিবার বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয়ের মুখে পড়ছে। এই হার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

উল্লেখ্য, পারিবারিক আয়ের ১০ শতাংশের বেশি স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হলে তাকে বলা হয় বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয়। এই ব্যয় বেশি হলে অনেক মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়েন, অনেকে নিঃস্ব হয়ে যান। চিকিৎসা ব্যয় বেশি হলে মানুষ সেবা নেয়া থেকে বিরত থাকেন। ওদিকে, জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) হিসেবেও দেশে স্বাস্থ্যসেবার জন্য বরা গোটা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম। করোনা মহামারির সময় তো দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার করুণ চিত্র কমবেশি সকলেই প্রত্যক্ষ করেছেন। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে কী মাত্রার দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা প্রত্যক্ষ করতে হয় তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন।

৩. বাংলাদেশে গত ৪ বছরের মধ্যে ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির মাত্রা ছিল সর্বোচ্চ! শুধু তাই নয়, প্রতি বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনা, প্রাণহানি এবং আহতের সংখ্যা বাড়ছে। গত ৭ই জানুয়ারি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘রোড সেফটি ফাউন্ডেশন’ আয়োজিত ‘২০২২ সালের সড়ক দুর্ঘটনার বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ ও পর্যালোচনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়।

৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজপোর্টাল এবং ইলেক্টনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে সংস্থাটির তৈরি করা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে ০.৮৯ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ৪.২২ শতাংশ এবং আহত বেড়েছে ৩.৮৮ শতাংশ। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৩.৪৩ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ১৫.৭০ শতাংশ এবং আহত বেড়েছে ১.২০ শতাংশ।

২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে ২৭.১৪ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ২২.৭৪ শতাংশ এবং আহত বেড়েছে ৬৮.৯২ শতাংশ। আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করে তৈরি সংগঠনটির হিসেবে ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় যে পরিমাণ মানবসম্পদের ক্ষতি হয়েছে তার আর্থিক মূল্য ১৮ হাজার ৪৬ কোটি টাকার মতো। যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনার অনেক তথ্য অপ্রকাশিত থাকে, সেজন্য এই হিসেবের সাথে আরও ৩০% যোগ করতে হবে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে- গণমাধ্যমে যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, প্রকৃত ঘটনা তার চেয়ে ৩/৪ গুণ বেশি। এই বিবেচনায় এ বছর সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আমাদের জিডিপি’র ১.৫ শতাংশের বেশি হতে পারে।

গণমাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনায় ‘আহত’ কিংবা ‘নিহত’দের সংখ্যা প্রকাশিত হলেও ভুক্তভোগী পরিবার কিংবা তাদের প্রিয়জনদের কাছে তা নিছক কোনো সংখ্যা নয়। অনেকক্ষেত্রেই একেকটি দুর্ঘটনা একেকটি পরিবারকে আর্থিক বা মানসিকভাবে নিঃস্ব করে দিচ্ছে। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক বিভিন্ন সভা- সেমিনার-ওয়েবিনার-সিম্পোজিয়ামে এই প্রশ্ন উঠে আসছে যে, সড়কের এত উন্নয়ন করে কী লাভ যদি সড়কে মানুষের মৃত্যু দিন দিন বাড়তে থাকে? দেশে সবকিছুরই খরচ বাড়ছে, কেবল জীবনের দামটাই কি কমছে?

৪. ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের খুচরা মূল্য বাড়ানো হয়েছে। মাত্র কয়েক মাস আগে (গত আগস্টে) দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য এক লাফে প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। একবারে জ্বালানি তেলের দাম এমন নজিরবিহীনভাবে বৃদ্ধির কারণে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়েছে। এর প্রভাবে বাজারে সব জিনিসের দাম বেড়েছে, বেড়েছে পরিবহন খরচ। বেড়েছে বেশির ভাগ সেবার খরচও। এমনিতেই সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন স্বল্প আয়ের মানুষ। এরমধ্যে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন যে কতোটা দুরূহ করে তুলবে তা বলাবাহুল্য। গত বছর নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির খবর আলোচনার শীর্ষে ছিল।

১জানুয়ারি কালেরকণ্ঠে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী- গত এক বছরে বাজারে মোটা চাল ব্রি-২৮-এর দাম বেড়েছে ৪৪.৪৪ শতাংশ। এক বছর আগে যেখানে মোটা চাল বিক্রি হয়েছিল ৪৫ টাকা কেজি, সেটির দাম বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৬৫ টাকায়। এক বছরে খোলা আটার দাম বেড়েছে ৯১.১৭ শতাংশ। এক বছরে খোলা আটা ৩৪ টাকা কেজি থেকে বেড়ে ৬৫ টাকা হয়েছে।

অন্যদিকে, প্যাকেট আটার দাম কেজিতে ৩০ টাকা বেড়ে এখন ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তাছাড়া, গত বছর কয়েক দফায় বেড়েছে ভোজ্যতেলের দাম। ওই বছরের মাঝামাঝি সময়ে দেশে ভোজ্যতেলের সংকট ছিল। বছরে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ২৬.৬৬ শতাংশ। এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম যেখানে ছিল ১৫০ টাকা, এক বছরের ব্যবধানে তার দাম বেড়ে ১৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

গত এক বছরে খোলা চিনি কেজিতে ৭৫ টাকা থেকে বেড়ে ১২০ টাকায় (৬০ শতাংশ বেড়ে) বিক্রি হচ্ছে। মসুর ডাল খুচরা পর্যায়ে এক বছরে (৩৩.৩৩ শতাংশ বেড়েছে) ১০৫ টাকা কেজি থেকে বেড়ে ১৪০ টাকা হয়েছে। বছরের মাঝামাঝিতে মুরগি ও ডিমের দাম বেড়ে আগের সব রেকর্ড ভেঙে যায়। ব্রয়লার মুরগির কেজি হয়ে যায় প্রায় ২০০ টাকা ও সোনালি মুরগি কেজি ৩০০ থেকে ৩২০ টাকায় উঠে যায়। পাশাপাশি মুরগির ডিমেরও রেকর্ড দাম বৃদ্ধি পেয়ে ডজন ১৬০ টাকা হয়ে যায়।

সেদিন মুদি দোকানে এক রিকশাচালক ঢুকলেন। হাতে বেশ কয়েকটি চকচকে পাঁচশ’ টাকার নোট। সেদিকে ইঙ্গিত করে দোকানদার ঠাট্টার ছলে বলেন, ‘রিকশা চালিয়ে তো ভালোই ইনকাম তোমাদের। দোকানদারি করে আর পেট চালাতে পারছি না। জবাবে, রিকশাচালক বললেন, ‘ভাই। বহুত কষ্ট করি। বহুত টাহা কামাই। কিন্তু, টাহা আর থাহে না। সব খরচ হইয়া যায়। আগে অল্প ইনকাম ছিল। হেরপরও কিছু জমাইতে পারতাম। এহন টাহা আর থাহে না।’

কেবল ওই রিকশাচালকই নন, উঠতে-বসতে যতো মানুষের সাথেই আজকাল দেখা হয়, সবারই ওই এক কথা ‘এখন আর টাকা থাকে না’। বিগত ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের জিডিপি’র আকার দাঁড়িয়েছে ৩০ লাখ কোটি টাকারও বেশি। এ নিয়ে অনেকেই গর্ব করে বলেন, দেশ ভালো আছে। সে ঠিক আছে। জিডিপি বড় হওয়া মানে অর্থনীতি বড় হওয়া। তবে, দেশের সাধারণ মানুষ ভালো আছে কি-না তা কিন্তু জিডিপি দিয়ে বোঝা যায় না।

প্রথম আলোতে রাজীব আহমেদ এক সংবাদ বিশ্লেষণে বেশ চমৎকারভাবে বিষয়টি উদাহরণসহ ব্যাখ্যা দিয়ে লিখেছেন, ‘মানুষের অসুখও জিডিপি বাড়ায়, সড়ক দুর্ঘটনা জিডিপি বাড়ায়। ধরুন, আপনি হৃদ্রোগে আক্রান্ত হলেন। হৃদ্যন্ত্রে অস্ত্রোপচার করতে হবে। ব্যয় ৫ লাখ টাকা। আপনার সব সঞ্চয় শেষ হলো, জিডিপিতে যোগ হলো ৫ লাখ টাকা।’

তাছাড়া, পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেব বলছে: দেশের মানুষের সঞ্চয় কমছে। ৩ অর্থবছর আগে জাতীয় সঞ্চয় জিডিপি’র অনুপাতে ৩১ শতাংশের বেশি, যা কমতে কমতে সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরের সাময়িক হিসেবে ২৬ শতাংশের নিচে নেমেছে। কিন্তু একই সময়ে জিডিপি বেড়েছে। সুতরাং, জিডিপি দিয়ে মানুষে মানুষে যে বৈষম্য সেটা ধরা পড়ে না। সে কারণেই, ২০২১ সালের শুরুতে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর জরিপ থেকে ‘দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ’ পাওয়া গেলেও আমরা অবাক হইনি।

তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈশ্বিক সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ-এক্স ২০১৮ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর ‘ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৮’ নামে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, সেখানে দেখা যায়- অতি ধনী বা ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপানসহ বিশ্বের ৭৫টি বড় বড় অর্থনীতির দেশকে পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ! ওয়েলথ-এক্স নিজেরাও বিস্ময় প্রকাশ করে লিখেছিল ‘অতি ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বিশ্বে চীনের (১৭.৩ শতাংশ) অবস্থান এক নম্বরে নেই।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশ (১৩.৭ শতাংশ) সবার চেয়ে এগিয়ে।’ ওয়েলথ-এক্স’র ওই রিপোর্টের কিছুদিন আগেই করা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০১৬ অনুযায়ী, দেশে মোট আয়ের ৩৮ শতাংশই করেন উপরের দিকে থাকা ১০ শতাংশ ধনী।

অন্যদিকে, মোট আয়ের মাত্র ১ শতাংশ করেন সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষ! এখন তাই জিডিপি বাড়ানোর চেয়েও ধনী-দরিদ্রের মধ্যেকার বৈষম্য কমানোর দিকে নজর দেয়া বিশেষভাবে জরুরি। সেই সাথে শিক্ষা, চিকিৎসার মতো খাতগুলোতে সরকারি বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসমূহের মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টানা অতীব জরুরি।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!