বদলাচ্ছে অপরাধের ধরন

  • আপডেট সময় রবিবার, জানুয়ারি ২২, ২০২৩
  • 136 পাঠক

ডেস্ক রিপোর্ট

————
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণী। দেখতে সুন্দর ও স্মার্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকেই আরিফ নামের এক সিনিয়র বড় ভাই তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে আসছিলেন। বার বার তিনি প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। কিন্তু নাছোড়বান্দা আরিফ কৌশলে তাকে রাজি করান। দু’জন জড়ান প্রেমের সম্পর্কে। দিনে দিনে ঘনিষ্ঠতাও বাড়ে। একপর্যায়ে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে আরিফ তার সঙ্গে শাররিক সম্পর্ক করেন। একাধিকবার শাররিক সম্পর্কের পর হঠাৎ করে আরিফ যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। তরুণী অনেক চেষ্টা করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না।

কারণ ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ সকল যোগাযোগমাধ্যমে আরিফ তাকে ব্লক করে দেন। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন তরুণী দেখেন আরিফের মেসেঞ্জার থেকে তার কাছে কিছু ছবি ও ভিডিও এসেছে। সেগুলো তাদের শাররিক সম্পর্কের সময়ে ধারণ করা। ভিডিও পাঠানোর পর আরিফ তরুণীর কাছে ১ লাখ টাকা দাবি করেন। টাকা না দিলে ভিডিও পর্নোগ্রাফি সাইট ও তার বান্ধবী এবং পরিবারের কাছে পাঠনোর হুমকি দেন। উপায়ন্তর না পেয়ে তরুণী কষ্ট করে টাকা ম্যানেজ করে পাঠান।

এভাবে কিছুদিন পরপর আরিফ ভয়ভীতি দেখিয়ে সর্বমোট ৫ লাখ টাকা আদায় করেন। একসময় ওই তরুণীর পক্ষে টাকা দেয়া সম্ভব হচ্ছিলো না। পরে তিনি তার পরিবারের সঙ্গে আলাপ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন। সেই মামলায় পুলিশ আরিফকে গ্রেপ্তার করে।

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে সমাজ। পাল্টে গেছে অপরাধের ধরনও। ব্যবহার হচ্ছে অত্যাধুনিক অস্ত্র। অপরাধীরা জাল ফেলছে অনলাইন প্ল্যাটফরমে। সাইবার ক্রাইমসহ নিত্যনতুন অপরাধে জড়াচ্ছে তরুণরা। পুরাতন মাদকের পাশাপাশি নতুন নতুন মাদকের ব্যবহার বাড়ছে। সংঘবদ্ধ ও কিশোর অপরাধও বাড়ছে। এসব অপরাধ শনাক্তে হিমশিম খেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। এমনও কিছু অপরাধ ঘটছে যা আগে কখনো ঘটেনি।

শুধু অপরাধ নয়, এর সঙ্গে বাড়ছে অপরাধীর সংখ্যাও। অভাব-দরিদ্রতা, সুশিক্ষার অভাব, পরিবারের অবহেলা, সামাজিক পরিস্থিতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, রাজনৈতিক প্রভাবসহ বেশকিছু কারণ শনাক্ত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, খারাপ সঙ্গীদের সঙ্গে বেড়ে ওঠা, নৈতিক শিক্ষার অভাব, আইন না মানার প্রবণতা ও অপব্যবহার, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা, রাষ্ট্রীয় সুশাসনের জায়গাগুলোতে ঘাটতি তৈরি হলে মানুষ অপরাধী হয়ে ওঠে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এক সময় ফৌজদারি অপরাধ বেশি হতো। কিন্তু এখন এই ধরনের অপরাধের পাশাপাশি, সংঘবদ্ধ অপরাধ, সাইবার অপরাধ, কিশোর অপরাধ বেশি হচ্ছে।

বেশির ভাগ অপরাধী এখন অনলাইন প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে অপরাধ করছে। কেউ বুঝে করছে, আবার অনেকে না বুঝে করছে। কেউ কেউ আবার এসব অপরাধে দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। অনলাইন ব্যবহার করে রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারনা, গুজব ছড়ানো, হ্যাকিং, অনলাইন ব্যবসার নামে প্রতারণা, পর্নোগ্রাফিসহ নানান অপরাধ দেদারছে চলছে।

গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা বলেন, সাইবার অপরাধ এতটাই বেড়ে গেছে যেখানে ১০টি মামলা নিয়ে কাজ করলে ৭টি সাইবার রিলেটেড। কারণ সাইবার অপরাধ করতে অপরাধীদের ঘটনাস্থলে থাকতে হয় না। বিদেশে বসেও দেশে ক্রাইম করতে পারে। এখানে তার শারীরিক পরিশ্রম হচ্ছে না, আর্থিক খরচও হচ্ছে না। শুধুমাত্র একটু সময় আর ইন্টারনেট হলেই এই অপরাধ করতে পারছে।

একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, থানায় এখন যে ধরনের অভিযোগ আসে তার ২০ শতাংশের বেশি সাইবার ক্রাইমের। কিন্তু একটা সময় এমন ছিল না। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই এসব অপরাধই বেশি ছিল। সময়ের সঙ্গে অপরাধীরা সাইবার অপরাধের দিকে ঝুঁকছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজ এবং অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত প্রেক্ষাপটের কারণেই বদলাচ্ছে অপরাধের ধরন। পুলিশের সাবেক আইজি ও সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ বলেন, পরিবেশ-পরিস্থিতি, শিক্ষা-দীক্ষার অভাব, বন্ধুবান্ধব, পরিবারের কারণে মানুষ অপরাধী হয়ে যায়। অপরাধপ্রবণতা আগেও ছিল এখন আছে এবং থাকবেও। তবে এটি কমানোর জন্য সতর্ক থাকতে হবে। শিশুরা যাতে ওই পথে যেতে না পারে এবং দুষ্টু লোকদের সঙ্গে যাতে মেলামেশা করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এজন্য সবসময় পারিবারিক আবহ ও বন্ধুবান্ধবের দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। পারিবারিক আবহ ও বন্ধুবান্ধব যদি খারাপ হয় তবে মানুষ অপরাধী হয়ে উঠবে।

তিনি বলেন, প্রযুক্তির কারণে এখন অপরাধের ধরন পাল্টে গেছে। সনাতনী অপরাধ কমে প্রযুক্তিগত অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। আগে যারা চুরি ডাকাতিসহ নানা সনাতনী অপরাধে জড়িত ছিল তারাই এখন অনলাইন প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে অপরাধ করে। আবার প্রযুক্তিগত অপরাধের কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও প্রযুক্তি ব্যবহার করে তদন্ত করতে হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সমাজ ও অপরাধ-বিজ্ঞানী তৌহিদুল হক বলেন, মানুষ কেন অপরাধী হয়ে উঠে এ নিয়ে অপরাধ-বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। একটি পক্ষ মানুষের শারীরিক গঠন ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঙ্গে অপরাধের ধরনের কোনো সামঞ্জস্য বা সম্পর্ক আছে কিনা সেটি নিয়ে গবেষণা করছেন। তারা এই বিষয়গুলোর ওপর বেশি জোর দেন।

আরেক পক্ষ বলছেন, মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্যের কারণে অপরাধী হয়ে উঠার মিল নাই বরং জন্মের পর সে কোন প্রক্রিয়ায় পরিবেশে বেড়ে উঠে তার ওপর নির্ভর করে। এই তর্কবিতর্কগুলো এখনো চলমান। তবে কোনো ব্যক্তির মধ্যে যদি অপরাধপ্রবণ কোনো আকৃতি থেকেও থাকে তবে তাকে চিকিৎসা বা কাউন্সিলিং করে সংশোধন করা যায়।

কিন্তু কারো বেড়ে উঠা, সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া, পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক, বন্ধুবান্ধবের সম্পর্ক, শিক্ষা, নৈতিক আদর্শ, আইন মানার প্রবণতা, ব্যক্তি সুশাসন থেকে রাষ্ট্রীয় সুশাসনের জায়গাগুলোতে ঘাটতি তৈরি হলে তখনই মানুষ অপরাধী হয়ে ওঠে।

অপরাধ করার মানসিকতাকে দু’ভাবে মূল্যায়ন করেছেন এই অপরাধ-বিজ্ঞানী। বলেছেন, অনেকের মধ্যে অপরাধ করার মানসিকতা থাকলেও সে তার শিক্ষা, সামাজিক অবস্থান, পারিবারিক মর্যাদা বজায় রাখতে গিয়ে অপরাধ করার ইচ্ছাটাকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর যাদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কম বা এসব বৈশিষ্ট্য খুব বেশি যাদের প্রভাবিত করে না, তারাই অপরাধ করে।

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কিছু মানুষ আগে যেসব অপরাধ করেছে, সেই অপরাধে তাদের শাস্তি কেমন হয়েছে, সামাজিক অনুশাসন বা বিচারের মুখোমুখি তাদের হতে হয়েছে কি-না। এ ধরনের বিচার বিশ্লেষণ করে যখন পজেটিভ ইঙ্গিত পায় তখনই অপরাধে নিজেকে জড়ায়।

আরেকটি বিষয় হলো দেশে যখন অপরাধের বিচার, সুশাসনের চর্চা, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, নৈতিকতা, ব্যক্তির সম্পর্কের প্রতি আচরণ কিংবা সৎভাব যখন বজায় থাকে না তখন সনাতনী অপরাধ বেড়ে যায়।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিটের সহকারী অধ্যাপক ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ড. মো. জহির উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, অন্য কোনো অপরাধীকে যখন মানুষ অপরাধ করতে দেখে তখন সেও অপরাধ করে।
বিদেশি গবেষণায়ও উঠে এসেছে পরিবারের মধ্যে যদি কেউ এরকম থাকে তখন এরকম প্রবণতা দেখা যায়। কারও কারও মধ্যে অপরাধ করার প্রবণতা শৈশব থেকেই লক্ষ্য করা যায়। তারা অপরাধ করার জন্য একধরনের জিনগত প্রস্তুতি নিয়ে জন্মায়। নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে আগ্রাসী আচরণ বেশি দেখা যায়। অনেক সময় অন্য কেউ অপরাধ করে লাভবান হয়েছে তার কোনো শাস্তি হয়নি এরকম দেখে সেও মনে করে আমিও করলে আমার কিছু হবে না।

তিনি বলেন, একবার যখন কেউ অপরাধ করে তখন সে ‘অপরাধী’ হিসেবে পরিচিতি পায়। তার মানবিক অধিকার গুরুতরভাবে বিঘ্নিত হয়। রাষ্ট্র, সমাজ বা ধর্ম আর তাকে রক্ষা করে না। তখন তার জন্য আরও অপরাধ করাই সহজ হয় এবং অপরাধীদের সমাজে মেশাই তার জন্য সহজ হয়। সে আরো অপরাধ করে ধীরে ধীরে পাকা অপরাধী হয়ে ওঠে। শৈশবে যারা ভালোবাসা পায় না, নির্যাতন ও ঘৃণা, অবহেলা ও তাচ্ছিল্যে ও বাস্তব ঝুঁকির মধ্যে যারা বেড়ে উঠে তাদের কারও কারও মধ্যে এই প্রবণতা থাকে।

এ ছাড়া সমাজে যখন অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়, যখন নৈতিকতার অবক্ষয় হয়, তখন এই সমাজের সদস্যদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পায়।

তিনি বলেন, মানুষের মস্তিষ্কে ‘সেরোটনিন’ নামে এক ধরনের নিউরোকেমিক্যালের ঘাটতি থাকলে তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেশি দেখা যায়।

কেউ যদি অনেক বেশি পরিমাণে ‘স্টেরয়েড’ শরীরে নেয়, তবে তার মধ্যে আক্রমণাত্মক আচরণ বেড়ে যেতে পারে। মস্তিষ্কের কোনো অসুখ, যেমন টিউমার, মস্তিষ্কে আঘাত, মস্তিষ্কে অপারেশনের সময়ে সৃষ্ট ক্ষত ইত্যাদি কারণে মস্তিষ্কের আক্রমণাত্মক প্রবণতা নিয়ন্ত্রণকারী অংশের ক্ষতি হলে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বদলে যেতে পারে এবং সে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!