শিশুর জন্মগতত্রুটির হার বাংলাদেশে বেশি !

  • আপডেট সময় শনিবার, এপ্রিল ১৫, ২০২৩
  • 137 পাঠক

নিজস্ব ডেস্ক

———–
দেশে জন্মগত ত্রুটি নিয়ে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার হার বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। যা বিশেষজ্ঞদের ভাবিয়ে তুলেছে। সম্প্রতি বিএসএমএমইউ’র গবেষণায় ওঠে এসেছে, প্রতি বছর শতকরা ৭ দশমিক শূন্য ২ ভাগ শিশু নানা শাররিক ত্রুটি নিয়ে ভূমিষ্ঠ হচ্ছে।

পৃথিবীব্যাপী জন্মগত ত্রুটির হার প্রতি ১০০ জনে ৩ থেকে ৬ জন (৩-৬ শতাংশ)। জন্ম থেকেই মানুষের কোনো ত্রুটি থাকলে তা জন্মগত ত্রুটি। গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাসের মধ্যে শিশুর সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসহ সম্পূর্ণ অবয়ব তৈরি হয়। আর জন্মগত ত্রুটিগুলো এই সময়েই হয়। ফলে শারীরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, মানসিক বিকাশ বাধা পায় বা প্রতিবন্ধিতা হতে পারে।

জন্মগত ত্রুটি কয়েকটি কারণে হতে পারে বলে ধারণা দেন বিশেষজ্ঞরা। যেমন-পরিবেশগত কারণ, ইনফেকশন অথবা বংশগত কারণ। এর যেকোনো একটি বা একাধিক কারণেও হতে পারে।

কিছু ত্রুটি আছে শাররিক গঠনগত কিছু আছে ফাংশনাল বা কার্যক্ষমতাগত ত্রুটি। কোনো কোনো সময় উভয় ত্রুটিও থাকতে পারে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়ে বলেন, জন্মগত ত্রুটি চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধের ওপর গুরুত্ব দেয়া দরকার। যেমন গর্ভ পূর্ববর্তী এবং গর্ভকালীন চেকআপ, গর্ভকালীন (১৮-২২ সপ্তাহের মধ্যে) আল্ট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে জন্মগত ত্রুটি নির্ধারণ, গর্ভকালীন অসংক্রামক ব্যাধি যেমন-উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, অল্প বয়সে এবং অধিক বয়সে গর্ভনিরোধ, আয়োডিনযুক্ত লবণের মতো খাবারের সঙ্গে ফলিক এসিড মেশানোর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধ সম্ভব।

চলতি মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ)-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রতি বছর শতকরা ৭ দশমিক শূন্য ২ ভাগ শিশু নানা শাররিক ত্রুটি নিয়ে ভূমিষ্ঠ হচ্ছে। বিএসএমএমইউ-এর নবজাতক বিভাগে ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত চিকিৎসা নিতে আসা ১১ হাজার ২৩২ জন নবজাতকের ওপর এ গবেষণা পরিচালিত হয়। গত ৮ বছরে বিএসএমএমইউয়ের নবজাতক বিভাগে চিবিৎসা নিতে আসা শিশুদের মধ্যে নানা শাররিক ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে ৭৮৯ জন শিশু। যা উন্নত বিশ্বের জন্মগত ত্রুটির হারের চেয়ে বেশি। গবেষণার ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিসি ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ নবজাতকদের জন্মগ্রত ত্রুটি প্রতিরোধ এবং এর চিকিৎসার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, নিত্যনতুন ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। জেনেটিক ল্যাবও প্রতিষ্ঠা করা হবে। তবে, জন্মগ্রত ত্রুটির ক্ষেত্রে ট্রান্সজেন্ডারের বিষয়ে করণীয় কী হতে পারে তাও বিবেচনায় রাখতে হবে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে শাররিক ত্রুটির শিশু জন্মের হার বেশি হওয়ার কারণ কী জানতে চাইলে-শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস অ্যান্ড গাইনি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং ওজিএসবি’র সাবেক মহাসচিব ডা. সালেহা বেগম চৌধুরী বলেন, পরিবেশগত কারণটা বেশি দায়ী। বায়ু দূষণ। আমরা হেলথদি খাবার কম খাই। মানসিক চাপ থাকে মায়েদের। ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকে। উচ্চ রক্তচাপও একটা কারণ। গর্ভকালীন অসংক্রামক ব্যাধি যেমন-ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, অল্প বয়সে এবং অধিক বয়সে গর্ভনিরোধ ধরনের জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধ সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
বিশ্বে প্রতি ৩৩ জনে একজন শিশু কোনো না কোনো জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মায়। নবজাতকের ২১ শতাংশ মৃত্যুই জন্মগত ত্রুটির কারণে হয়। ২০১৫ সালের হিসাব মতে, বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৯ কোটি ৬০ লাখ শিশু কোনো না কোনো জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মায়। এর মধ্যে প্রায় ৬ লাখ ৩২ হাজার শিশু মারা যায়। বেশি মারা যায় হৃৎপিণ্ডে জন্মগত ত্রুটি নিয়ে। আশার কথা, চিকিৎসার মান উন্নত হওয়ায় এই ত্রুটিজনিত মৃত্যুর সংখ্যা এখন কমছে।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর’বি) গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভে পূর্ণ সময় থাকার আগেই শিশু জন্মানোরও একটি কারণ বায়ুদূষণ। এ দূষণের শিকার মায়েদের মধ্যে কম ওজনের শিশু জন্ম দেয়ার হার বেশি।

রাজধানীতে জন্ম নেয়া ৩ হাজার ২০৬টি নবজাতককে নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভাবস্থায় বেশি বায়ুদূষণের শিকার মায়েদের মধ্যে কম ওজনের শিশু জন্ম দেয়ার হার বেশি। অকালে সন্তান জন্মদানের ঝুঁকিও তাদের মধ্যে বেশি। আইসিডিডিআরবি’র জলবায়ু পরিবর্তন ও স্বাস্থ্যবিষয়ক শাখার (ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড হেলথ ইনেশিয়েটিভ) গবেষক মাহীন আল নাহিয়ান বলেন, জন্মের সময় নবজাতকের ওজন যদি ২ হাজার ৫০০ গ্রামের কম হয়, তাহলে তাকে ‘লো বার্থ ওয়েট’ বা কম জন্মওজন বলা হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, সবচেয়ে কম দূষণের শিকার মায়েদের মধ্যে কম ওজনের শিশু জন্ম দেয়ার হার ২০ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার মায়েদের মধ্যে এই হার ৩৬ শতাংশ। বায়ুদূষণ ভ্রুণের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। সময়ের আগে জন্ম নেয়া এবং কম জন্ম-ওজন অর্থাৎ অপরিণত জন্ম বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। বাংলাদেশে প্রতি ৪০টি নবজাতকের একটি জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে মারা যায় অপরিণত অবস্থায় জন্মের কারণে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ড. অসীম দাস বলেন, শিশুর জন্মগত ত্রুটির সত্যিকার কারণ জানা নেই যে বলা যাবে এই কারণে শিশুটি জন্মগত ত্রুটি হয়েছে। এটা পুরোপুরি হাইপোথেটিক্যাল। বিষয়টি যারা ক্লিনিকাল পর্যায়ে আছেন তারা ভালো বলতে পারবেন। তারা শিশুদের শিখন কাজে অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে অটিজম শিশুদের তুলনা করার জন্য কিছু টুল্স ব্যবহার করেন। তখন তারা বুঝতে পারেন স্বাভাবিক শিশুদের সঙ্গে তারা সামানভাবে সমন্বয় করতে পারছেন কিনা। বয়সের সঙ্গে বুদ্ধিমত্তার বিকাশ সঠিক হয়েছে কিনা।

শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস অ্যান্ড গাইনি বিভাগের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল বলেন, অ্যানোমালি স্ক্যানের মাধ্যমে শিশুর গঠন ঠিক আছে কিনা বা তার হাত-পা ঠিক আছে কিনা, এসব দেখা যায়। সব সময় আলট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে ডিএনএ বা জিনগত সমস্যা ধরা যায় না। কারণ প্রতিবন্ধী বাচ্চা যারা থাকে তাদের গঠনগত ত্রুটি নাও থাকতে পারে। তাদের থাকে মস্তিষ্কে ত্রুটি বা বুদ্ধিবৃত্তিক ত্রুটি। অর্থাৎ জেনেটিক বা ডিএনএঘটিত ত্রুটি। এই ডিএনএঘটিত ত্রুটি কিন্তু আলট্রাসনোগ্রাম করে ধরা যায় না।

এনাম মেডিকেল কলেজের গাইনি ও অবস বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা বলেন, জন্মগত ত্রুটির কারণগুলো এখন পর্যন্ত ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রেই শনাক্ত করা যায় না। তার পরেও কিছু বিষয় আগে থেকে মেনে চললে এই ঝুঁকি এড়ানো যায়। প্রথমত গর্ভধারণের পূর্বেই মায়েরা ফলিক এসিড জাতীয় ওষুধ খেলে অনেক অংশে কমানো যেতে পরে। এজন্য প্রাকৃতিক খাদ্য যেমন, পালং শাক, সরিষা শাক ইত্যাদি খেয়েও ফলিক এসিডের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। গর্ভধারণের পূর্বেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা। ডায়াবেটিসের কারণে অনেকগুলো ত্রুটি দেখা যায়। মায়ের বা সেই বংশের কারও থ্যালাসেমিয়া আছে কিনা তা পরীক্ষা করা। চিকিৎসার মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়ার সাধারণ কিছু সমস্যা সমাধান করা যায়। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জীবনযাপন।

শিশুর জন্মগত ত্রুটি ও করণীয় বিষয়ে এক প্রবন্ধে কেয়ার মেডিকেল কলেজের শিশু সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. বিজয় কৃষ্ণ দাস বলেছেন, জন্ম থেকেই মানুষের কোনো ত্রুটি থাকলে তা জন্মগত ত্রুটি। গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাসের মধ্যে শিশুর সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসহ সম্পূর্ণ অবয়ব তৈরি হয়। আর জন্মগত ত্রুটিগুলো এই সময়েই হয়। ফলে শাররিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, মানসিক বিকাশ বাধা পায় বা প্রতিবন্ধিতা হতে পারে।

কোনো জন্মগত ত্রুটিরই সঠিক কারণ জানা যায়নি। তবে যেসব কারণকে সন্দেহ করা হয় তার মধ্যে কিছু হলো- বংশগত (মা, বাবা)। নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে। মা-বাবার অতি অল্প বয়স বা অধিক বয়স (২০ বছরের কম বা ৩৫ বছরের বেশি)। পরিবেশদূষণ, তেজস্ক্রিয়তা। গর্ভাবস্থায় ফলিক এসিড, ভিটামিন ‘এ’, ভিটামিন ‘বি’ ইত্যাদির স্বল্পতা।

গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা, পুষ্টিহীনতা, স্থূলতা। মা-বা বাবার তামাক, ধূমপান, মদ ইত্যাদির নেশা। মায়ের গর্ভে পানির স্বল্পতা। গর্ভাবস্থায় ভুল ওষুধ সেবন। এই চিকিৎসক বলেন, যেসব ত্রুটি ছোট হলে অনেক সময় অপারেশন ছাড়াই ভালো হয়। বড় ত্রুটির ধরন অনুযায়ী অপারেশনের সময় ঠিক করা হয়। অনেক সময় জন্মের পর পরই অপারেশন করাতে হয়।

বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, আচরণগত সমস্যা, ঠিকমতো কথা বলতে না পারা, অটিজম, ডাউন সিনড্রোম, সেরিব্রাল পালসি ইত্যাদি বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশজনিত ত্রুটির যদিও কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে সঠিক যত্ন, স্পিচ থেরাপি, আচরণগত, বিশেষায়িত শিক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে অনেককেই স্বাভাবিকের কাছাকাছি ফিরে আনা যায়। এ ছাড়া জন্মগত হাইপোথাইরডিজম, ফিনাইল কিটোনরিয়া ইত্যাদি ত্রুটি হয়। ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসায় ভালো হয়।

জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে তিনি বলেন, সতর্ক হয়ে কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারলে জন্মগত ত্রুটি অনেকাংশেই কম হয়। যেমন- গর্ভাবস্থায় নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শে থাকা। পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা। গর্ভাবস্থায় মায়ের মানসিক প্রশান্তি। গর্ভাবস্থায় ফলিক এসিড, ভিটামিন ‘বি’ ইত্যাদি ভিটামিন জাতীয় খাবার গ্রহণ। তামাক, ধূমপান, মদ ইত্যাদি পরিহার। নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে পরিহার। সঠিক বয়সে সন্তান ধারণ (২০-৩৫ বছর)। সন্তান ধারণের আগে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ। কুসংস্কার থেকে দূরে থাকা। শিশু জন্মের পরপরই তার নাক, কান, চোখ, মুখ, মুখগহ্বর, মাথা, হাত, পা, যৌনাঙ্গ, মলদ্বার ইতাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখে নিতে হবে। কোনো অসংগতি দেখলেই সঙ্গে শিশু সার্জনের কাছে নেয়া উচিত।

এ ছাড়া জন্মের পর শিশুর বাড়ন্ত অবস্থায় কোনো প্রকার শাররিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো অসংগতি দেখা গেলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। কেননা অনেক জন্মগত ত্রুটিই দেরিতে চিকিৎসা করালে আর সম্পূর্ণরূপে ভালো করা যায় না।

 

 

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!