বক্তব্যে পটু, বাস্তবায়নে ব্যর্থ?

  • আপডেট সময় রবিবার, এপ্রিল ৩০, ২০২৩
  • 194 পাঠক

মাহবুব হাসান

————-

বর্তমান সরকারের মন্ত্রীরা যখন রাজনৈতিক ইস্যুতে বক্তব্য দিয়ে মাঠ গরম করছেন, তখন সমকালে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে– ‘উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের গতি আরও ধীর হয়ে এসেছে।

চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত গত ৯ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম। মোট বরাদ্দের মাত্র ৪১ দশমিক ৬৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয়েছে এ সময়। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৪৫ শতাংশেরও বেশি’ (১৯ এপ্রিল, ২০২৩)।

এই দশ বছরে সরকার যেভাবে দেশের ও রাজধানীর উন্নয়নে তৎপর ছিল, চলতি বছরে একই রকম তৎপর। কিন্তু যাঁরা উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছেন, তাঁরা ঠিকমতো তা বাস্তবায়ন করতে পারছেন না। বলা উচিত, তাঁরা তুলনামূলক আগের বছরগুলোর চেয়ে ব্যর্থ। স্বাভাবিকভাবেই এই ব্যর্থতার দায় গিয়ে পড়ে সরকারের কাঁধে। অর্থাৎ সরকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে আন্তরিক ছিল না বলেই প্রকল্প পরিচালকরা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেননি।

এই না পারার সাধারণ কারণ চিহ্নিত করতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই, কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই বোঝা যায়। সরকারের অর্থ ছাড়ের ব্যাপারে অ্যাকাউন্টস অফিসগুলো ও মন্ত্রণালয়ের ঢিলেমি যেমন আছে, তেমনি আছে তাদের অদক্ষতা ও অনিয়ম বিষয়।

যাহোক, এডিপি বাস্তবায়নের এই যে ধীরগতি, তা প্রমাণ করে সরকারের উন্নয়ন আদর্শ ও তা কার্যকরী পদক্ষেপের মধ্যে ফারাক রয়েছে। কিন্তু এসব ব্যর্থতার জবাব তাঁরা দেন এই বলে, এডিপি বাস্তবায়নে শতভাগ অর্জন সম্ভব নয়। কেন সম্ভব নয়– এর জবাব আসে এভাবে, অর্থ ছাড়সহ নানা প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক কারণে উন্নয়নকাজ যথাসময়ে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ ব্যাখ্যা মন্দ নয়; বাস্তবধর্মী। কিন্তু এর বাইরেও আছে প্রশাসনিক ব্যর্থতা, দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালকের যোগ্যতা, দক্ষতা নিয়ে নানা অভিযোগ। যাঁরা সরকারের প্রজ্ঞাবান ও ক্ষমতাবান সচিবদের গুডবুকে থাকেন, তাঁরাই আকর্ষণীয় প্রকল্পের হাল ধরেন। প্রকল্পের গাড়ি কীভাবে বিভিন্ন ঘাটে ব্যবহার করতে দেয়া হয়, এ নিয়েও সংবাদপত্রে প্রায়ই প্রতিবেদন দেখতে পাওয়া যায়। ফলে প্রকল্প কর্মকর্তা লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারলেও সচিবের তাপে তাঁরা বহাল থাকেন। তাঁর সেই ব্যর্থতার দায় গিয়ে চাপে মন্ত্রণালয়ের কাঁধে।

এই পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব ছিল যদি মন্ত্রীরা প্রকল্প বাস্তবায়নে সতর্ক ও সক্রিয় থাকতেন। সরকারের মন্ত্রীরা যদি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অধিক সময় ব্যয় না করতেন; নিজ নিজ তরফের উন্নয়নকাজ তদারকি করতেন নিবিড়ভাবে, তাহলে সমকালের আলোচ্য প্রতিবেদনে উল্লিখিত ওই যে ২ দশমিক ৪৯ শতাংশ উন্নয়ন কম হয়েছে গত বছরের চেয়ে, সেই ঘাটতি আমাদের দেখতে হতো না।

আমার মনে হয়, সরকারের মন্ত্রীদের রাজনৈতিক বিরোধীদের নিয়ে ব্যস্ত না থেকে উন্নয়নকাজে মনোযোগী হওয়া উচিত। বিশেষ করে কিছু মন্ত্রী আছেন সর্বক্ষণ বিরোধী দল বিএনপির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করাই যেন তাঁদের দায়িত্ব। রাজনৈতিক মাঠে এই রকম ব্যস্ততার দরুন মন্ত্রণালয়ের মাঠে তিনি বা তাঁরা সময় দিতে পারেন না।

মন্ত্রীরা তো বটেই, আওয়ামী লীগ নেতারাও রাজনৈতিক বিষয়ে কথা ওঠালেই অবধারিতভাবে বিএনপির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন। দলটি ১৭ বছর ধরে ক্ষমতায় নেই। সামান্য যে কয়জন এমপি ২০১৮ সালের ‘নির্বাচন’ পেরিয়ে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিল, তারও গত বছর ডিসেম্বর মাসে পদত্যাগ করেছেন। সরকারের মন্ত্রী ও নেতারা বলে থাকেন, বিএনপি নাকি বিপর্যস্ত। তারপরও বিএনপিই যে এখনও আওয়ামী লীগের প্রবল প্রতিপক্ষ, সেটা ক্ষমতাসীন মহলের বক্তব্য শুনলে টের পাওয়া যায়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে মন্ত্রীরা বলেন, বিএনপি সামরিক গর্ভ থেকে জাত; তাই তারা শুধু অনির্বাচিত সরকার চায়। অথচ তাঁরা ভুলে যান আওয়ামী লীগই নব্বইয়ের দশকে ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ জামায়াতের সঙ্গে রাজনৈতিক মাঠ তছনছ করে দিয়ে দাবি তুলেছিলেন– নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার কায়েম করতে হবে। সেই দাবি পূরণ করতে গিয়ে বিএনপিকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন-প্রায় নির্বাচন করতে হয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ বলেছিল সাংবিধানিক রীতি রক্ষার জন্য তারা নির্বাচন করছে; তারা নির্বাচন দিয়েই ক্ষমতা থেকে সরে যারে। সেই ঘোষণা থেকে সরে এসে পাঁচ বছর ক্ষমতা ভোগ করেছে এবং ২০১৮ সালে আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে ‘বিজয়’ অর্জন করে। এসব রাজনৈতিক ব্যর্থতার লজ্জা আওয়ামী লীগ ঘুচাবে কেমন করে?

আওয়ামী লীগ নেতা ও সরকারের মন্ত্রীরা এও বলে থাকেন, বিএনপির জনসভাগুলোতে ৪০/৫০ হাজারের বেশি লোক হয় না। কারণ তারা ‘গণবিচ্ছিন্ন’। এটাই যদি সত্য হয়, তাহলে তাদের সভাগুলো ভন্ডুল করেছেন কেন? তাঁদের কর্মসূচির পাশাপাশি প্রতিবাদী মিটিং-মিছিলের আয়োজন করে বিএনপিকে কোণঠাসা করার কারণ কী? এর একটাই উত্তর– বিএনপির জমায়েতে জনগণ অংশ নিচ্ছে বলেই আওয়ামী লীগ নেতাদের ক্ষমতা হারানোর ভয়।

মন্ত্রীরা আরেকটি কথা বলে থাকেন। বিএনপির নেতৃত্ব নেই। চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ‘কনভিকটেড’। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বিদেশে ‘পালিয়ে’ আছেন। এ দলটি কী করে ক্ষমতার কথা চিন্তা করে? তাহলে ক্ষমতার প্রশ্নে বিএনপিকে নিয়ে মন্ত্রীদের এত কথা বলার দরকার কি? তার বদলে বরং উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে মনোযোগ দিলেই পারেন! যে উন্নয়নের কথা বলে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায়, এর গতিই যদি ধীর হয়ে যায়, তাহলে তো সকলই গরল ভেল!

আমার একটি প্রস্তাব আছে সরকারের কাছে। যাঁরা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন তাঁরা মেঠো বক্তৃতায় যাবেন না। তাঁদের তৃণমূল স্তরের কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে দাওয়াত দেওয়া হবে না। অর্থাৎ তাঁরা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করবেন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য। লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য এর চেয়ে ভালো কী ব্যবস্থা হতে পারে? রাজনৈতিক বক্তব্য দেবেন সেইসব কেন্দ্রীয় নেতা, যাঁরা কোনো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নেই। বরং রাজনৈতিক মাঠে নানা ইস্যুতে ‘কোয়ালিটি’ বক্তব্য দিয়ে তাঁরা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে থাকবেন, যাতে করে পরবর্তীকালে মন্ত্রিসভায় স্থান পান।

ড. মাহবুব হাসান: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!