দিশারী ডেস্ক, ২০ জুলাই,২০২৩।
বাংলাদেশ এখন দানাজাতীয় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, আর এ বিষয়টি জানে পুরো পৃথিবী’ বলে গত ১৩ জুলাই মন্তব্য করেছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক আমবাগান পরিদর্শনশেষে তিনি বলেন, বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক উদ্যোগ নিয়েছেন। বিশেষ করে চাল ও ধান বেশি উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেন। এ কারণে আজ আমরা দাবি করছি, বাংলাদেশ এখন দানাজাতীয় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর এ বিষয়টি জানে পুরো পৃথিবী।
এর আগে গত ৫ এপ্রিল খাগড়াছড়িতে এক অনুষ্ঠানে একই ধরনের দাবি করেন কৃষিমন্ত্রী। ওই সময় তিনি বলেন, একসময় বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে হতো। এখন দানাদার খাদ্য চাল, গমসহ অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ স্বংয়সম্পূর্ণ। এর আগে খাদ্যমন্ত্রীসহ সরকারের অনেক মন্ত্রী বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে দাবি করেছেন। যদিও বাস্তব অবস্থার সঙ্গে মন্ত্রীদের এসব দাবির কোনো মিল নেই। বরং প্রতি বছর বাংলাদেশ প্রচুর পরিমাণ চাল ও গম আমদানি করছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত দুই দশকে এমন কোনো বছর নেই, যে বছর বাংলাদেশ চাল আমদানি করেনি। কম-বেশি প্রতি বছরই চাল আমদানি করা হয়। তবে দুই দশক আগে ১৯৯০-৯১, ১৯৯১-৯২ ও ১৯৯২-৯৩ অর্থবছর টানা তিন বছর বাংলাদেশকে কোনো চাল আমদানি করতে হয়নি।
১৯৯৩-৯৪ অর্থবছর থেকে বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতি বছরই চাল আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছর ধান উৎপাদনে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হওয়ায় ওই বছর মাত্র চার হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানি করা হয়। আর গম প্রতি বছরই বাংলাদেশকে আমদানি করতে হয়। এ খাদ্যশস্যে কখনোই বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না।
বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রতি বছর চাল আমদানি করা হচ্ছে। এর মধ্যে ২০১০-১১ অর্থবছর চাল আমদানি করা হয় ১৫ লাখ ৫৪ হাজার মেট্রিক টন। পরের অর্থবছর তা কমে দাঁড়ায় পাঁচ লাখ ১৪ হাজার মেট্রিক টন। ২০১২-১৩ অর্থবছর তা আরও কমে দাঁড়ায় ২৬ হাজার মেট্রিক টন। পরের দুই অর্থবছর চাল আমদানি আবার দ্রুত বাড়ে। এর মধ্যে ২০১৩-১৪ অর্থবছর আমদানি হয় তিন লাখ ৭১ হাজার এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছর ১৪ লাখ ৯০ হাজার মেট্রিক টন।
২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছর চাল আমদানি আবারও কমে। ওই দুই অর্থবছর চাল আমদানি করা হয় যথাক্রমে দুই লাখ ৫৬ হাজার ও এক লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। পরের অর্থবছর বন্যাসহ নানা দুর্যোগে ধান উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ২০১৭-১৮ অর্থবছর দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৩১ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানি করা হয়। পরের অর্থবছর উৎপাদন বাড়ায় তা আবার কমে দাঁড়ায় এক লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন।
এদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর দেশে চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি। ফলে ওই অর্থবছর মাত্র চার হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানি হয়, যা ছিল মূলত সুগন্ধী চাল। তবে পরের তিন অর্থবছরই আবারও উল্টো চিত্র দেখা গেছে। এর মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছর দেশে চাল আমদানি হয় ১৩ লাখ ৫৯ হাজার মেট্রিক টন, ২০২০-২১ অর্থবছর ৯ লাখ ৮৭ হাজার মেট্রিক টন ও বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছর ১০ লাখ ৫৬ হাজার মেট্রিক টন।
যদিও বিদায়ী বছর আমন ও বোরোর উৎপাদন ভালো হওয়ায় চলতি অর্থবছর চাল আমদানির দরকার হবে না বলে দাবি করেছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার। তবে উৎপাদন বাড়লেও বাংলাদেশকে চলতি অর্থবছর কম পরিমাণে চাল আমদানি করতে হবে বলে গত এপ্রিলে পূর্বাভাস দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি দপ্তর।
এদিকে চাল আমদানি ওঠানামা করলেও গম আমদানিতে মোটামুটি ধারাবাহিকতাই ছিল প্রতি বছর। বিদায়ী অর্থবছর দেশে গম আমদানি করা হয়েছে ৩৮ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন। এর আগের অর্থবছর গম আমদানির পরিমাণ ছিল ৪০ লাখ ১২ হাজার মেট্রিক টন, ২০২০-২১ অর্থবছর ৫৩ লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন ও ২০১৯-২০ অর্থবছর ৬৩ লাখ ৬৬ হাজার মেট্রিক টন। এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গম আমদানির পরিমাণ।
এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছর গম আমদানি করা হয়েছিল ৫৫ লাখ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছর গম আমদানি করা হয়েছিল ৪৫ লাখ পাঁচ হাজার মেট্রিক টন। ওই অর্থবছর রেকর্ড পরিমাণ চাল আমদানির কারণে চাল ও গম মিলিয়ে দেশে সর্বোচ্চ ৯৬ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য আমদানি করা হয়। তার আগের (২০১৬-১৭) অর্থবছর দেশে গম আমদানির পরিমাণ ছিল ৫৬ লাখ ৯ হাজার মেট্রিক টন, যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
২০১৫-১৬ অর্থবছর দেশে গম আমদানির পরিমাণ ছিল ৪১ লাখ ৯৯ হাজার মেট্রিক টন, ২০১৪-১৫ অর্থবছর ৩৮ লাখ ৪১ হাজার মেট্রিক টন. ২০১৩-১৪ অর্থবছর ২৬ লাখ ৭৭ হাজার মেট্রিক টন, ২০১২-১৩ অর্থবছর ১৭ লাখ ১৫ হাজার মেট্রিক টন, ২০১১-১২ অর্থবছর ১৬ লাখ ৬১ হাজার মেট্রিক টন এবং ২০১০-১১ অর্থবছর ৩৫ লাখ ৯৬ হাজার মেট্রিক টন।
গত ১৩ বছরের খাদ্যশস্য আমদানির চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছর সবচেয়ে কম ১৭ লাখ ৪১ হাজার মেট্রিক টন চাল ও গম আমদানি করা হয়। দ্বিতীয় সর্বনিম্ম আমদানি ছিল এর আগের (২০১১-১২) অর্থবছর ২১ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন। তবে অন্য বছরগুলোয় ৩০ লাখ মেট্রিক টনের নিচে কখনোই খাদ্যশস্য আমদানি করা হয়নি। এর মধ্যে সাত বছরই আমদানি করা হয়েছে ৫০ লাখ মেট্রিক টনের বেশি খাদ্যশস্য।
Leave a Reply