ডাবের চাহিদা বেড়েছে, উৎপাদন কমছে

  • আপডেট সময় শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ১, ২০২৩
  • 298 পাঠক

বিজ্ঞানীরা বলছেন ডাব বিক্রির কারণে বীজ তৈরি হচ্ছে না, ভিয়েতনাম থেকে সাড়ে ৮ লাখের বেশি চারা আনা হলেও আশানুরূপ ফলন হয়নি

দিশারী ডেস্ক। ১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ।

দেশে ডাব বা নারিকেলের চাহিদা বাড়ছে ব্যাপকভাবে। অথচ প্রতি বছর এর উৎপাদন কমছে। নারিকেলের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল তারও সুফল মেলেনি। ফলে যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে আরও উৎপাদন কমার শঙ্কা করছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা।

দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের জন্য ডাক্তাররা রোগীদের ডাব খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন, কারণ ডাবে পটাশিয়াম আছে। এ কারণে যারা ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছেন তারা প্রতিদিনই ডাব খাওয়ার চেষ্টা করছেন। ফলে এই সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা ডাবের দামও বাড়িয়ে দিয়েছেন।

সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে বছরে ৩৮ কোটি ৫৫ লাখ নারিকেল উৎপাদন হয়। সে হিসাবে গড়ে একজন মানুষ এক বছরের দুটি ডাব বা নারিকেল খাবার সুযোগ থাকে। যদিও বাংলাদেশে অনেকে বছরে ১০০ বা ২০০ ডাব বা নারিকেল খায়। আবার কারো বছরে একটিও খাবার সুযোগ হয় না।

দেশে ২০১৪-১৫ সালে ৫১ হাজার ৬৯৯ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয় ৩৮ কোটি ৫৫ লাখ ৪৫ হাজার নারিকেল। সাত বছর পর দেশের আম, কলা, লিচুর উৎপাদন বাড়লেও নারিকেলের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ব্যাপকহারে কমেছে আবাদি এলাকাও।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২১-২২ সালে ৩৮ হাজার ২২১ হেক্টর জমিতে নারিকেলের আবাদ হয়। উৎপাদন হয় ৩৮ কোটি ২৭ লাখ ৭০ হাজার। সাত বছর আগের চেয়ে এই উৎপাদন অনেক কম।

প্রতিকূল পরিবেশ, পোকার উপদ্রব, অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, নতুন গাছ না লাগানো, পুরোনো গাছগুলোর প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ না করার কারণে হুমকির মুখে পড়েছে নারিকেলের উৎপাদন—এমনটাই মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। দুই বছর আগেও সেন্টমার্টিনে উৎপাদিত নারিকেল স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে রপ্তানি করত স্থানীয়রা। কিন্তু দিন দিন নারিকেল বা ডাব শূন্য হয়ে পড়ছে দ্বীপটি। ‘হোয়াইট ফ্লাই’ নামের এক ধরনের সাদা মাছির আক্রমণে গাছ থেকে অঙ্কুরিত ডাব ঝরে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা।

কৃষি বিজ্ঞানীরা বলেন, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরের জলোচ্ছ্বাসে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। এরপর থেকে এই এলাকার পানিতে লবণাক্ততা অস্বাভাবিকহারে বেড়ে যায়। নারিকেলের উৎপাদন কমে যাওয়ার এটি বড় একটি কারণ।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. বিমল চন্দ্র কুণ্ডু বলেন, বরিশালে একসময় অনেক নারিকেল হতো। এখন কমে গেছে। নারিকেলের উৎপাদন কমে যাওয়ার মূল কারণ সিডর ও আইলা।ওই সময় অনেক নারিকেলগাছ মারা যায়। কিন্তু সে অনুযায়ী রোপণ করা হয়নি। তিনি বলেন, নারিকেলগাছের যত্ন নেয়া দরকার। কিন্তু মানুষ সেভাবে নারিকেলগাছের কোনো যত্ন নেয় না। এছাড়া বাণিজ্যিকভাবে কোনো নারিকেলবাগান গড়ে ওঠেনি। নারিকেলের উৎপাদন বাড়াতে বাণিজ্যিকভাবে বড় আকারে নারিকেলবাগান গড়ে তোলা জরুরি বলে মনে করেন এই কৃষি বিজ্ঞানী।

তিনি জানান, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট দুটি নারিকেলের জাত উদ্ভাবন করেছে। এগুলো চারা করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু একটি নারিকেলগাছে ফলন ধরতে ৮-১০ বছর সময় লাগে। এ কারণে সুফল পেতে সময় লাগছে।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্টিকালচার বিভাগের অধ্যাপক ড. জসীম উদ্দিন বলেন, নারিকেলগাছে পরিচর্যা করা দরকার। বছরের অন্তত দুবার খাবার (সার) দিতে হবে। মানুষ এই গাছের নিয়মিত পরিচর্যা করে না। ছাঁটাই করতে হয়। কিন্তু এগুলোও করেন না। এছাড়া দেখা যাচ্ছে ছত্রাকের কারণে গাছের আগা মরে যাচ্ছে। যে সংখ্যক গাছ মারা যাচ্ছে, সে অনুযায়ী নতুন চারা লাগানো হচ্ছে না। ফলে ধীরে ধীরে উৎপাদন কমে যাচ্ছে।

সরকারের উদ্যোগ, সাফল্য কম

নারিকেলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষি বিভাগ ভিয়েতনাম থেকে সরকারিভাবে ১ লাখ ৪০ হাজার চারা এনে কৃষকদের কাছে বিক্রি করে। এছাড়া একটি বেসরকারি কোম্পানি আরও ৭ লাখ নারিকেল চারা আমদানি করে কৃষকদের কাছে বিক্রি করে। ‘এটি খাটো জাতের নারিকেল, ফলন বেশি’—এভাবে ঘোষণা দিয়ে কৃষকদের কাছে বিক্রি করা হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভালো ফলন পাননি কৃষকরা। অনেক ক্ষুব্ধ কৃষক ফলন না পেয়ে নারিকেলগাছ কেটে ফেলেন।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা বলছেন, এভাবে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই এবং গবেষণা ছাড়া ভিয়েতনাম থেকে নারিকেল চারা আনা ঠিক হয়নি। দুই-তিন বছরে ফলন পাবার কথা বলা হলেও অনেকে সাত-আট বছরেও ফলন পাননি। যেহেতু কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সিদ্ধান্তে এভাবে নারিকেল চারা আনা হয়েছে, এ কারণে বিজ্ঞানীরা তাদের নাম প্রকাশ করতে চাননি।

এক ব্যক্তির অভিযোগ, স্থানীয় হর্টিকালচারের কর্মকর্তাদের পরামর্শে বেশ কয়েক বছর আগে ঢাকার খামারবাড়ি ও নাটোর হর্টিকালচার সেন্টার থেকে তিনি শতাধিক ভিয়েতনামি খাটো জাতের নারিকেলের চারা কিনেছিলেন। এক একটি চারার মূল্য ছিল ৫০০ টাকা। তার অভিযোগ, কেনার সময় বলা হয়েছিল দুই বছরের মাথায় ফল ধরবে। কিন্তু ছয় বছরেও নারিকেল ধরেনি।

এমন কয়েক শ ব্যক্তির নানা অভিযোগ। পর্যাপ্ত পরীক্ষানিরীক্ষা ছাড়াই এই খাটো জাতের নারিকেল চারা আমদানি করে কৃষকদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে ‘পুষ্টি উন্নয়ন’ নাম একটি প্রকল্পের মাধ্যমে এই নারিকেল চারা আমদানি করা হয়।

তবে প্রকল্পটির পরিচালক মেহেদী মাসুদ বলেন, অনেক সাফল্য রয়েছে। অনেকে ভালোই লাভবান হয়েছে। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা নারিকেল চারার পরিচর্যা করেননি। তবে সরকারি উদ্যোগে ভিয়েতনাম থেকে নারিকেল চারা আর আনা হবে না বলে তিনি জানান। তিনি জানান, আগে বছরে প্রতি গাছে ফলন ধরত ৫০টি, এখন ধরে ৩৫টি। ফলে উৎপাদন কমছে। তিনি জানান, ডাবের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় নারিকেল পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে চারার সংকট রয়েছে।

 

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!