দেশে ১৮ বছর হওয়ার আগেই ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে

  • আপডেট সময় শনিবার, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৩
  • 101 পাঠক

দিশারী ডেস্ক। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

রাজধানীর শঙ্করে নিজেদের বাড়িতে বাস করত মেয়েটি। তেজগাঁও কলেজে পড়াশোনা করত। সেই কলেজেই একটি ছেলের সঙ্গে তার প্রেম হয়। ২০২১ সালে তারা বিয়ে করে। তখন দুজনের বয়সই ১৮ বছরের নিচে। পরিবারের কেউ তাদের বিয়েতে রাজি ছিল না। তারা নিজেরাই বিয়ে করে। মেয়েটি এক বছরের মধ্যে একটি কন্যা সন্তান জন্ম দেয়। এরপর আর পড়াশোনা হয়নি তার।

ছেলেটি এখন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। বাড়ি থেকে তার হাত খরচের টাকা দিলেও তার বাচ্চার জন্য কোনো খরচ দেয় না। মেয়েটি এক দিন ‘ ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স ’ অফিসে আসে অফিস সহকারীর চাকরির জন্য। প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক রোকসানা সুলতানা তাকে বলেন, তুমি আবার পড়াশোনা করো, তোমাকে আমি এই চাকরি দিতে পারব না।

এ ব্যাপারে রোকসানা সুলতানা বলেন, আজ-কাল ছেলেমেয়েরা প্রেমের সম্পর্ক জড়িয়ে ১৮ বছরের আগেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। পরিবার আপত্তি করলে তারা বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। কেউ কেউ আবার বিয়ে না দিলে আত্মহত্যা করে কিংবা করার হুমকি দেয়।

শহর-গ্রাম, ধনী-গরিব সবক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটে বলে সরকারের সমাজ সেবা অধিদপ্তর ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর পরিচালিত হেল্পলাইনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়। গত ২৪ আগস্ট সমাজ সেবা অধিদপ্তরে গিয়ে জানা যায়, নিজেরা জোর করে বাল্যবিবাহ করছে প্রতি সপ্তাহে এমন দুই-তিনটি ফোনকল আসে ১০৯৮ নাম্বারে।

ওইদিনই বরিশাল থেকে এমন একটি ফোন আসে। যে ফোন কলে ১৬ বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া মেয়েকে তার ছেলে বন্ধুর সঙ্গে পালিয়ে ঢাকায় আসার কথা জানান বাবা। ১০৯৮-এর ব্যবস্থাপক চৌধুরী মো. মোহাইমেন বলেন, ২০২৩ সালের ছয় মাসে নিজেরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে বিষয়ে ৩৬টি কল আসে। তবে প্রকৃত ঘটনা আরো অনেক বেশি, সব ঘটনার ফোন আমাদের কাছে আসে না।

বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি-২০২৩ প্রতিবেদনে বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে ২০০৬ থেকে ২০২২ সালের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়সের আগেই ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে।

জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক সংস্থা ইউএনএফপিএ-র এই সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে এখন এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। এমন পরিস্থিতির মধ্যে আজ বিনিয়োগে অগ্রাধিকার কন্যা শিশুর অধিকার’ প্রতিপাদ্য করে পালিত হচ্ছে জাতীয় কন্যা শিশু দিবস।

সংশ্লিষ্টদের মতে করোনা ও এর পরবর্তী সময় যেমন দারিদ্র্য ও নিরাপত্তা হীনতার কারণে বাল্যবিয়ে হার বেড়েছে, তেমনি কিশোর-কিশোরীদের বড় একটা অংশ নিজেরাই ১৮ বছর হওয়ার আগে বিয়ে করছে।

এছাড়া করোনাকালে শিক্ষার্থীদের হাতে মোবাইল ফোন চলে যাওয়ায় পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হওয়া, নিজেদের মধ্যে শাররিক সম্পর্ক তৈরি করা, ফেসবুকের মাধ্যমে প্রেমে প্রতারণার শিকার হওয়ার মতো কারণগুলোও বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে তারা উল্লেখ করেন। এর ফলে পরিবারে অশান্তি, শিশুদের ভবিষ্যত্ নষ্ট হওয়া, অল্প বয়সে মা হওয়ার জন্য শাররিক নানা রকম জটিলতা দেখা দেয়। অনেকেই নিজেকে এক কেন্দ্রিক করে আত্মহত্যার পথও বেছে নেয় বলে জানান মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ  বলেন, এক গবেষণায় দেখা যায় কিশোর-কিশোরীদের ১৪-২৯ বছর বয়সে আত্মহত্যার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে প্রেম ও বিয়ে।

১৮ বছরের আগে শুধু শহরের বিয়ে বেড়েছে তা নয়, মফস্সল শহরগুলো থেকেও আমরা এমন অনেক কেস পাই। মফস্সলের ছেলেমেয়েরা মনে করে প্রেম করে শাররিক সম্পর্কে জড়ানো বড় স্মার্টনেস। এর ভিডিও ধারণ করাও স্মার্টনেসের অংশ। এ সময় তাদের মানসিক বৈকল্য শুরু হয়। তারা নেশাগ্রস্ত হয়, নিজেদের হাত কাটে। আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থকে।’

তিনি আরো বলেন, ‘শিশুদের বোঝাতে হবে নারী-পুরুষের বন্ধুত্ব স্বাভাবিক। শিশুদের সঠিক শৈশব নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন। তাদের সংবেদনশীলতা, ক্ষমতায়ন হওয়া, ইতিবাচক হতে সহযোগিতা করা এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারার পরিবেশ দিতে হবে।’

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো হানিফ বলেন, একজন শিশুর ১৮ বছর কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২১ বছর লাগে পূর্ণ মানুষ হতে। এর আগে কোনো মেয়ে যদি মা হয় তাহলে তার নিজের ও শিশুর পুষ্টি ঘাটতি দেখা দেয়। প্রতিবন্ধী শিশুর জন্মও হতে পারে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক সুরাইয়া বেগম বলেন, কিশোরী মা হলে রক্তস্বল্পতা, খিঁচুনি প্রভৃতি জটিলতার আশঙ্কা অনেক বেশি হয়। মা ও শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি থাকে।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্প পরিচালক ড. প্রকাশ কান্তি চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী বাল্যবিবাহ রোধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছেন। হেল্প লাইনের মাধ্যমে অনেক বাল্যবিবাহ ও শিশু নির্যাতন বন্ধ করা হয়েছে।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!