২০২৩ সালে ২৯০ জন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার

  • আপডেট সময় রবিবার, ডিসেম্বর ৩১, ২০২৩
  • 90 পাঠক

দিশারী ডেস্ক। ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ।

২০২৩ সালে ২৯০ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি ও পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন বলে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।

রোববার (৩১ ডিসেম্বর) সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে আসক আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়।

এ সময় আসকের চেয়ারপারসন মানবাধিকারকর্মী সিনিয়র অ্যাডভোকেট জেডআই খান পান্না, নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সলসহ নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাধারণ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার বিষয়ে আসকের তথ্যানুসন্ধানের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।

প্রতিবেদনে জানানো হয়, নির্যাতিত সাংবাদিকদের মধ্যে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে হামলার শিকার হয়েছেন অন্তত ৭৮ জন সংবাদকর্মী। সংবাদ প্রকাশের জের ধরে বাংলানিউজ২৪.কমের জামালপুর প্রতিনিধি ও ৭১ টিভির বকশীগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিমকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ ছাড়াও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাধ্যমে লাঞ্ছিত এবং পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় বাধার শিকার হয়েছেন ২২ জন সাংবাদিক। ২০২২ এ এই সংখ্যা ছিল ২২৬।

বহুল আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ আবারও পিছিয়েছে। এ নিয়ে মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ ১০৪ বারের মতো পেছাল।

এ ছাড়া জীবনের অধিকারের বিভিন্ন দিকও এই পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়। যার মধ্যে রয়েছে-

বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতন

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা হামলা শিকার হচ্ছেন। বিশেষত প্রথম আলোর সাভার প্রতিনিধি শামসুজ্জামানকে সিআইডি পরিচয়ে ভোরে তুলে নিয়ে যাওয়া এবং দিনভর তাকে আটকের বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে অস্বীকার করায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায়োগিক আচরণ যে অসঙ্গত ও বেআইনি তা প্রতীয়মান হয়েছে।

এ ধরনের অমানবিক আচরণের অভিযোগ সাতক্ষীরা জেলায় কর্মরত সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁকে আটকের সময়ও পুলিশের বিরুদ্ধে উঠেছিল। রঘুনাথকে আটকের পর পুলিশ দিনভর তা অস্বীকার করে প্রায় ৯ ঘণ্টা পর একটি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখায়।

২০২২ সাল থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যাগত দিক কমে এলেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি কিংবা এক্ষেত্রে অভিযোগগুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত ও সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা যায়নি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে সংগৃহীত আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ি ২০২৩ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ২০ জন।

এসব ঘটনার মধ্যে পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে কক্সবাজার জেলায় সাজেদুল ইসলাম মান্না এবং নারায়ণগঞ্জে র‌্যাবের গুলিতে আবুল কাশেম নিহত হন। এ ছাড়া পুলিশের হেফাজতে ১৩ জন, র‌্যাবের হেফাজতে দুইজন ও ডিবি (গোয়েন্দা) পুলিশের হেফাজতে তিনজন নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। ২০২২ সালেও ১৯ জন নাগরিক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল।

কারা হেফাজতে মৃত্যু

২০২৩ সালে দেশের বিভিন্ন কারাগারে অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে মারা গেছেন ১০৫ জন। এর মধ্যে কয়েদি ৪২ জন ও হাজতি ৬৩ জন। এদিকে ২০২২ সালে কারা-হেফাজতে মারা যান ৬৫ জন। এর মধ্যে কয়েদি ছিলেন ২৮ জন এবং হাজতি ছিলেন ৩৭ জন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ ও গুম

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে সংগৃহীত আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ৯ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে পরে ছয়জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং পরে ফিরে এসেছেন তিনজন।

সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে আটকের ঘটনা ঘটছে। পরিবার ও স্বজনদের দাবিতে এই গ্রেপ্তার বা আটকের কোনো তথ্য না দিয়ে সরাসরি নাকোচ করে দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন অভিযোগে উল্লিখিত আটক ব্যক্তিদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরে গ্রেপ্তার দেখান। আটক ও গ্রেপ্তার দেখানোর সময়কালের মধ্যে যে যথেষ্ট ফারাক তার কোনো ব্যাখ্যাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এতে দেশের প্রচলিত আইন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হচ্ছে।

সীমান্ত হত্যা ও নির্যাতন

প্রায় প্রতি বছরই ভারতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সীমান্ত হত্যা বন্ধে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছেন। তবে তাদের প্রতিশ্রুতির কোনো বাস্তবায়ন ঘটেনি।

আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের হিসাবমতে, ২০২৩ সালে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে ৩০ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে লালমনিরহাটে তিনজন, সুনামগঞ্জে একজন, ঝিনাইদহে একজন, দিনাজপুরে দুইজন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে তিনজন, চুয়াডাঙ্গায় পাঁচজন, পঞ্চগড়ে পাঁচজন, কুড়িগ্রামে একজন, ঠাকুরগাঁয়ে চারজন, সিলেটে একজন, মৌলভীবাজারে একজন ও রাজশাহীতে তিনজন নিহত হয়।

এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় বিএসএফের মাধ্যমে ৩১ জন নাগরিক মারাত্মক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ২০২২ সালে বিএসএফের হাতে নিহত হয় ২৩ জন বাংলাদেশি।

গণপিটুনি

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৫১ জন। এদিকে ২০২২ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিল ৩৬ জন।

মানবাধিকার রক্ষায় বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তা বাস্তবায়ন করার দায়িত্বও সরকারের। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য মর্যাদাপূর্ণ ও সম-অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সরকার ও নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন বলে মনে করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।

প্রতিবেদনে ওঠে আসা অবস্থার প্রেক্ষিতে আসক বেশ কিছু সুপারিশ করে। যার মধ্যে রয়েছে –

১) রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মাধ্যমে যেকোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যেমন- বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুমের অভিযোগ, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এখতিয়ারবহির্ভূত আচরণ ইত্যাদির অভিযোগ উঠলে তা দ্রুততার সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে হবে এবং সম্পৃক্তদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে শান্তি প্রদান করতে হবে।

২) এ পর্যন্ত সংঘটিত সকল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তদন্তে নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

৩) দেশের যেকোনো নাগরিককে আটক বা গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা সম্পূর্ণভাবে মেনে চলতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

৪) মিথ্যা মামলা বা গায়েবি মামলা সংক্রান্ত যে অভিযোগগুলো উঠেছে সেগুলো আমলে নিয়ে অভিযোগের যথাযথ নিষ্পত্তি নিশ্চিত করার জন্য জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

৫) নাগরিকের সমবেত হওয়ার অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশের অধিকার যথাযথভাবে চর্চা করার পরিবেশ তৈরি এবং জনদুর্ভোগ এড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি ভিন্নমত প্রকাশকারীদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ কিংবা কোনো ধরনের ভীতি প্রদর্শন থেকে বিরত থাকতে হবে।

৬) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পেশাদারত্বের আওতায় রেখে তাদের কর্মপরিধি নিশ্চিত করতে হবে।

৭) নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করতে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক আইনগুলোতে পরিবর্তন আনতে হবে। পাশাপাশি অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা ও যৌন হয়রানি রোধে কার্যকর ব্যবস্থ্যা গড়ে তোলার জন্য তদন্তসাপেক্ষে আইন অনুযায়ি দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!