জীবিকার ধমকে ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ ?

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, জানুয়ারি ৯, ২০২৪
  • 70 পাঠক

————————————————————————————————————————————–

দেশে ৭ হাজারের বেশি ইটভাটা, ব্লক তৈরি করছে মাত্র ৪০টি প্রতিষ্ঠান, ২০২৫ সালের মধ্যে ইটভাটা বন্ধের উদ্যোগ

—————————————————————————————————————————————

দিশারী ডেস্ক। ৯ জানুয়ারি, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।

ইটভাটার দূষণে বিপন্ন হয়ে ওঠেছে দেশের পরিবেশ। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ইট তৈরির তোড়জোড় শুরু হওয়ায় প্রাকৃতিক পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে। ইটের প্রধান উপকরণ মাটি আহরণে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে আবাদি জমির টপসয়েল। নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য।

প্রধানত দেশে শুষ্ক মৌসুমে পাঁচ থেকে ছয় মাস ইট উৎপাদিত হওয়ায় একদিকে বায়ুমন্ডলে ধুলোবালির প্রাদুর্ভাব বাড়ে, অন্যদিকে ইটভাটাগুলো থেকে নির্গত দূষিত উপাদানের কারণে বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।

এ সম্পর্কিত গবেষণায় দেখা যায়, বছরে প্রায় ১৫ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন টন কার্বন ডাইঅক্সাইড ইটভাটা থেকে বায়ুমন্ডলে যোগ হচ্ছে। এ দূষণের ভয়াবহতা রোধে ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের প্রচলিত ইটভাটাগুলো বন্ধ করে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ওই সময় থেকে সরকারি সব স্থাপনায়ও ইটের ব্যবহার বন্ধ করে পরিবেশবান্ধব ব্লক ব্যবহার করা হবে।

তবে সরকারি এ ঘোষণা বাস্তবায়নে প্রস্তুতি খুবই কম। দেশে ৭ হাজারের বেশি ইটভাটায় ইট তৈরি হলেও ব্লক তৈরি করছে মাত্র ৪০টি প্রতিষ্ঠান।

জানা যায়, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পোড়া ইটের বদলে ব্লক ব্যবহারে উৎসাহিত করতে জাতীয় সংসদে বিল উত্থাপন করা হয়। ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) বিল-২০১৩’ সংশোধনের জন্য সংসদে একটি বিল উত্থাপন করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। সংসদে সেই বিল পাস হওয়ার পর একই বছরের ২৪ নভেম্বর মন্ত্রণালয় থেকে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ (সংশোধিত ২০১৯)-এর ধারা ৫(৩ক)-এ দেয়া ক্ষমতাবলে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, মাটির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে কমানোর উদ্দেশ্যে সব সরকারি নির্মাণ, মেরামত ও সংস্কার কাজে ভবনের দেয়াল ও সীমানাপ্রাচীর, রাস্তা এবং গ্রাম সড়ক টাইপ-বি’র ক্ষেত্রে ইটের বিকল্প হিসেবে ২০২৫ সালের মধ্যে ব্লক ব্যবহার বাধ্যতামূলক।

উল্লেখ্য, ইট উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ। দেশে ৭ হাজারের বেশি ইটভাটায় বছরে প্রায় ২৩ বিলিয়নের বেশি ইট উৎপাদিত হচ্ছে। দ্রুত বিকাশমান উন্নয়ন কর্মকান্ডে ইটের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে।

১০ লাখের বেশি মানুষ দেশের ইটভাটাগুলোয় কর্মরত। বছরে প্রায় ৫ দশমিক ৬৮ মিলিয়ন টন কয়লা ইটখোলাগুলোয় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশে ইট তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় মাটি।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বছরে প্রায় ৩৩ হাজার ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট মাটি ইট তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। দেশে বিভিন্ন পদ্ধতিতে ইট তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে ফিক্সড চিমনি সবচেয়ে পুরনো পদ্ধতি। এ ক্ষেত্রে ধোঁয়া নির্গমনের জন্য প্রায় ১২০ ফুট লম্বা চিমনি ব্যবহৃত হয়। ওই পদ্ধতিতে দেশে প্রায় ৪ হাজার ৫০০ ইটভাটায় ইট তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে জিগজাগ, হাইব্রিড হফম্যান ও টানেল পদ্ধতিতেও ইট তৈরি হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে টানেল পদ্ধতি সবচেয়ে আধুনিক এবং অনেকটা পরিবেশবান্ধব; যদিও এ পদ্ধতিতে ইট উৎপাদনকারী কারখানার সংখ্যা খুবই কম।

ইট উৎপাদনের দূষণ নিয়ে এক গবেষণায় দেখা গেছে, ফিক্সড চিমনি পদ্ধতিতে ১ হাজার ইট উৎপাদনে প্রায় ৪২৮ কেজি কার্বন ডাইঅক্সাইড বায়ুমন্ডলে যোগ হচ্ছে।ওই হিসেব অনুযায়ী প্রতিটি ইট তৈরিতে ৪২৮ গ্রামের বেশি কার্বন ডাইঅক্সাইড বায়ুমন্ডলে যোগ হচ্ছে, যা পরিবেশ দূষণে ভূমিকা রাখছে।

গবেষণায় বলা হয়, ইটভাটার দূষণে বর্তমানে বায়ুতে পার্টিকুলেটস ম্যাটারের অতিরিক্ত উপস্থিতিতে মানুষের মৃত্যুর হার তিন গুণ বেড়েছে। বায়ুতে মাত্রাতিরিক্ত সালফার ডাইঅক্সাইডের উপস্থিতির কারণে মানুষ চোখ, নাক, গলাসহ অ্যাজমাটিক সমস্যার সম্মুুখীন হচ্ছে।

ইটভাটার দূষণের কারণে ফুসফুসে ক্যান্সার, হার্ট অ্যাটাক ও অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাবে মৃত্যুর হার বেড়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ইটভাটার দূষণ রোধে দেশে নির্মাণ খাতে পরিবেশবান্ধব ব্লকের ব্যবহার বাড়াতে সরকারকে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে। ইটভাটা যেভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে রয়েছে তেমনি দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ব্লক তৈরির অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। নইলে ব্লকের ব্যবহারে যে পরিমাণ সাশ্রয় হয় তা ব্লক পরিবহন ও স্থানান্তরেই ব্যয় হয়ে যাবে। বিদ্যমান ইটভাটাগুলোকে বাছাই করে ব্লক তৈরির ইউনিটে রূপান্তর করার ক্ষেত্রে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। যারা এখন ইট তৈরি করছে তাদের পরিবেশবান্ধব ইট তৈরির জন্য উৎসাহিত করতে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগই নেয়া হচ্ছে না।

অন্যদিকে বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের বিস্তৃত অবকাঠামো উন্নয়নে দেশে বছরে যে পরিমাণ ইটের ব্যবহার হচ্ছে, সে তুলনায় ব্লকের উৎপাদন মোট চাহিদার ক্ষুদ্রতম অংশমাত্র।

নোয়াখালীর একজন স্বত্বাধিকারী আজিজুল ইসলাম বলেন, পরিবেশ দূষণ আমাদের কাম্য নয়। পরিবেশ নষ্ট হোক আমরা তা চাই না। কিন্তু পরিবেশবান্ধব ইট তৈরি করতে সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের কোনো সহযোগিতা বা প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে না। আর্থিক, প্রযুক্তিগত ও তথ্যগত প্রণোদনা দেয়া না হলে রাতারাতি ইটভাটা বন্ধ করা সম্ভব নয়। কারণ আমরা একটি ইটভাটায় ৮-১০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। তা ছাড়া হঠাৎ সব ইটভাটা বন্ধ করে দেয়া হলে দেশে সকল প্রকার উন্নয়ন কর্মকান্ড থমকে যাবে। দেশে ইটের সংকট তৈরি হবে। পরিবেশ রক্ষা ও ব্যবসায়ীদের রক্ষার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ দরকার।

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক বলেন, পরিবেশ অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে প্রতিটি ইটভাটার বায়ুর গুণাগুণ পরীক্ষা করার জন্য ল্যাবরেটরি স্থাপন করা যেতে পারে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বাসস্থান তৈরি ও দেশব্যাপী উন্নয়ন কর্মকান্ডের জন্য ইটভাটার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে ইটভাটা থেকে নির্গত দূষিত উপাদানের প্রভাবে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে এসব ঝুঁকি রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েই ইট উৎপাদন অব্যাহত রাখা যেতে পারে।

নোয়াখালীর সুবর্ণচরের ২৭ দ্রোন এলাকায় ফসলী জমি আয়ত্ব করে আবদুর রহমানের ইটভাটায় পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। অন্যদিকে ওই ভাটায় প্রকাশ্য গাছকাটার মেশিন বসিয়ে ভয়াবহভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে সরকারী রাস্তা আর ব্যক্তিমালিকানার গাছ। তার কার্যালয়ে সরেজমিনে গেলে স্থানীয় সংসদ সদস্যের একটি ছবি টাঙ্গানো দেখা গেছে। এসব বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর হতে কোন ধরনের ছাড়পত্রসহ কোন আইনানুগপত্রই নেই তার হাতে। তথাপি মুঠোফোনে আবদুর রহমান দম্ভোক্তি করে বলেছেন, আপনারা ছবিসহ যাহাই দরকার নিয়ে যান। তাতে নাকি তার কিছুই যাবেওনা। আসবেওনা। বললেন, আমি এমপির লোক।

একইভাবে, লক্ষীপুরের রামগতির চৌধুরীর হাট এলাকায় পুরো এলাকাজুড়ে পরিবশে অধিদপ্তরের ছাড়পত্রসহ সরকারী কোন অনুমোদন ছাড়াই দেখা গেছে কমপক্ষে ৪০টিরও বেশি ইটখোলা। আশেপাশের বাড়ি-ঘরের লোকজনের সুস্থ্যতার কোন বালাই নেই। লেগে আছে সর্দি, কাশি, হাঁচি। জ¦র-তাপ। স্থানীয়রা বলছেন, এসব ভাটার মালিকেরা অর্থশালী ও রাজনৈতিক র্কীতিশালার সদস্য হিসেবে জড়িত থাকায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কেহ নেই।

স্থানীয়রা আরো বলেছেন, আমাদের রোগ, শোকের কথা এখন আর কেহই ভাবেনা। বললেন, এটাই আমাদের নিত্যজীবন। বরং প্রতিবাদ করলে, তারা বলে আমাদের জীবিকার ব্যবস্থা করতে নাকি এসব হচ্ছে। তবে মাঝেমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের হারুন নামের এক ব্যক্তি এসে নাকি সুবিধা নিয়ে চলে যায়।

 

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!