দিশারী ডেস্ক। ১৬ জানুয়ারি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।
অপ্রতুল চিকিৎসাসেবা, অভাব, অনটনসহ নানামুখী সংকটের মোকাবেলায় দেশের বেশির ভাগ মানুষই চিকিৎসক ও হাসপাতালের দ্বারস্থ হননা। চিকিৎসকদের প্রাইভেট চেম্বারেও এখন সিরিয়াল পাওয়া যেন সোনার হরিণের মতোই কঠিন হয়ে ওঠেছে। ওষুধ কেনার জন্য ভিড় লেগে থাকে ওষুধের দোকানেও। তবে শুধু কি ওষুধ কেনা ! রীতিমতো চাঞ্চল্যকর তথ্য ওঠে এসেছে খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠানের জরিপ থেকেই।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত ১৪ ডিসেম্বর প্রকাশিত জরিপের প্রতিবেদনে ২১টি মেথডে দেশের মানুষের চিকিৎসার চিত্র তুলে ধরে। অর্থাৎ বিবিএসের সর্বশেষ জরিপের ফলাফল অনুসারে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রোগীর ঠাসাঠাসি থাকলেও এখনো দেশের মানুষ সর্বোচ্চ হারে (৫৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ) চিকিৎসা নিয়ে থাকেন ফার্মেসি থেকে ! এরপরেই নন-কোয়ালিফাইড চিকিৎসকদের (হাতুড়ে) কাছ থেকে চিকিৎসা নেন ১৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। সব মিলিয়ে ৬৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ মানুষই চিকিৎসা নিচ্ছেন অস্বীকৃত মাধ্যম থেকে।
এই সূত্র ধরে খোঁজখবর নিতে গেলে রাজধানীর বসিলা এলাকার একটি ফার্মেসির বিক্রয়কর্মী নিজের ও ফার্মেসির নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে জানান, তিনি ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন ফার্মেসিতে কাজ করতে করতে শিখেছেন। নিজের ডিপ্লোমা নেই। তবু আশপাশের এলাকায় বেশ কিছু বস্তি থাকায় প্রতিদিন অনেক মানুষ আসেন বিভিন্ন রোগের ওষুধ নিতে। কিছু রোগের উপসর্গ শুনে তিনি নিজেই ওষুধ দেন, আবার কিছু ওষুধ দেন তার মালিক।
আরেক ফার্মেসিতে আসা রাজধানীর হাজারীবাগের গৃহকর্মী গোলেনূর বেগম বলেন, ‘আমার ছোড পোলাডার পেটে অসুখ আর জ্বর অইছে। এহনতে এই দোকানে আইছি। দোকানদার ভাইরে কইছি সমস্যার কতা। ভাই তিনডা ওষুধ দিছে। দেহি খাওয়াই কী অয়!’
হাসপাতালে যান নাই কেন, জানতে চাইলে গোলেনূর বলেন, ‘বাসা থেইক্যা সরকারি হাসপাতাল বহুত দূর। হেইহানে বাসে যাইতে সময় লাগব, হাইট্টা যাইতে পারুম না। আর রিকশায় গেলে ১০০ টাহা লাগব। অত টাহা খরচের উপায় নাই। এইহানে কোনো বাড়তি টাহা দেওন লাগে না। আইয়া কইলেই ওষুধ পাওন যায়।’
বাংলাদেশ জনস্বাস্থ্য সমিতির সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন বলেন, ‘ আমরা যে এখনো দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য গুণগত বা মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে পারিনি তার একটি প্রমাণ এই জরিপে পাওয়া যায়।
অন্যদিকে সাধারণত সচেতন, শিক্ষিত ও আর্থিক সচ্ছল পর্যায়ের মানুষ সহসা এখন আর ফার্মেসি বা কোয়াকের কাছে যান না। তারা প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসাকেন্দ্র বা স্বীকৃত ডাক্তারদের কাছেই যান। ফলে যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন, যারা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত এবং যারা আর্থসামাজিক সীমাবদ্ধতার শিকার তারাই বেশি অপ্রাতিষ্ঠানিক বা অস্বীকৃত চিকিৎসা নিতে যান।’
সাবেক ওই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, ‘ নিম্ন আয়ের কিংবা কম সুবিধাপ্রাপ্ত এলাকার মানুষের কাছে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছাতে আরও কাজ করতে হবে। কারণ কম আয়ের মানুষ ডাক্তারের ফি, হাসপাতালের সার্ভিস চার্জ, হাসপাতালে যাতায়াত এড়াতে ঘরের কাছে যে চিকিৎসা সহজে পান সেটাই লুফে নেন।’
আরেক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, এই জরিপের মাধ্যমে প্রমাণ মিলছে যে মানুষ তার হাতের নাগালে সহজে যে চিকিৎসা পান সেটাই গ্রহণ করেন। অন্যদিকে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে যে ভিড় দেখা যায়, সেখানে রোগীর চেয়ে রোগীর স্বজনদের ভিড় বেশি থাকে বলে ঠাসাঠাসি চিত্র চোখে পড়ে।
ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, ফার্মেসি ও অস্বীকৃত চিকিৎসকদের মিলে যে হার বিবিএসের জরিপে ওঠে এসেছে সেটাই বাস্তবতা। মানুষ সাধারণ জ্বর, সর্দি-কাশি, পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া, গ্যাস্ট্রিকের মতো অসুখের জন্য সবার আগে ঘরের কাছে ফার্মেসিতে গিয়ে নির্দিস্ট রোগের কথা জানিয়ে ওষুধ চান। এতে মানুষ তাৎক্ষণিক উপকৃত হলেও বিপদও আছে। এ ক্ষেত্রেও সরকারের উচিত হবে চিকিৎসার এসব প্রাথমিক উৎসকে নানাভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলা। তাতে আনুষ্ঠানিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চাপ কমবে এবং মানুষ আরও নিরাপদ হবেন।
বিবিএসের জরিপের তথ্যে অন্য ক্যাটাগরির মধ্যে প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যান ( ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ), স্বীকৃত ডাক্তারের চেম্বারে যান (৯ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ), উপজেলা সরকারি হাসপাতালে যান ২ দশমিক ৯৪ শতাংশ, সরকারি জেলা ও সদর হাসপাতালে যান ২ দশমিক ১৩ শতাংশ, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত হাসপাতালে যান মাত্র ১ দশমিক ২৬ শতাংশ, সরকারি মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত হাসপাতালে যান মাত্র শূন্য দশমিক ১২ শতাংশ, অন্যান্য ছোটখাটো সরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেন শূন্য থেকে দশমিক ১৮ শতাংশ।
সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছ থেকে চিকিৎসা নেন শূন্য দশমিক ৪৭ শতাংশ মানুষ, সরকারি স্যাটেলাইট ক্লিনিক থেকে নেন শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ, কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে নেন ১ দশমিক ১৬ শতাংশ, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপকেন্দ্র থেকে নেন শূন্য দশমিক ৪৮ শতাংশ, মাতৃ ও শিশুসেবা কেন্দ্র থেকে চিকিৎসা নেন শূন্য দশমিক ২৮ শতাংশ, বিভিন্ন এনজিওর স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে চিকিৎসা নেন শূন্য দশমিক ১৩ শতাংশ, এনজিওর ক্লিনিক থেকে শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ, হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারদের কাছ থেকে ১ দশমিক ৫৬ শতাংশ, কবিরাজ, হেকিম আয়ুর্বেদিক থেকে শূন্য দশমিক ৪৮ শতাংশ, পীর, ফকির, তান্ত্রিক, ওঝা থেকে শূন্য দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, পরিবারের সদস্যের কাছে বা নিজে নিজে চিকিৎসা নেন ১ দশমিক ২২ শতাংশ এবং অন্যান্য পদ্ধতির চিকিৎসা নেন শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. আ ব ম ফারুক বলেন, সরকার মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার জন্য অনেক উদ্যোগ নিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। মানুষ খুব নিরুপায় না হলে সহসা হাসপাতালে যেতে চান না। অনেকেই হাসপাতাল ও ডাক্তারখানাকে ঝামেলা মনে করেন। মানুষের মন থেকে এই ভয় দূর করতে হবে।
অন্যদিকে ফার্মেসিগুলোকে আরও নজরদারির আওতায় আনতে হবে। মডেল ফার্মেসির পরিধি বাড়াতে হবে। নিবন্ধনের বাইরে থাকা ফার্মেসিগুলোকে কীভাবে মানসম্মত করা যায়, সে জন্য আরও কাজ করতে হবে। তাতে করে সাধারণ মানুষ কিছুটা হলেও নিরাপদ চিকিৎসাসেবা পেতে পারেন।
Leave a Reply