গবেষণা : চকচকে চালে পুষ্টি কম

  • আপডেট সময় শনিবার, জানুয়ারি ২০, ২০২৪
  • 82 পাঠক

——————————————————————————————————
চাল চকচকে করতে গিয়ে বেশি ছাঁটাই করা হয় আধুনিক চালকলগুলোতে। নীতিমালা মানা হচ্ছে না।

——————————————————————————————————-

দিশারী ডেস্ক। ২০ জানুয়ারি, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।

দেশের আধুনিক চালকলগুলোতে চালের ১০ থেকে ২০ শতাংশ ছাঁটাই করে ফেলা হয়। যে অংশটুকু বাদ পড়ে, সেটাই চালের সবচেয়ে পুষ্টিকর উপাদান। চালকলমালিকেরা চাল চকচকে করতে গিয়ে ছাঁটাই করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) ১০ জন গবেষকের এক যৌথ গবেষণায় ওঠে এসেছে, চাল ছাঁটাইয়ের ফলে মানুষ পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ছেঁটে ফেলার পর চালে থাকে মূলত কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা।

‘ বাংলাদেশের জনপ্রিয় উচ্চফলনশীল জাতের সেদ্ধ ও চকচকে (পলিশ) চালে পুষ্টি উপাদানের তারতম্য ’ শীর্ষক গবেষণাটি নিয়ে একটি নিবন্ধ গত নভেম্বরে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী ফুডস–এ প্রকাশিত হয়েছে। গবেষকেরা জানিয়েছেন, গবেষণাটির ফলাফল খাদ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে।

চালের যে অংশ ছেঁটে ফেলা হয় (উপজাত) তা মুরগি ও মাছের খাদ্য এবং কুঁড়ার তেল উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। ২০২২ সালে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) থেকে ‘ বাংলাদেশে চালের দাম বৃদ্ধির একটি সমীক্ষা : কৃষক থেকে ভোক্তাপর্যায়ের অবস্থা ’ শীর্ষক আরেকটি গবেষণায় বলা হয়েছিল, চালের ছেঁটে ফেলা অংশ বেশ ভালো দামে বিক্রি করেন মিলমালিকেরা। চাল ও উপজাত বিক্রি করে তাঁরা বিপুল মুনাফা করেন।

বিষয়টি নিয়ে খাদ্যসচিব মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, মিলগুলোতে চাল ছাঁটাইয়ের বিষয়ে একটি নীতিমালা করে দেয়া হয়েছে। নীতিমালায় চাল ১০ শতাংশের বেশি ছাঁটাই না করতে বলা হয়েছে। এর ব্যতিক্রম হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলা হয়েছে।

——————————————————————————————–

দেশের দরিদ্র মানুষের পুষ্টির অন্যতম উৎস ভাত। ওই পুষ্টি উপাদানগুলো ছাঁটাইয়ের সময় চাল থেকে বাদ দেয়া বন্ধ করতে হবে। নাজমা শাহীন, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট।

——————————————————————————————–
বাংলাদেশে বছরে ৩ কোটি ৯০ লাখ টনের মতো চাল উৎপাদিত হয়। এই চালের একটি বড় অংশ স্বয়ংক্রিয় চালকলে ধান থেকে উৎপাদন করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এবং ব্রির যৌথ গবেষণায় পরীক্ষার জন্য ধানের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে এবং বিভিন্ন সময়ে। ধানের মূল জাতের নমুনা নেয়া হয়েছে ব্রির জিনব্যাংক থেকে। সংগ্রহ করা ধান থেকে চাল উৎপাদন করা হয় বিভিন্নভাবে প্রক্রিয়া করে, যাতে চালের পুষ্টিগুণের তুলনামূলক চিত্র পাওয়া যায়।

গবেষণাটিতে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় উচ্চফলনশীল পাঁচটি জাতের চালের পুষ্টিগুণ দেখা হয়। জাতগুলো হলো বিআর–১১, ব্রি ধান–২৮, ব্রি ধান–২৯, ব্রি ধান–৪৯ ও ব্রি ধান–৮৪। ওই জাতগুলোতে জৈবিকভাবে যে পরিমাণে শর্করা, খনিজ উপাদান, ভিটামিন থাকার কথা, সেই পরিমাণে আছে কি না, তা পরীক্ষা করেন বিজ্ঞানীরা। দেখা যায়, শুধু ব্রি ধান–৮৪ প্রক্রিয়াজাত করতে গিয়ে খনিজ উপাদান ও সব ধরনের ভিটামিন অটুট থাকছে। বাকি জাতের ক্ষেত্রে ছাঁটাই করার ফলে পুষ্টিকর উপাদান বাদ পড়ছে।

ব্রির গবেষণায় ওঠে আসে, দেশে ধান ও চালের বাজারে কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পাঁচবার হাতবদল হয়। প্রতিবার হাতবদলের সময় যোগ হয় খরচ আর মুনাফা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ও অস্বাভাবিক মুনাফা করেন চালকলমালিকেরা।

সেদ্ধ ও আতপ চালে জাতভেদে পুষ্টিগুণ পরিবর্তনের হার ভিন্ন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো কোনো উপাদান ছাঁটাইয়ের ফলে বাড়ছে। তবে সার্বিকভাবে পুষ্টিগুণ কমে যাচ্ছে। যেমন ১০ শতাংশ ছাঁটাইয়ের ফলে চালে আমিষ কমেছে ৯ থেকে ১৮ শতাংশ।

বিভিন্ন হারে কমেছে চর্বি বা ফ্যাট, ভিটামিন ও খনিজ উপাদান। চালে সাধারণত—ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন, জিংক, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও ফসফরাসসাত ধরনের খনিজ উপাদান থাকে।

গবেষকেরা বলছেন, মানুষ চকচকে চাল খেয়ে যেসব পুষ্টি উপাদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, সেগুলো পরে আবার ওষুধ হিসেবে গ্রহণ করতে হচ্ছে। আবার সরকারও চালে পুষ্টিকণা মেশায় বিশেষ কর্মসূচির মাধ্যমে। পুষ্টিবিদেরা মনে করেন, অতিরিক্ত শর্করা মানুষের ওজন বাড়িয়ে দেয়। আর খাবারে আঁশ কম থাকলে বাড়ে কোষ্ঠকাঠিন্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও গবেষণাটির দলনেতা নাজমা শাহীন  বলেন, দেশের দরিদ্র মানুষের পুষ্টির অন্যতম উৎস ভাত। ওই পুষ্টি উপাদানগুলো ছাঁটাইয়ের চাল থেকে বাদ দেয়া বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, এ জন্য শুধু নীতিমালা করলে হবে না, তা অনুসরণ করা হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করতে নিয়মিত তদারক করতে হবে।

নাজমা শাহীন আরও বলেন, ভোক্তাদেরও চকচকে চাল কেনার অভ্যাস দূর করতে হবে। চকচকে করতে গিয়ে পুষ্টিকর উপাদানগুলো বাদ দেয়া হয়।

চালে বেশি ছাঁটাই করলে বেশি উপজাত পাওয়া যায়। সেটা বিক্রি করে আয় করেন চালকলমালিকেরা। ফলে ছাঁটাইয়ে তাঁদের ব্যবসার কোনো ক্ষতি হয় না।

ব্রির গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতি কেজি ধান ভাঙিয়ে ৬০০ থেকে ৬৫০ গ্রাম চাল পাওয়া যায়। চালকলমালিকেরা ওই পরিমাণ চালের ওপরে এক থেকে দুই টাকা পর্যন্ত মুনাফা দেখান। কিন্তু উপজাত বিক্রি হয় ৬ থেকে ৯ টাকা কেজি দরে। প্রতি কেজি চাল ও এর উপজাতে মালিকদের মোট মুনাফা দাঁড়ায় ৮ টাকা থেকে ১৩ টাকা ৬৬ পয়সা।

বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এইচ আর খান পাঠান বলেন, চাল বিক্রি করে যদি এত মুনাফা হতো, তাহলে চালকলমালিকেরা আর্থিকভাবে এত খারাপ অবস্থায় থাকতেন না। চাল বিক্রিতে লোকসান হয়। তাই দেশে চালকলের সংখ্যা কমে আসছে।

ব্রির গবেষণায় ওঠে আসে, দেশে ধান ও চালের বাজারে কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পাঁচবার হাতবদল হয়। প্রতিবার হাতবদলের সময় যোগ হয় খরচ আর মুনাফা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ও অস্বাভাবিক মুনাফা করেন চালকলমালিকেরা।

ব্রি মহাপরিচালক মো. শাহজাহান কবীর বলেন, চালকলগুলো দেশের ভোক্তাদের পুষ্টিবঞ্চিত করছে। আবার অতি মুনাফার জন্য তাঁদের কাছ থেকে চাল বিক্রি করে বেশি টাকা আদায় করা হচ্ছে। এ জন্য ছাঁটাই নীতিমালা দ্রুত বাস্তবায়ন ও কঠোর নজরদারি দরকার।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!