মাদকাসক্ত ৯৯ শতাংশ শিশুর ভাঙা পরিবার

  • আপডেট সময় সোমবার, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৪
  • 91 পাঠক

দিশারী ডেস্ক। ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।

রাজধানীর আরেকটি সরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিচ্ছে ১০ বছরের আনাস (ছদ্মনাম)। গত বছরের প্রথম দিকে তার চাকরিজীবী মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়। বিচ্ছেদের পর মা ও বাবা দুজনেই বিয়ে করেন। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করার পর সৎমায়ের অত্যাচারে ঘর ছাড়ে আনাস। পরে আনাসের দায়িত্ব নেন তার দাদি।

তবে শতবর্ষী দাদি তার তেমন যত্ন করতে পারেন না, কারণ তিনি নিজেই অসুস্থ ছিলেন। একটি প্রাইমারি স্কুলেও ভর্তি হয়েছিল আনাস, তবে বন্ধুদের সঙ্গে মিশে গাঁজার নেশায় আসক্ত হয় বলে জানিয়েছেন তার স্বজনরা।

কমলাপুর স্টেশনের রেললাইনের প্ল্যাটফর্মে শুয়ে ছিল একটি শিশু। নোংরা কালিঝুলি মাখা ছেলেটির মাথায় উষ্কখুষ্ক চুল, পরনে ছেঁড়া টি-শার্ট আর হাফ প্যান্ট। বয়স বড়জোর সাত কি আট বছর। পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন রেলের এক কর্মকর্তা। শিশুটি তার দৃষ্টিগোচর হয়, তিনি শিশুটির পাশে গিয়ে দাঁড়ান, বুঝতে পারেন মাদক সেবন করে আচ্ছন্ন হয়ে আছে।

তিনি শিশুটিকে কোলে তুলে নেন, চলে আসেন তেজগাঁও মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে। সেখানেই চিকিৎসা হয় মোহাম্মদ (ছদ্মনাম) নামে শিশুটির। বেশ কয়েক মাস চিকিৎসার পর অনেকটাই সুস্থ হয় মোহাম্মদ। যখন বাড়ি ফেলার পালা, তখন ঘটে বিপত্তি, আসলে মোহাম্মদের ফেরার কোনো ঠিকানা নেই। পথেই ছিল তার ঘরবাড়ি, মা-বাবা নেই, তাই যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।

অনেক খোঁজখবর নেয়ার পর মোহাম্মদের চাচার একটি ঠিকানা পাওয়া যায়, তবে চাচা তাকে নিতে চান না। মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে আরও বেশ কয়েক মাস থাকার পর তার ঠাঁই হয় গাজীপুর শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে।

জানা যায়, মোহাম্মদের মা-বাবার অনেক আগে বিচ্ছেদ হয়েছে। তাদের কোনো খোঁজ নেই।

এ তো গেল পথশিশু ও মধ্যবিত্ত পরিবারের কথা। আমাদের সমাজে উচ্চবিত্ত অনেক পরিবারের শিশুরাও মাদকাসক্ত।

১৪ বছরের ইয়াসিনের (ছদ্মনাম) মা-বাবা দুজনেই চিকিৎসক। তবে মা-বাবার বিচ্ছেদের কারণে সম্প্রতি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে ইয়াসিন। এখন সে বেসরকারি একটি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিচ্ছে।

ইয়াসিন এ প্রতিবেদককে বলে, মা-বাবা সব সময় ঝগড়া করত, আমি অনেক চেষ্টা করেছি যাতে তারা মিলে যায়। তবে শেষ রক্ষা হয়নি, তারা আলাদা হয়ে যায়। তারা আলাদা হওয়ার পর আমি চাচার কাছে ছিলাম, মা-বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে আমি হতাশ হয়ে পড়ি। হতাশা কাটাতে নেশা করা শুরু করি।

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে ছেলেশিশুদের পাশাপাশি মেয়েশিশুও রয়েছে, যদিও তাদের সংখ্যা কম। তবে বেশির ভাগ মেয়েশিশু শারীরিক নির্যাতনের শিকার। সেটি তারা মেনে নিতে না পারায় মাদক সেবন শুরু করে।

নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নেয়া ১০ বছরের শিশু সাদিয়া (ছদ্মনাম) জানায়, মা-বাবা আলাদা হওয়ার পর মামার কাছে ছিল সে। মামি তাকে শাররিক নির্যাতন করতেন, একদিন বাসা থেকে পালিয়ে আসে সে। অন্য পথশিশুদের সঙ্গে থাকতে শুরু করে। সেখানে থেকে মাদকে আসক্ত হয়।

সরেজমিনে সম্প্রতি রাজধানীর তেজগাঁওয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়, ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) পাঁচটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি শিশুরাও চিকিৎসা নিচ্ছে। ওপরে উল্লিখিত শিশুদের তথ্যগুলো এসব মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলো থেকে নেয়া।

তেজগাঁওয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়, ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) দেয়া তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে (২০১৯-২০২৩) এই নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছে ৭৮১ জন শিশু। এসব শিশুর ৯৯ শতাংশের মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়েছে।

অন্যদিকে ঢাকার দুই সিটি মেয়রের কার্যালয়ের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনের সংখ্যা ২ হাজার ৪৮৮। অন্যদিকে ২০২২ সালে তালাকের আবেদন এসেছিল মোট ১৩ হাজার ২৮৮টি। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৭ হাজার ৬৯৮টি, উত্তর সিটিতে ৫ হাজার ৫৯০টি। এ হিসাবে রাজধানীতে প্রতিদিন ভেঙে যাচ্ছে প্রায় ৩৭টি দাম্পত্য সম্পর্ক। অর্থাৎ তালাকের ঘটনা ঘটছে ৪০ মিনিটে একটি করে।

২০২০ ও ২০২১ সালেও রাজধানীতে বিয়েবিচ্ছেদের আবেদনের সংখ্যা ছিল ১২ হাজারের বেশি। ঢাকার দুই সিটি মেয়রের কার্যালয়ের তথ্য অনুসারে, এই দুই বছরে আবেদন জমা পড়েছে যথাক্রমে ১২ হাজার ৫১৩ ও ১৪ হাজার ৬৫৯টি। গত চার বছরে তালাক হয়েছে ৫২ হাজার ৯৬৪টি।

পাঁচটি নিরাময় কেন্দ্রের একাধিক চিকিৎসক জানান, যেসব শিশু এখানে চিকিৎসা নিচ্ছে তাদের বেশির ভাগ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। তাদের মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়েছে।

এ বিষয়ে তেজগাঁওয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়, ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) চিফ কনসালট্যান্ট ডা. কাজী লুৎফুল কবির  বলেন, ‘নিরাময় কেন্দ্রে যেসব শিশু চিকিৎসা নেয়, দেখা গেছে তাদের ৯৯ শতাংশের মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়ে গেছে।’

ডা. কাজী লুৎফুল কবির বলেন,  সবচেয়ে বেদনার বিষয় হচ্ছে, এসব শিশু (ছেলেশিশু) যখন চিকিৎসা নিয়ে অনেকটাই সুস্থ হয়, তখন তাদের কেউ নিতে চায় না। তাদের ফেরার কোনো ঠিকানা থাকে না। আর মাদকসেবনের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে এসব শিশু চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে মেয়েশিশুরা বেশির ভাগই নির্যাতনের শিকার হয়। তারা নেশা করার পাশাপাশি ব্লেড দিয়ে তাদের হাত ও শরীর ক্ষতবিক্ষত করে।

তিনি আরও জানান, চিকিৎসা শেষে এক বছর ফলোআপ দেয়ার নিয়ম। তবে তাদের দায়িত্ব নেয়ার তেমন কেউ থাকে না বলে নিরাময় কেন্দ্র থেকে বের হয়ে গিয়ে তারা আবারও নেশায় জড়িয়ে পড়ে।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মো. আবদুল্লাহ আবু বলেন, যেসব শিশু পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, তাদের বেশির ভাগই মাদকাসক্ত হয়ে থাকে। কারণ এসব শিশু অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। তারা আদর-শাসন কোনোটিই পায় না। যে কারণে তারা বিপথগামী হয়ে পড়ে। এ ছাড়া যেসব পরিবারে মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না, সেসব পরিবারের শিশুদেরও মাদকাসক্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এসব শিশু মানসিক সমস্যাতেও ভোগে।

তিনি বলেন, নিম্নবিত্ত পরিবারে বিচ্ছেদের ঘটনা বেশি থাকলেও উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারেও বিচ্ছেদের ঘটনা রয়েছে। মা-বাবার বিচ্ছেদের কারণে শিশুরা বিভিন্ন অপরাধেও জড়িয়ে পড়ে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো সর্বশেষ আদমশুমারিতে ভাসমান মানুষের সম্পর্কে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে বলছে, দেশে চার লাখের মতো পথশিশু রয়েছে, যার অর্ধেকই অবস্থান করছে ঢাকায়। অন্যদিকে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ বলছে, ‘বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি।

এ বিষয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (শিশু সুরক্ষা বিভাগ) আবু আব্দুল্লাহ মো. ওয়ালী উল্লাহ জানান, এসব শিশুর সুরক্ষায় সমাজসেবা অধিদপ্তর কাজ করছে। চিকিৎসা শেষে যেসব শিশুর যাওয়ার কোনো জায়গা থাকে না তাদের বিভিন্ন সরকারি শিশু নিবাসে পাঠানো হয়।

তিনি আরও বলেন, মাঠপর্যায়ে এসব শিশুকে চিহ্নিত করতে আমাদের টিম কাজ করছে। মাতৃ-পিতৃহীন শিশুদের অর্থসহায়তা দেয়া, সুশিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও আমরা করি। এ ছাড়া পারিবারিক নির্যাতন ও সহিংসতা প্রতিরোধ এবং সামাজিক ন্যায়বিচারসহ শিশুর যেকোনো সুরক্ষায় আমরা কাজ করে থাকি।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!