টুথপেস্ট, হ্যান্ডওয়াশ স্বাাস্থ্যের জন্যে নিরাপদ ???

  • আপডেট সময় শনিবার, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২৪
  • 139 পাঠক

দিশারী ডেস্ক। ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বলেছে, টুথপেস্ট ও হ্যান্ডওয়াশে প্যারাবেন ব্যবহার করা যাবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা ইসিডিসি বলেছে, প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১ হাজার এবং শিশুদের ক্ষেত্রে ৫০০ মাইক্রোগ্রাম প্যারাবেন সহনশীল ধরা হয়। তবে এসডোর গবেষণায় বাংলাদেশের ভোক্তা পর্যায়ে ব্যবহৃত টুথপেস্টে প্যারাবেন ১ হাজার ৮২৩ এবং শিশুদের একটি টুথপেস্টে ৬৫৯ মাইক্রোগ্রাম পাওয়া গেছে। এ ছাড়া টুথপেস্টে ৫০ দশমিক ৫ মাইক্রোগ্রাম বিউটাইল প্যারাবেনের উপস্থিতি মিলেছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার ওনজিন ইনস্টিটিউট ফর অকুপেশনাল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল হেলথের (ডব্লিউআইওইএইচ) সহযোগিতায় গবেষণাটি করেছে এসডো। টুথপেস্ট ও হ্যান্ডওয়াশে কী ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার হচ্ছে, এতে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে কিনা, তা জানতেই এ গবেষণা।

ঢাকার বিভিন্ন দোকান থেকে ১৪ কোম্পানির টুথপেস্ট ও ১৬ কোম্পানির হ্যান্ডওয়াশের নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাব পরীক্ষার জন্য ডব্লিউআইওইএইচে পাঠায় এসডো।

গবেষণায় দেখা গেছে, ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ পণ্যের মোড়কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়নি কোম্পানিগুলো। প্রাপ্তবয়স্কদের পার্সোনাল কেয়ার প্রডাক্টের ২২টি নমুনার মধ্যে পাঁচটি পণ্যে সর্বোচ্চ মাত্রায় প্যারাবেনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। নমুনাগুলোয় ফ্লোরাইড (শুধু টুথপেস্টে) এবং সোডিয়াম-ডাইক্লোরাইডের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে।

কেউ এর ধরনের টুথপেস্ট দিয়ে তিন থেকে চার দিন ব্রাশ করলে ১ হাজার মাইক্রোগ্রামের বেশি প্যারাবেন তাঁর শরীরে প্রবেশ করে এবং দীর্ঘমেয়াদি এ ধরনের টুথপেস্ট ব্যবহারে হরমোন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।

এসডোর সেক্রেটারি জেনারেল ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেছেন, দৈনন্দিন পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে তদারিক সংস্থার দুর্বলতায় বিদেশি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশকে ডাম্পিং রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে টুথপেস্ট ও হ্যান্ডওয়াশে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার হচ্ছে। অথচ একই পণ্যে পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান ও আফগানিস্তানের মতো দেশে এসব ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার কম দেখা গেছে। এগুলোর ব্যবহার বন্ধে আইন করে তদারকি সংস্থাগুলোর তৎপরতা বাড়ানো দরকার।

তিনি আরও বলেন, শিশুদের টুথপেস্ট উৎপাদনকারী বেশির ভাগ কোম্পানি বিদেশি। তারা দেশভেদে ভিন্ন পরিমাণ রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে।

জীবনমান উন্নত হওয়ায় গ্রাম পর্যায়ে বেড়েছে টুথপেস্টের ব্যবহার। সাবানের জায়গা দখল করেছে লিকুইড হ্যান্ডওয়াশ। ভালোর জন্য এসব ব্যবহার করে হিতে বিপরীত হচ্ছে মানুষের। হ্যান্ডওয়াশের মাধ্যমে শরীরে রোগ বাসা বাঁধছে। টুথপেস্টও ডেকে আনছে নানা ঘাতক ব্যাধি। গবেষকরা সতর্ক করে বলছেন, ক্ষতিকর রাসায়নিকের টুথপেস্ট ও হ্যান্ডওয়াশ দীর্ঘদিন ব্যবহারে হতে পারে ক্যান্সার, বন্ধ্যত্বের মতো রোগ।

অথচ ভোক্তা পর্যায়ে এসব টুথপেস্ট ও হ্যান্ডওয়াশের নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবসা চলছে। নামি থেকে ছোট কোম্পানির পণ্যেরও নিয়মিত হয় না মান পরীক্ষা। নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানও নির্বিকার। নিত্যপণ্য দুটি উৎপাদনে জড়িত একটি চক্র, যারা নামি কোম্পানির মোড়ক ব্যবহার করে বাজারে ছাড়ছে। মাঝেমধ্যে এসব ভুয়া প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান হলেও নেওয়া হয় না শক্ত পদক্ষেপ। ফলে নিত্যব্যবহার্য সামগ্রীতে ক্ষতিকর রাসায়নিকের উপস্থিতি ক্রমশ বাড়ছে, যা বড় হুমকি হয়ে উঠেছে জনস্বাস্থ্যের জন্য।

বেসরকারি সংস্থা এসডোর গবেষণায় বাংলাদেশের স্থানীয় মার্কেট থেকে সংগ্রহ করা টুথপেস্ট ও হ্যান্ডওয়াশের নমুনায় উদ্বেগজনক মাত্রায় ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ প্যারাবেন, সোডিয়াম ও ডাইক্লোরাইডের উপস্থিতি মিলেছে। প্যারাবেন মানবদেহের হরমোন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যাহত করে। সোডিয়াম-ডাইক্লোরাইড উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক ও কিডনির জটিলতা তৈরি করে। দীর্ঘমেয়াদে এসব পণ্য ব্যবহারে নীরবে বাড়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্যারাবেন সাধারণত প্রসাধনী, পার্সোনাল কেয়ার প্রোডাক্ট (শ্যাম্পু, ডিওডোরেন্ট, হ্যান্ডওয়াশ) এবং ওষুধের প্রিজারভেটিভ হিসেবে কাজ করে। কম খরচ ও সহজলভ্য হওয়ায় উৎপাদনকারীরা বেশি পরিমাণে এটি ব্যবহার করে থাকে।

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি সংস্থার অবহেলায় এ ধরনের পণ্য বাজারে এসেছে। আগেও এমন অনেক গবেষণা হয়েছে, তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ছাড়পত্র দিয়েই তারা দায় সারে, কখনও নিজ উদ্যোগে ভোক্তা পর্যায় থেকে নমুনা সংগ্রহ করে মান যাচাই করে না। আশা করি, সরকারি সংস্থাগুলো মান নিয়ন্ত্রণে সুচারুভাবে কাজ করবে।

এসডোর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দিকা সুলতানা বলেন, এখনই ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার কমানো না গেলে আগামী প্রজন্মের মধ্যে প্রজনন-সংক্রান্ত জটিলতা বাড়তে পারে।

বারডেম হাসপাতালের ডায়াবেটিস ও হরমোন বিভাগের অধ্যাপক ডা. ফারুক পাঠান বলেন, দৈনন্দিন পণ্যে উচ্চমাত্রায় বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারে হরমোন, থাইরয়েড, বন্ধ্যত্ব, ক্যান্সারের মতো মারণব্যাধিতে আক্রান্তের হার বাড়ছে। ফ্লোরাইডের অতিরিক্ত ব্যবহার হাড়ের ভারসাম্য নষ্ট করে এবং দাঁতের এনামেল গঠনে সমস্যা তৈরি করে। মাঠ পর্যায়ে তদারকি সংস্থার নিষ্ক্রিয়তায় ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ করছেন।

বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) উপপরিচালক ও মুখপাত্র রিয়াজুল হক বলেন, এসডোর গবেষণার তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে। কোন ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে, এটি দেখে সবকিছু ঠিক পেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

টুথপেস্ট ও হ্যান্ডওয়াশে ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহারের বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উপপরিচালক নুরুল আলম। তবে তিনি বলেন, ওষুধে এ ধরনের রাসায়নিকের ব্যবহারের বিষয়ে কোনো অভিযোগ আসেনি। লিখিত অভিযোগ পেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 কোন পণ্যে ঝুঁকি বেশি

রাজধানীসহ সারাদেশে হাত বাড়ালেই মিলছে নকল আর ভেজাল টুথপেস্ট, হ্যান্ডওয়াশসহ নানা প্রসাধনী। মোড়ক দেখে কারও বোঝার সাধ্য নেই কোনটি আসল, কোনটি নকল। নকলের ভিড়ে কেনা হচ্ছে বিষ। দেশি-বিদেশি বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর মোড়ক নকল করে তা বাজারজাত হচ্ছে।

অনেক ক্ষেত্রে পরিত্যক্ত মোড়ক ও কৌটাতে নকল প্রসাধনী ঢুকিয়ে দেদার বিক্রি করা হচ্ছে। বৈধ-অবৈধ দুই পথেই বিভিন্ন দেশ থেকে আসছে ব্র্যান্ডের নকল কৌটা ও বাহারি মোড়ক। এতে ভেজাল প্রসাধনী ভরে বিক্রি হচ্ছে আসল দামে। কেরানীগঞ্জ ও পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক এ ধরনের পণ্যের পসরা অনেকটাই ওপেন সিক্রেট।

অভিযোগ রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অসাধু কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতায় নকল ও ভেজাল পণ্যের বড় সিন্ডিকেট কাজ করে যাচ্ছে বছরের পর বছর। এতে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এসব পণ্য পরীক্ষা করে দেখা গেছে, নকল পণ্যে যেসব রাসায়নিক ব্যবহার হয় তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। হুবহু একই ধরনের মোড়কে তৈরি করা এসব নকল পণ্য বাইরে থেকে দেখে সাধারণ কোনো ক্রেতার পক্ষে বোঝার উপায় নেই। আসল আমদানিকারকের স্টিকারের মতো হুবহু স্টিকারও লাগানো থাকে।

উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ এবং সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের ছাপও অবিকল। সরকারের তদারকি সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে অবাধে তৈরি ও বাজারজাত করা হচ্ছে এসব সামগ্রী। শুধু রাজধানী ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় তিন শতাধিক নকল প্রসাধনসামগ্রী তৈরির কারখানা রয়েছে। একটি আসল সেনসেডাইন টুথপেস্টের পাইকারি দাম ৪০০ টাকা। অথচ একই ব্র্যান্ডের নকল টুথপেস্ট বিক্রি হচ্ছে ১৬৫ টাকায়। ঢাকার খুচরা বাজারে এ নকল সেনসেডাইনের দাম রাখা হচ্ছে ১২০ টাকা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মোহাম্মদপুরের এক ব্যবসায়ী বলেন, গ্রামের মানুষ ভালো-খারাপ বোঝে না। তারা কম দামে পেলেই কেনে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, বাজারে প্রতিষ্ঠিত অনেক ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর লেবেল ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ নেই। এক জরিপে দেখা গেছে, ৪৫ ভাগ প্রসাধন পণ্যের বিএসটিআইর সনদ নেই, ৭৫ ভাগ পণ্যের উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা নেই।

ইউনিলিভার, স্কয়ার টয়লেট্রিজ, কোহিনূর কেমিক্যাল, লালবাগ কেমিক্যালের পাশাপাশি বিদেশ থেকে আমদানি করা বড় বড় ব্র্যান্ডের পণ্য প্রকাশ্যে নকল করে বাজারজাত করছে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!