দিশারী ডেস্ক। ৫ মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।
দেশে করোনা সংক্রমণের পরবর্তী এক বছরে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) বয়সভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, আক্রান্তদের মধ্যে ১ থেকে ১০ বছর বয়সের ছিল ৩ শতাংশ, ১১-২০ বছরের ৭ শতাংশ, ২১-৩০ বছরের ২৮ শতাংশ, ৩১ থেকে ৪০ বছরের ২৭ শতাংশ, ৪১-৫০ বছরের ১৭ শতাংশ, ৫১-৬০ বছরের ১১ শতাংশ ও ষাটোর্ধ্ব ৭ শতাংশ। অর্থাৎ সর্বোচ্চ ৫৫ শতাংশ আক্রান্তদের বয়স ২১-৪০ বছরের মধ্যে।
অন্যদিকে ডেঙ্গুতেও সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে তরুণরা। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্তদের বড় অংশই তরুণ বয়সের মানুষ। পাশাপাশি বিষণ্নতায় ভুগতে থাকা ও মানসিক রোগীদের মধ্যেও এই তরুণরাই সর্বাধিক। আবার মাদকসেবীদের একটি বড় অংশই এই তরুণরা।
ধানমন্ডির একটি বেসরকারি সংস্থায় গবেষণা বিভাগে কাজ নেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাস করা ২৮ বছরের তরুণ। মাত্র ১৪ দিনের মাথায়ই তার চাকরি চলে যায়। সংক্ষুব্ধ তরুণ বিষয়টি নিয়ে তার এক অভিভাবকের কাছে নালিশ করেন। একধরনের কৈফিয়তের মধ্যে পড়তে হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। তবে চাকরি থেকে বের করে দেয়ার কারণ শুনে ওই অভিভাবক তার তৎপরতা নিজ থেকেই থামিয়ে দিয়ে উল্টো দুঃখ প্রকাশ করেন।
বিষয়টি জানিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, ওই তরুণ কাজে যোগ দেয়ার দুই দিন পর থেকে প্রতিদিনই দেরি করে অফিসে আসেন। অফিসের কাজে মনোযোগ ছিল না মোটেই। কেমন একটা উদাসীন ভাব ছিল সব সময়। কোনো কাজ দিলে সেটা ঠিকমতো করতে পারছিলেন না। হঠাৎ হঠাৎ খিটখিটে মেজাজ দেখাতে শুরু করেন। চেহারা ও চালচলনে কেমন একটা ঝিমুনির বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। মাঝেমধ্যেই সহকর্মীদের কাছে একেক দিন একেকটা অজুহাত দিত রাতে ঘুমাতে না পারার।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন চিকিৎসক তার একমাত্র তরুণ বয়সী সন্তানকে নিয়ে বড় বিপদে আছেন। নিজের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরি করি। সারা দিন বাইরে থাকি। বিশ্ববিদ্যালয়, চেম্বার করে বাসায় ফিরতে রাত হয়। সন্তানের সঙ্গে দেখা হয় কম। ফোনে কথা হয়। সে তার মতো স্বাধীনভাবেই সময় কাটায়। কলেজে যায়, পড়ালেখা করে, বাসায় নিজের রুমেই থাকে বেশির ভাগ সময়।
কিন্তু কিছুদিন ধরে সে অন্য রকম আচরণ করছে। তার সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলা যাচ্ছে না। সব সময় যেন রেগে থাকে। দিনের অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমায়। যতটা সম্ভব খোঁজখবর নিয়ে এবং তল্লাশি চালিয়ে কোনো ধরনের মাদকাসক্তির নমুনা বের করতে পারিনি। নিজেরা চিকিৎসক হয়েও কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। অসহায় লাগছে।
রাজধানীর বনানী এলাকার তরুণী সুমাইয়া তানজেরিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় শিক্ষার্থী পাঠানোর একটি এজেন্সিতে চাকরি নিয়েছেন ১ বছর ২ মাস হলো। অফিসে এখন অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েছেন চাকরি নিয়ে। খুঁজছেন নতুন চাকরি। কারণ নিয়ে নিজেই বিব্রত।
জানান, করোনা মহামারির সময় আরও অনেকের মতো নিজেও আক্রান্ত হয়ে ভর্তি ছিলেন হাসপাতালে। এর পর থেকে একটু ঠাণ্ডা বা গরমে ঘন ঘন অসুস্থ হচ্ছেন। মাঝেমধ্যেই জ্বরে ভোগেন। অ্যান্টিহিস্টামিন আর প্যারাসিটামল প্রায় নিয়মিত খাওয়া হয়। অল্পতেই বিষণ্নতা ভর করে। কাজে মন বসানো যায় না।
আবার রাতের বেশির ভাগ সময় চলে যায় বন্ধুদের সঙ্গে ফেসবুকে আড্ডা দিয়ে। ঘুমও আসে না। ভোরের দিকে ঘুম হলেও পড়িমরি করে উঠে পড়তে হয় অফিসে যাওয়ার জন্য। সব মিলিয়ে অফিসে বকা খেতে হয় প্রায় দিনই।
সুপারশপ স্বপ্নের একটি আউটলেটের কর্মী ৩৪ বছরে বয়সী রায়হানুল ইসলাম বলেন, ডিউটিতে এসে ঘণ্টাখানেক কাজ করার পরই খুব অস্বস্তি লাগে। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হয়, দুর্বল লাগে। ১০-১২ কেজির কার্টন তুলতেও মনে হয় প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে। হাতে-পায়ে-পিঠে টান লাগে। কতদিন কাজ করতে পারি বুঝতে পারছি না।
এই চারজনই নয়, আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। কথা বলা হয়েছে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও। তরুণ প্রজন্মের এই শাররিক ও মানসিক অসুখের কারণ হিসেবে নানা ধরনের ভাইরাস ও সংক্রামক- অসংক্রামক রোগের বিস্তার, অপ্রয়োজনে রাত জাগা, পারিবারিক ও মানসিক অস্বাস্থ্যকর জীবনাচার, শিক্ষাব্যবস্থা ও কারিকুলামে জগাখিচুড়ি পরিস্থিতি, একান্নবর্তী পরিবারের ভিত্তি ভেঙে যাওয়া, মা-বাবার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়া, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চা থেকে দূরে থাকা, মোবাইল ফোন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতি আসক্তি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, যানজটপূর্ণ যাতায়াতব্যবস্থা, অতিমাত্রায় ওষুধ আসক্তি, বিষণ্ণতা, মাদকাসক্তিসহ আরও কিছু বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন।
তারা তরুণ সমাজকে এমন পরিস্থিতি থেকে সুরক্ষায় জাতীয় পর্যায়ের বড় ধরনের পরিকল্পনা প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছেন। অবশ্য কেউ কেউ বলেছেন, শিশুকাল থেকেই খাদ্যাভ্যাসের বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করে বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে।
প্রখ্যাত মনোবিদ অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম বলেন, অনেকেই তরুণ প্রজন্মের কোনো দুঃসময়ের জন্য পরিবারকে দায়ী করে থাকেন। কিন্তু পরিবার তো একা দায়ী নয়। বরং পরিবার অসহায় হয়ে পড়ে। এর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব নিতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন যা চলছে, সেটা তরুণ প্রজন্মকে সুস্থ-সবল রাখার সহায়ক নয় বলেই তরুণ প্রজন্ম নানাভাবে বিপথগামী হচ্ছে। যার প্রভাবে কাজকর্মে সব জায়গাতেই তরুণরা ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক রোগ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সালাউদ্দিন কাউসার বিপ্লব বলেন, আমাদের পরিবারগুলোতে অভিভাবকদের সঙ্গে সন্তানদের দূরত্ব বাড়ছে। অভিভাবকরা নিজেদের কাজ, নিজেদের জগৎ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে সন্তানকে সময়মতো পর্যাপ্ত গাইড করেন না। একপর্যায়ে যখন লাগাম ছুটে যায়, তখন তাদের লাগাম টানার চেষ্টা করেন, কিন্তু তা খুব একটা কাজে আসে না। সন্তানরা তখন নিজেদের মতো জগৎ খুঁজে নেয়। তারা অনেকেই বিপথে যায়।
এ ছাড়া তারা নিজ নিজ রুমে আবদ্ধ থেকে ডিভাইসে ডুবে থাকে। সেখানে তারা অন্য এক পরিবেশে থাকে। রাতে না ঘুমিয়ে দিনে ঘুমায়। কোনো শৃঙ্খলা থাকে না। জীবনযাত্রায় অস্বাস্থ্যকর এক পরিবেশ তৈরি হয়। অনেকের অভিভাবক নিজেরা নানা অসংলগ্ন কার্যক্রমে জড়িত থাকেন, ফলে সন্তানরাও সেদিকে ধাবিত হয়। এ ক্ষেত্রে সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। জাতীয়ভাবে কর্মকৌশল তৈরি করতে হবে।
খ্যাতিমান মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ এ বিষয়ে বলেন, তরুণ প্রজন্ম এখন সবচেয়ে বেশি কাহিল অবস্থায় থাকে। একটুতেই তাদের যেকোনো ভাইরাস অ্যাটাক করে ফেলে, দুর্বল করে ফেলে। মানসিকভাবেও তারা খুব সহজেই ভেঙে পড়ে, বিষণ্নতায় ভোগে। এর মূল কারণ হচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই কোনো ধরনের শাররিক পরিশ্রম করেন না। তারা অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত। অনেকেই বিভিন্ন ডিভাইসে আসক্ত হয়ে রাতভর জেগে থাকেন। ফলে তাদের অনিদ্রাসহ নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। সেখান থেকে আরও সমস্যা তৈরি হয়।
পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা জানান, শিশুদের খাওয়ানোর প্রক্রিয়াগুলো অনেক ক্ষেত্রেই অস্বাস্থ্যকর। বিশেষ করে অল্প বয়সী শিশুদের মিষ্টি খাবার খাওয়া এবং কোমল পানীয় গ্রহণ নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়। তাদের মধ্যে স্থূলতা দেখা দেয়। কৈশোরে-তারুণ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ছোট সময় থেকে যাদের পুষ্টিহীনতা থাকে, তারা বড় হয় দুর্বলতাকে সঙ্গে করেই।
Leave a Reply