দিশারী ডেস্ক। ২৪ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।
দেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে মাদকাসক্ততার সংখ্যা। হতাশ হয়ে পড়েছেন সচেতন সমাজ, ব্যক্তি ও পরিবার। অশ্রুসিক্ত নয়নে কথাগুলো বলছিলেন জাহেদা খাতুন। তার সন্তান বাঁধন মাদকাসক্ত। জাহেদা বলেন, পুত্রকে এ পথ থেকে ফেরাতে বিয়েও করিয়েছি, একটি সন্তানও রয়েছে ওর, কিন্তু নেশা ছাড়েনি। এমনিতে সব ঠিকঠাক। আমাদের একটি ছোট পোশাক কারখানা আছে। সেটিও দেখভাল করেও, শুধু নেশা করতে বাধা দিলে উত্তেজিত হয়ে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর থেকে শুরু করে গায়েও হাত তুলতে আসে। আমরা বড় কষ্টে আছি, জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছি, এমন সন্তান থাকার চেয়ে না থাকা ভালো।
সরেজমিনে কেন্দ্রীয় মাদক নিরাময় কেন্দ্রে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে কেন্দ্রীয় মাদকসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে সম্প্রতি সরেজমিনে জানা যায় মাদকে আসক্ত হওয়ার নানা কারণ। সেখানে দেখতে পাই একটি কাঠের বেঞ্চের ওপর বসে ঝিমুচ্ছে জিসান (ছদ্মনাম) নামের এক কিশোর, গা থেকে উটকো গন্ধ বের হচ্ছে, বেশ খানিকটা লম্বা, শুকনো শরীর, মাথায় উষ্কখুষ্ক চুল, পরনে পাতলা একটি হাফহাতার শার্ট ও কালিমাখা প্যান্ট। সঙ্গে রয়েছে তার মা মরিয়ম (ছদ্মনাম)। ছেলেকে নিয়ে তিনি ডাক্তারের রুমে ঢোকার জন্য অপেক্ষায় আছেন।
জিসানের মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের বাসা কড়াইল বস্তিতে। জিসানের বাবা বেঁচে নেই। বাসাবাড়িতে কাজ করে সংসার চালান মরিয়ম। পুত্র একটি সরকারি স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ত। বস্তির খারাপ ছেলেদের সঙ্গে মিশে সে নেশাগ্রস্ত (গাঁজা ও ড্যান্ডি) হয়। এরপর একটি কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। জানুয়ারি মাস থেকে সে নিখোঁজ ছিল। হঠাৎ (এক মাসেরও বেশি সময় পর) মহাখালী রেললাইনে বসে জিসান মাদক সেবন করছে- এমন খবর পেয়ে মরিয়ম সেখানে ছুটে যান। সেখান থেকে এক পুলিশের সহায়তায় নিরাময় কেন্দ্রে ছেলেকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে এসেছেন তিনি।
ফাহিম (ছদ্মনাম) নামে এক যুবক বছরখানেক আগে নিরাময় কেন্দ্র থেকে চিকিৎসা নিয়ে নড়াইলে নিজ বাড়িতে ফেরেন। বাড়ি ফেরার পর এ ধরনের রোগীদের এক বছর ফলোআপে রাখতে হয়। তবে ফাহিমের পরিবার তা করেনি। ফলে সে আবারও মাদকে আসক্ত (ইয়াবা) হয়ে পড়েছে। এখন তাকে আবারও চিকিৎসার জন্য নিয়ে এসেছেন তার বড় ভাই কবির (ছদ্মনাম)।
কবির বলেন, ফাহিম স্নাতক শেষ করেছে প্রায় চার বছর হলো। এর মধ্যে চাকরি জোগাড় করতে না পারায় সে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। হতাশা থেকে গাঁজা সেবন করা শুরু করে। তবে এক বছর আগে চিকিৎসা নিয়ে সে সুস্থ হয়। আমাদের ফলোআপ করতে বলা হয়েছিল। তবে ঢাকা থেকে নড়াইলের দূরত্ব বেশি হওয়ায় আমরা আসিনি। ফলে ছোট ভাই আবার মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে।
মাদকসেবীদের অর্ধেকের বেশি কিশোর-তরুণ কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের (মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর) চিফ কনসালট্যান্ট ডা. কাজী লুৎফুল কবির বলেন, নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নেয়া রোগীদের অর্ধেকের বেশি কিশোর ও তরুণ। প্রতিনিয়ত এদের সংখ্যা বাড়ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গত আট বছরের তথ্য বিশ্লেষণে এ চিত্র ওঠে এসেছে।
নিরাময় কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে চিকিৎসা নিয়েছে ২ হাজার জনের বেশি রোগী। যাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি কিশোর ও তরুণ।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সর্বশেষ মাদকবিষয়ক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৪ বছরে (২০১৯-২২) কেন্দ্রীয় মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ১ হাজার ৩২৯ জন চিকিৎসা নিয়েছে। তাদের মধ্যে ৯১৫ জনের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছর। সে হিসাবে সেখানে চিকিৎসা নেয়া ব্যক্তিদের প্রায় ৬৯ শতাংশ কিশোর ও তরুণ।
এর আগে কেন্দ্রীয় মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ২০১৫ থেকে ২০১৮ মেয়াদে চিকিৎসা নেয় ২ হাজার ৮৫৩ জন। তাদের মধ্যে ১ হাজার ৬৮২ জনের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছর, অর্থাৎ প্রায় ৫৯ শতাংশ কিশোর ও তরুণ।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন বলছে, মাদকাসক্তদের মধ্যে ১৫-২৫ বছর বয়সীদের সংখ্যা বেশি। চিকিৎসা নেয়া ব্যক্তিদের প্রায় ৪১ শতাংশই এই বয়সী। এরা স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ৭০ লাখের বেশি
দেশে বর্তমানে মাদকসেবীর সংখ্যা কত, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছে। এ ছাড়া সম্প্রতি সরকারি কোনো সংস্থা এ বিষয়ে কোনো সমীক্ষা চালায়নি।
২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট একটি সমীক্ষা করে। ওই সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, দেশে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ধারণা, দেশে মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৭০ লাখের বেশি।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা বলেন, দেশে মাদকসেবীদের বিষয়ে সাম্প্রতিক কোনো সমীক্ষা নেই। তবে কেন্দ্রীয় মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নেয়া ব্যক্তির পরিসংখ্যান থেকে একটি চিত্র পাওয়া যায়। এটা বাস্তবসম্মত ও সঠিক পরিসংখ্যান বলে আমরা মনে করি।
কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের (মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর) চিফ কনসালট্যান্ট ডা. কাজী লুৎফুল কবির বলেন, সরকারি ব্যবস্থাপনায় মোট চারটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র আছে।
ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় তিনটি আঞ্চলিক মাদক নিরাময় কেন্দ্রে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা দেয়া হয়। তবে আমাদের দেশে মাদকাসক্ত ব্যক্তির তুলনায় চিকিৎসা কেন্দ্র সীমিত। ব্যবসায়ীদের লোভ ও সহজলভ্যতার কারণে মাদকের বিস্তার ঘটছে ও বাড়ছে মাদকসেবীর সংখ্যা। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, বন্ধুসঙ্গ, কৌতূহল, সন্তানের দেখভাল ঠিকমতো না করা, দাম কম ও সহজলভ্যতা- এসব কারণে মূলত মাদকের বিস্তার বাড়ছে, ফলে আসক্ত মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে।
তবে নিরাময় কেন্দ্রে যেসব শিশু-কিশোর চিকিৎসা নেয়, দেখা গেছে, তাদের ৯৯ শতাংশের মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। মাদক পাচার ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কাজ করছে।
এ ছাড়া মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা বাড়ার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে ফলোআপ না করা। চিকিৎসা শেষে এক বছর ফলোআপ দেয়ার নিয়ম।
তবে এমন অনেকে আছেন চিকিৎসা শেষে যাদের দায়িত্ব নেয়ার, তেমন কেউ থাকে না বলে নিরাময় কেন্দ্র থেকে ফিরে গিয়ে তারা আবারও নেশায় জড়িয়ে পড়ে। রাজনীতিবিদ, সমাজসচেতন ব্যক্তি, নাগরিকদের মধ্যে সচেতন ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে। এ ছাড়া মাদকের সহজলভ্যতা বন্ধ করা, চিকিৎসা করা, কাউন্সেলিং, পরিবারিক ও সামাজিক সচেতনা বৃদ্ধির মাধ্যমে মাদকের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশনস ও গোয়েন্দা) তানভীর মমতাজ বলেন, মাদক চোরাকারবারিরা সম্প্রতি খুবই তৎপর হয়ে ওঠেছে। বিভিন্ন সময়ে মাদকের চালান ধরতে গিয়ে পাচারকারীদের অভিনব কৌশল জানা গেছে। দোকানদার সেজে, সবজি, মাছ বা অন্য যেকোনো পণ্যের ভেতরে করে, কুরিয়ার সার্ভিসে, যাত্রীবাহী বাসে এমনকি পেটের ভেতরে করেও ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক পাচারের ঝুঁকি নেন কারবারিরা। বাণিজ্যিক লাভের বড় ধরনের সুযোগ থাকায় জীবন-মৃত্যুকে বাজি রেখে কাজটা করছেন ব্যবসায়ীরা।
বর্তমানে মাদক কেনাবেচা খুবই সহজ। মাদক কেনাবেচার জন্য অনলাইনে ফেসুবক পেজ আছে, গ্রুপ আছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে মাদক বাসায় পৌঁছে দেয়। মাদকের বেশির ভাগ হোতা দেশের বাইরে থেকে এই ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এ ছাড়া কারাগারে বসেও মাদকের ব্যবসা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই শুধু মাদকাসক্ত বা মাদক বহনকারীকে গ্রেপ্তার করলে হবে না। মূল হোতাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, মাদক দেশে তরুণসমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আগে অন্য দেশ থেকে আসা মাদক কেনা, ব্যবসা ও সেবন করার ক্ষেত্রে অনেক গোপনীয়তা রক্ষা করা হতো।
Leave a Reply