দিশারী রিপোর্ট।০৬ অক্টোবর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।
ছাত্র-জনতা যখন চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন ৫ আগস্ট পায়ে গুলিবিদ্ধ হন স্কুলছাত্র মিরাজুল ইসলাম। সে আহত হওয়ার বর্ণনা দিয়ে বলে, পুলিশ সামনে থেকে গুলি করলে আমার ডান পায়ে লাগে। সাঁথিয়া হাসপাতালে নিয়ে যায় বন্ধুরা, সেখানে সামান্য চিকিৎসা দিয়ে পাঠিয়ে দেয় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে।
পাবনার লতিফ টাওয়ারের সামনে আমি গুলিবিদ্ধ হই। চোখের জল মুছতে মুছতে সে জানায়, স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে চাকরি করব, সংসারের হাল ধরব, এখন ভাগ্য আমাকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলে দিল যে স্বপ্ন দেখতেও ভয় পাই।
তার মা সাহেদা খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, প্রতিদিন মিরাজকে বোঝাতাম আন্দোলনে না যেতে, কিন্তু কথা শুনত না। এখন আন্দোলনে গিয়ে এই বয়সে পা হারিয়েছে। আমার ছেলেটার সামনে পুরো ভবিষ্যৎ পড়ে আছে, এটুকু বয়সে এক পা নিয়ে কীভাবে চলবে বলেই তিনি কেঁদে ওঠলেন। তিনি সরকারের কাছে দাবি করেন, আমার ছেলের পড়াশোনার খরচ যদি সরকার বহন করত, পড়াশোনা শেষে তার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিত তাহলে উপকার হতো।
কেবল রাজু কিংবা মিরাজুল নয় কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ এবং পরবর্তীকালে সরকার পতনের আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষ-সহিংসতায় গুরুতর আহত হয়ে অনেকের হাত কাটা পড়েছে, কারও গেছে পা, আবার অনেকেই চোখ হারিয়ে আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। আহতরা এখন ভবিষ্যৎ নিয়ে পড়েছে দুশ্চিন্তায়। আন্দোলন ঘিরে সারা দেশে সংঘাত-সহিংসতায় ১৮ হাজার ২৪৭ মানুষ আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে বলে সরকার গঠিত কমিটির খসড়া প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়, কোটা আন্দোলনে যারা আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল তাদের মধ্যে ৩ হাজার ৪৮ জন গুরুতর আহত। চিকিৎসা শেষে ৫০০-এর বেশি মানুষ শাররিক প্রতিবন্ধী হয়েছে।
এই প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে চোখে আঘাত পেয়েছে ৬৪৭ জন, যাদের মধ্যে অনেকেরই এক বা দুচোখ হারানোর ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়া হাত ও পায়ে গুলিবিদ্ধ বা মারাত্মক জখম হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা ৭৫০-এর বেশি বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে তথ্য এসেছে।
টঙ্গীর অটোরিকশা চালক রাজু মিয়া কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশের গুলিতে আহত হন। রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিজের ডান পায়ের দিকে অপলক তাকিয়ে ছিলেন, তার চোখেমুখে রাজ্যের দুশ্চিন্তা আর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা। সাংবাদিক পরিচয়ে কথা বলতে চাইলে ডুকরে কেঁদে ওঠেন।
তিনি বলেন, পরিবার নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছি। দুই মাসের ঘরভাড়া বাকি, কীভাবে সংসার চলবে, কিছুই জানি না। এক পা ছাড়া বাড়ি গিয়ে কী করব? কাজ করতে না পারলে দুই ছেলেমেয়েকে কী খাওয়াব। সরকার যদি আমাদের একটা ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা করত, কোথাও কাজ করার ব্যবস্থা করত তাহলে বেঁচে যেতাম। না হয় পরিবার নিয়ে রাস্তায় দাঁড়ানো ছাড়া উপায় নেই।
প্রতিবেদক যখন রাজু মিয়ার সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন পাশে ছিলেন স্ত্রী স্বপ্না। তিনি বলেন, দেশটা তো মুক্ত হলো কিন্তু আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে কি ? শুনছি সরকার ১ লাখ টাকা দেবে, এতে আমাদের কী হবে। টাকা না দিয়ে যদি ভাতার ব্যবস্থা করে কিংবা প্রশিক্ষণ দিয়ে আহতদের জন্য কোনো কারখানায় কাজের ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে আমার পরিবারটা বেঁচে যায়।
—————————————————————————————————————————————–
এককালীন আর্থিক সহায়তা কাজে আসবে না উল্লেখ করে সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, নগদ টাকা দিলে মানুষ খরচ করে ফেলবে। তাছাড়া আহতদের যে ১ লাখ টাকা করে দেয়া হচ্ছে সেই টাকা পর্যাপ্ত নয়। প্রয়োজন অনুযায়ী পরিকল্পনা নিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তা দিতে হবে। আর এই কাজটা বর্তমান সরকারেরই করে যাওয়া উচিত।
——————————————————————————————————————————————
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সংঘর্ষ-সহিংসতায় অনেকে সারা জীবনের জন্য প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েছেন। আহত এসব মানুষের কারও পা অথবা হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। তেমনি একজন ১৬ বছরের কারখানা শ্রমিক নাজিম। সরকার থেকে আর্থিক সাহায্য নয় কাজ করে খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়ার দাবি জানায় সে।
পঙ্গু হাসপাতালে অপারেশনের মাধ্যমে গত ২৫ জুলাই তার একটি পা কেটে ফেলা হয়। এরপর থেকে সে কোনো কাজ করতে পারছে না। পরিবারের বোঝা হয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে জানিয়ে সে বলে, নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর এলাকার একটি এমব্রয়ডারি কারখানায় কাজ করতাম। কারখানায় কাজ করে যে টাকা পেতাম তা বাবা-মায়ের হাতে তুলে দিতাম। এই বয়সে একটা পা কেটে ফেলা হয়েছে। আমার জীবন কীভাবে চলবে, এ কথা আমি কাকে বলব ?
নাজিম কোটা আন্দোলনের সময় কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলেন। তখন চিটাগাং রোডে গোলাগুলি হচ্ছিল। চারদিকে মানুষ দৌড়াচ্ছিল। হেলিকপ্টার থেকেও গুলি ছোড়া হচ্ছিল, যার একটা গুলি তার বাম পায়ে লাগে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সমন্বয়ক বলেন, আন্দোলনের সময় যারা আহত হয়েছে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে কিংবা চোখ হারিয়েছে তাদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের চাকরি দিতে হবে, যারা চাকরি করতে পারবে না তাদের নিকটাত্মীয়কে চাকরি দিতে হবে। কীভাবে এই আহতদের সহযোগিতা করা যায় কিংবা নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো যায় সে বিষয়ে একটা কমিশন গঠন করা যেতে পারে। এই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী তাদের পুনর্বাসন করা যেতে পারে।
২৪ আগস্ট পর্যন্ত ২৩ জনের পঙ্গু হাসপাতালে হাত-পা কেটে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলেন চিকিৎসকরা। এ সময় ১৮ জনের পা এবং ৫ জনের হাত কেটে ফেলতে হয়। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন, প্রাইভেটকার চালক সজীব খান। সজীব খান বলেন, ডিউটি শেষ করে বাসায় ফিরছিলাম, তখন গুলশান নতুন বাজার এলাকায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের তুমুল সংঘর্ষ চলছিল। সংঘর্ষ শেষে আমরা যখন বাসায় ফিরছিলাম তখন পুলিশ সামনে থেকে গুলি করে। পুলিশের গুলিতে আমিসহ অনেকেই আহত হন ; গুলিতে একটা কুকুরও মারা গিয়েছিল। তিনি বলেন, আমার তো হাত নেই, কাজ করতে পারি না, ভবিষ্যতে কী করব এ চিন্তায় ঘুমাতে পারি না। সরকার চিকিৎসার খরচ দিয়েছে কিন্তু আমার সংসার চলবে কীভাবে ?
——————————————————————————————————————————————
কোটা আন্দোলনের সময় যারা আহত হয়েছে তাদের চিকিৎসা সুবিধা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পুনর্বাসন করার পরিকল্পনা নিয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক। ব্র্যাক লিম্ব অ্যান্ড ব্র্যাক সেন্টার (বিএলবিসি)-এর রিহ্যাবিলিটেশন স্পেশালিস্ট নাসরিন জাহান মিলি বলেন, আমরা ২৮ জনের তালিকা করেছি। সাতজনের চিকিৎসা চলছে। ছয়জনের কৃত্রিম পা লাগানো হয়েছে, বাকিরা ফলোআপে রয়েছেন। টোটাল তালিকা হয়েছে ২৫০ জনের। তবে আরও যারা আসবে তাদেরও আমরা তালিকাভুক্ত করব। পাঁচ বছরব্যাপী তাদের কৃত্রিম পায়ের সব ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ বিনামূল্যে করবে এই সেন্টার। এছাড়া যাদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে কর্মক্ষেত্রে পুনর্বাসন করারও পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।
———————————————————————————————————————————————
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, কোটা আন্দোলনে যারা আহত হয়েছেন তাদের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। আহতদের কীভাবে পুনর্বাসন করা যায় তা নিয়ে একটি গবেষণা করতে হবে। প্রাথমিকভাবে আহতদের উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে। উন্নত কৃত্রিম হাত-পা সংযোজন ও লেন্সের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। যাদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন তাদের তা দিতে হবে। যেহেতু গুরুতর আহত মানুষদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা কম, তাই তাদের নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। এই তালিকায় যারা শিক্ষার্থী কিংবা তুলনামূলকভাবে বয়স কম তাদের ফ্রিল্যান্সিং শেখানো যেতে পারে কিংবা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করা যেতে পারে। অন্য আহতদের মধ্যে কাউকে দোকান খুলে দেয়া যেতে পারে। অর্থাৎ যে যেই কর্মক্ষেত্রে ভালো করতে পারবে তাকে সেই ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
সৌজন্যে : অন্য দৈনিক।
Leave a Reply