দিশারী ডেস্ক। ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪
বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের পর এ সংক্রান্ত নতুন একটি আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে সরকার। ইতিমধ্যে ওয়েবসাইটে প্রচারের পর সাধারণ মানুষের মতামতও নেয়া হয়েছে। বুধবার ছিল মতামত দেয়ার শেষ দিন।
নতুন এই অধ্যাদেশের নাম দেয়া হয়েছে ‘ সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪’। প্রাথমিক খসড়ায় বর্তমান আইনে থাকা বাকস্বাধীনতা সম্পর্কিত বিতর্কিত ধারাগুলো বাদ দেয়া হয়েছে। সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে কথা বলার জন্য কোনো অপরাধ হবে না। শুধু কম্পিউটারভিত্তিক অপরাধ শাস্তি হিসেবে রয়েছে।
———————————————————————————————–
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়া
——————————————————————————————–
আগের ‘ সাইবার সিকিউরিটি আইন-২০২৩ ’-এ মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গোপনীয়তা ও নাগরিক স্বাধীনতার জন্য মারাত্মক হুমকি ছিল। ২৫ ধারা অনুযায়ী, কোনো ডিজিটাল অথবা ইলেকট্রনিকস মাধ্যমে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা অথবা ভীতি প্রদর্শক, তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ ও প্রকাশকে এবং রাষ্ট্রের ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ’ করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল। এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা ৩ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান ছিল। নতুন এই অধ্যাদেশে পুরো বিষয়টিকে বাদ দেয়া হয়েছে।
তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী বলেন, ইতোমধ্যে আমরা খসরাটি ওয়েবসাইটে দিয়েছিলাম। সেখানে অনেকেই তাদের মতামত দিয়েছেন। এখন আমরা সাধারণ নাগরিকসহ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আইনটি নিয়ে মতবিনিময় করব। সেখানে যদি কোনো ভালো পরামর্শ আসে সেগুলো গ্রহণ করে খসড়াটি চূড়ান্ত করে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে পাঠানো হবে। উপদেষ্টারা যদি মনে করেন, আরও কোনো সংশোধনের প্রয়োজন তারা সেটার জন্য বলতে পারেন। আবার সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে পাশও হয়ে যেতে পারে।
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে সাতটি ধারা বাদ দেয়া হয়েছে। ধারাগুলো ছিল মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকা সম্পর্কে বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণার দণ্ড ; পরিচয় প্রতারণা বা ছদ্মবেশ ধারণ ; আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক, তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ, ইত্যাদি ; অনুমতি ছাড়া পরিচিতি তথ্য সংগ্রহ, ব্যবহার, ইত্যাদির দণ্ড ; অনুমতি ছাড়া পরিচিতি তথ্য সংগ্রহ, ব্যবহার, ইত্যাদির দণ্ড ; সম্প্রচার, ইত্যাদি ; মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, প্রচার, ইত্যাদি ও পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেফতার। আগের আইনে সাইবার নিরাপত্তা কাউন্সিলের বিধান নতুন অধ্যাদেশে রাখা হয়নি। এছাড়া বাদ পড়েছে ক্ষমতা অর্পণ, সাক্ষ্যগত মূল্য ও অসুবিধা দূরীকরণ ধারাগুলোও।
ব্যাপক সমালোচিত ও বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ রহিত করে গত বছরের সেপ্টেম্বরে আওয়ামী লীগ সরকার সাইবার নিরাপত্তা ২০২৩ নামে একটি আইন পাশ করে। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থা ও অধিকারকর্মীরা এটিকে নতুন মোড়কে পুরোনো নিবর্তনমূলক ধারাসংবলিত আইন বলে এসেছেন।
—————————————————————————————————————–
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) চলতি বছরের এপ্রিলে ‘ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পাঁচ বছরের চিত্র নিয়ে কঠিন পরীক্ষা ’ নামে একটি গবেষণা প্রকাশ করে। সেখানে ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা ১ হাজার ৪৩৬টি মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়।
সিজিএস জানায়, অভিযুক্তের মধ্যে ৩২ শতাংশের বেশি রাজনীতিবিদ, ২৯ দশমিক ৪০ শতাংশ সাংবাদিক। অভিযোগকারীর প্রায় ৭৮ শতাংশই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
————————————————————————————————————-
অধ্যাদেশে আমলযোগ্য ও অজামিনযোগ্য মামলার ধারা হিসেবে রয়েছে, ১৪, ১৬, ২০ ও ২২, যা মূলত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো, কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম, ইত্যাদির ক্ষতিসাধন ও দণ্ড, সাইবার সন্ত্রাসী কার্য সংঘটনের অপরাধ ও দণ্ড ও হ্যাকিং সংক্রান্ত অপরাধ ও দণ্ডের জন্য। সাইবার নিরাপত্তা আইন রহিত হওয়ার পরতার কিছু ধারার মামলার বিচার নতুন অধ্যাদেশেও চলবে। সেগুলো মূলত কম্পিউটারভিত্তিক অপরাধ ও ডিজিটাল প্রতারণা সংক্রান্ত। অন্য মামলাগুলো ইতোমধ্যে বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতিসংঘ গত আগস্টে ‘ সাইবার ক্রাইম কনভেনশনের’ খসড়া প্রকাশ করেছে। সেটাকে সামনে রেখে এবং দেশের বিভিন্ন আইনে এ বিষয়ে যে বিধানগুলো রয়েছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে তারপরই সরকার এই অধ্যাদেশ প্রণয়নে এগোতে পারত। একটু সময় নিলেও আইনটি আরও যুগোপযোগী করতে পারত।
————————————————————————————————————
নতুন এই অধ্যাদেশের ধারা ৮-এ বলা আছে, ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি করলে সাইবার সুরক্ষা এজেন্সির মহাপরিচালক সেসব অপসারণ বা ব্লক করার জন্য বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবেন।
————————————————————————————————————
এছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ সাপেক্ষে, যদি বিশ্বাস করার কারণ থাকে যে ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের বা কোনো অংশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ণ করে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণার সঞ্চার করে, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তা অপসারণ বা ব্লক করার জন্য মহাপরিচালকের মাধ্যমে বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে।
Leave a Reply