নিজস্ব প্রতিনিধি, ঢাকা
———————–
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন ব্রান্ডের বিস্কুট, চানাচুর, কফি, শিশুদের চকোলেট, চিপস, আইসক্রিম, বোতলজাত তরল পানীয়, জুস, নুডলস, বোতলজাত সয়াবিন তেল, সরিষার তেল, মশার কয়েলসহ অনুমোদনহীন নানা পণ্য দেদার বিক্রি হচ্ছে বাজারে।
দেশের নামিদামি ব্র্যান্ডগুলোর মোড়কের আদলে কাছাকাছি নাম দিয়ে এসব পণ্য কিনতে গিয়ে বুঝতেও পারেন না ক্রেতারা। বিএসটিআইয়ের অনুমোদন না থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তৈরি মানহীন এসব পণ্যে প্রতারণার শিকার হওয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছেন ক্রেতারা।
রাজধানীর বেশ কিছু দোকান ঘুরে দেখা গেছে, রোমা নামের একটি কোম্পানির প্যাকেটজাত টোস্ট, মটরভাজা, চানাচুরের প্যাকেটের গায়ে বিএসটিআইয়ের লোগো নেই। এ পণ্যগুলো বিক্রিতে লাভও বেশি হয় বলে দোকানিদের দাবি।
এছাড়া অনুমোদনহীন মশার কয়েলেও দেদারছে বিক্রি হচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন দোকানে। লামিয়া নিমপাতা নামক একটি কয়েলের প্যাকেট বা কার্টনের গায়ে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের কোনো নাম নেই। তবে ট্রেড লাইসেন্স ও ভ্যাট নম্বর, ফায়ার লাইসেন্স ও ট্রেড মার্ক উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বিএসটিআই বা পিএইচপি সনদ নেই। পিএইচপির স্থানে উল্লেখ করা আছে ‘আবেদিত’। যদিও বিএসটিআই বলছে, পণ্যের অনুমোদনের জন্য আবেদন করে তা বাজারজাতের কোনও সুযোগ নেই।
পণ্যের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিএসটিআই এবং পণ্যে ভোক্তা অধিকার বলছে, ভেজাল ও নকল ভোগ্যপণ্য তৈরি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে।
মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিএসটিআইয়ের সহকারী পরিচালক বলেন, পণ্যের গায়ে যদি কারখানার পুরো ঠিকানা না থাকে তাহলে পণ্যটি ভুয়া। এদের কারখানা খুঁজে পাওয়া যায় না। আবেদিত বলতে কোনও শব্দ আমাদের কাছে নেই। আবেদন করে কেউ পণ্য বাজারে বিক্রি করতে পারে না। ঠিকানা পেলে আমরা ব্যবস্থা নিব।
তিনি জানান, অবৈধ এমন অনেক কোম্পানি রয়েছে, যাদের একাধিকবার সিলগালা করা হলেও তারা আবারও একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তবে বিএসটিআই বারবার অভিযান চালাচ্ছে। এসব মানহীন পণ্য কেনার ক্ষেত্রে ক্রেতাদেরও সতর্ক হতে হবে।
অবৈধ পণ্য বাজারে থাকার কোনও সুযোগ নেই। অনুমোদন ছাড়া পণ্য বিক্রি করা যাবে না উল্লেখ করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বলেন, জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি যেন ঠুনকো বিষয় নয়। যারা জনস্বাস্থ্য নিয়ে প্রকাশ্যে ছিনিমিনি খেলছে, তারা জঙ্গিদের থেকেও কম ভয়ঙ্কর নয়!
সরবে কোনো হত্যার ঘটনা ঘটালে কিংবা খারাপ কিছু করলে দেখা যায়, বোঝা যায়। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে নীরবে কোনো প্রাণঘাতী কাজ করতে থাকলে তা সহজে মানুষ বুঝতে পারে না। মানহীন পণ্যে বাজার সয়লাব হওয়ার কারণে এমনটি ঘটছে।
বাজার, দোকান, সুপার শপ কোথাও ভেজালমুক্ত খাদ্যপণ্য মিলছে না। আগেকার দিনে মানুষকে বলতে শোনা যেত, কোন কোন খাদ্যে ভেজাল। আর এখন বলতে শোনা যায়, কোন কোন খাদ্য ভেজালমুক্ত।
মাছ ও দুধে ফরমালিন। প্রায় সব ফলে দেয়া হচ্ছে কার্বাইডসহ নানা বিষাক্ত কেমিক্যাল। বিস্কুট, সেমাই, পাউরুটি, নুডলস ইত্যাদিতে মেশানো হচ্ছে কাপড়ের রঙ।
শাকসবজিতে কীটনাশক। জিলাপি-চানাচুরে মবিল। মুড়িতে ব্যবহার হচ্ছে ইউরিয়া। চিনি, আটা ও ময়দায় ব্যবহার করা হচ্ছে বিষাক্ত চক পাউডার।
শিশুখাদ্যের দুধও ভেজাল থেকে রেহাই পাচ্ছে না। অতিরিক্ত রেডিয়েশনযুক্ত দুধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই আমদানি করা হচ্ছে দেদার। দুধে ফরমালিন, সোডা, বরিক পাউডার ও মেলামিন মেশানো হচ্ছে। প্যাকেটজাত তরল দুধও নিরাপদ নয়।
সয়াবিন তেলে অতিরিক্ত অ্যাসিটিক এসিড, পামঅয়েল ও ন্যাপথালিন মেশানো হচ্ছে। ছানার অতিরিক্ত পানির সাথে ভাতের মাড়, অ্যারারুট আর কেমিক্যাল মিলিয়ে তৈরিকৃত সাদা তরল পদার্থকে বানিয়ে দেয়া হচ্ছে ‘গাভীর দুধ’।
কার্বাইড দিয়ে পাকানো হচ্ছে ফলমূল এবং সংরক্ষণে ব্যবহার করা হচ্ছে ফরমালিন। নোংরা পানি ব্যবহার করে ময়লা-আবর্জনাপূর্ণ স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে তৈরি করা হচ্ছে আইসক্রিম। মধুতেও ভেজাল দেয়া হচ্ছে। এখন খাঁটি মধু পাওয়া দুঃসাধ্য। মোড়কজাত ফলের জুসে বিষাক্ত রঙ ও কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে।
কোনো কিছুই ভেজালের ছোবল থেকে বাদ যাচ্ছে না। জীবন রক্ষাকারী পানিও আজ নিরাপদ নয়। শহর এলাকায় যত্রতত্র নকল কারখানা বানিয়ে পুকুর-ডোবা এবং ওয়াসার পানি কোনো রকমে ছেঁকে বাজারজাত করা হচ্ছে। সে পানিতে থাকছে আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম-লেড-ইকোলাই।
এ ছাড়া এগুলো বিশুদ্ধ নামীদামি কোম্পানির সিলমোহর দিয়ে দেদার চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। দেশী-বিদেশী কোনো ফল কেনার আগে ক্রেতাকে কয়েকবার ভাবতে হচ্ছে। সব ফলেই মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল।
অপরিপক্ব ফল পাকাতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড এবং তা উজ্জ্বল করতে ক্ষারজাতীয় টেক্সটাইল রঙ ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি ইট, সিমেন্ট, রড থেকে শুরু করে ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিকসসামগ্রী যে মানসম্মত পাওয়া যাবে; তারও কোনো গ্যারান্টি নেই।
শ্যাম্পু, ফেসওয়াশ, বডি লোশন, বডি স্প্রে, পারফিউম, পাউডার, ক্রিমসহ নানা প্রসাধনসামগ্রীতেও আজ ভেজালের জয়জয়কার। বেশির ভাগ পণ্যে এখন নিরাপত্তা আবরণ না থাকায় গ্রাহকেরা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন।
গবেষণায় ঢাকা শহরের বেশির ভাগ জারের পানিতে মলের জীবাণু পাওয়া গেছে। মেয়াদোত্তীর্ণ কাঁচামালে সুতা রাঙানোর বিষাক্ত রঙ, ভেজাল পাম তেল, সেন্ট, পচা ডিম ইত্যাদি মিশিয়ে ভিন্ন নামে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত ‘খাদ্যদ্রব্যে রাসায়নিক দূষণ ও জীবাণু সংক্রমণ বিষয়ক সমীক্ষা’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার প্রায় ৯০ শতাংশ পথখাবারেই ই-কোলাই, সারমোনেলা ইস্ট মোল্ডের মতো মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর জীবাণু পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশে বেশির ভাগ পথখাবার স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে তৈরি হয় না। এগুলো স্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকর।
বাজারে চর্ব, চুষ্য, লেহ এমন পণ্য পাওয়া কঠিন; যেখানে ভেজাল ও বিষাক্ত উপাদান নেই। ভেজাল ও বিষে ভরা খাদ্যদ্রব্য খাওয়ার কারণে কিডনি ও লিভারে সরাসরি ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে।
বর্তমান সময়ে এমন পরিবার খুব কমই পাওয়া যাবে, যে পরিবারে কিডনি, লিভার কিংবা পেটের সমস্যাজনিত কোনো রোগী নেই। ভেজাল খাদ্য ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কাও তৈরি করে।
ভেজাল খাওয়ার কারণে শিশুদের হার্টের সমস্যা হচ্ছে এবং দৃষ্টিশক্তি কমে যাচ্ছে। গর্ভজাত মায়ের শিশুও বিকলাঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। সারাদেশে মানহীন, অবৈধ, নকল খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যে সয়লাব হলেও বিএসটিআইর কোনো মাথাব্যথা নেই। অনেকে আবার বিএসটিআইর লোগো ছাপিয়ে নকল-মানহীন পণ্যের সাথে লাগিয়ে বাজারজাত করছে।
ভেজাল পণ্যে আক্রান্ত হয়ে ওষুধ খেলে সেখানেও ভেজাল। দেশজুড়ে অবাধে বিক্রি হচ্ছে নিম্নমানের নকল ও ভেজাল ওষুধ। এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রস্তুতকারক, প্রক্রিয়াজাতকারক, সরবরাহকারী সবাই এই ভেজাল প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত। ক্ষেত থেকে শাকসবজি তুলে অপরিষ্কার নালা-ডোবায় ধোয়া হচ্ছে। ফলে পানিতে থাকা জীবাণু শাকসবজিতেও ছড়িয়ে পড়ছে।
পোলট্রিসহ পশু মোটাজাতকরণে অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়াও ব্যবহার করা হচ্ছে স্টেরয়েড-জাতীয় হরমোন। গোশত ও দুধের মাধ্যমে তা কোনো-না-কোনোভাবে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে।
ভেজালের এই দৌরাত্ম্য কি চলতেই থাকবে? শুধু মাঝে মধ্যে ভেজালবিরোধী অভিযান চালালে হবে না, নিয়মিত দেশব্যাপী অভিযান পরিচালনা করতে হবে। নকলবাজ কারখানা ও ভেজাল পণ্য বাজারজাতকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
খাদ্যনিরাপত্তা আইনের যথাযথ প্রয়োগ চাইবে। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, কিন্তু মানুষের দেহে নানা জটিল রোগ বাসা বাঁধছে। ভেজাল বন্ধে সরকারের সদিচ্ছা ও সচেতনতাই যথেষ্ট।
প্রতি বছর প্রয়োজনের অতিরিক্ত তিন-চার গুণ ফরমালিন আমদানি করা হচ্ছে। এসব অতিরিক্ত ফরমালিন কোথায় যায়? এ দেশে ভেজাল কিসে নেই?
দুঃখের সাথে বলতে হয়, পিএইচডির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশে ভেজাল দেখা যায়। এ দেশে শিক্ষা সনদ জাল করেও অনেকে অবাধে চাকরি করে যাচ্ছেন। এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তৎপর হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। ভুয়া ডাক্তার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে প্রতারণার ব্যবসায় চলছে ব্যাপক।
সব ধরনের ভেজালের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অবলম্বন করতে হবে। জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি এবং সবার সুন্দর জীবনের স্বার্থে ভেজালবিরোধী অভিযানে কর্তৃপক্ষকে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে।
Leave a Reply