অনিয়মই নিত্যসঙ্গী

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ৮, ২০২১
  • 1502 পাঠক

দিশারী রিপোর্ট : রসিকতায় অনেক সময় শোনা যায়, টাকা থাকলে জেলখানাও অনেকের কাছে শ্বশুর বাড়ি। সূত্রমতে, সমাজজীবনের সংঘটিত অন্যায়, অবিচার ও অনিয়মের দায়ে যেখানেই শাস্তির জন্যে প্রেরণ করা হয় খোদ সে জেলখানার ভেতরের অনিয়মই নিত্যসঙ্গী। বাইরে ফিটফাট দেখালেও এমন চিত্র নোয়াখালী জেলা কারাগারের অভ্যন্তরে।

——————————————————————-

নোয়াখালী কারাগার

——————————————————————-

বেশ কয়েকদিন জেলে থেকে জামিনে বেরিয়েছেন আজাহার উদ্দিন। বললেন, জেলখানার কিছু অনিয়মের কথা। আজাহার জানান, আমি সুস্থ থাকলেও টাকার বিনিময়ে কারাগারের হাসপাতালে খুব আরাম-আয়াশে ছিলাম। কিন্তু সত্যিকারের যেসব অসুস্থ কয়েদী-হাজতি রয়েছেন তারা ঘুষ দিতে পারেন না বলে হাসপাতালে সুযোগ-সুবিধা পান না।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কারাগারের হাসপাতালের সুযোগ সুবিধা পেতে প্রতি মাসে একজন কয়েদীকে চুক্তিভিত্তিক কয়েক হাজার টাকা দিতে হয়। এর মধ্যে দায়িত্বরত চিকিৎসক পান কিছু এবং কারাগারের অভ্যন্তরে সুপারভাইজারেরও ভাগ রয়েছে। যারা কারাগারের দীর্ঘদিনের সাজাপ্রাপ্ত আসামি, তারাই মূলত সুপারভাইজার হিসেবে পরিচিত। এসব সুপারভাইজার মেচ হিসেবে পরিচিত। খুবই ক্ষমতাশীল হয় মেচরা। তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গেলেই কঠিন সমস্যায় পড়তে হয় কারাবন্দীদের। নতুন কোন বন্দি তাদের সাথে চুক্তি করতে না চাইলে তাদের শোয়ার জায়গা হয় বাথরুমের পাশেই।

এছাড়া অনেক হাজতির স্বজনদের রেখে যাওয়া খাবার ও দৈনন্দিন খরচের জন্যে রেখে নগদ টাকা জমা নিয়েও নয়ছয়ের অভিযোগ রয়েছে। হাজতিরা অনেক সময় নগদ জমা ও খাবারের খবরই পাননা। জানা গেছে, এসব জেলখানার কতেক কর্মচারী ও মেচরা মিলেই আত্মসাত করেন।

হাতিয়ার দলিল জানান, মাদক মামলায় তিন মাস জেল খেটে বের হয়েছেন সম্প্রতি। দলিল জানান, কারাগারের ভেতর টাকা হলে সবই পাওয়া যায়। কারাগারের বাইরে যত শৃঙ্খলা কারাগারের ভেতর ততই বিশৃঙ্খলা। যাদের টাকা আছে তারা এখানে সর্বোচ্চ সুবিধা পান। দলিল বলেন, আমি তিন মাসে কারাগারের ভেতর দেখেছি একটি সিগারেটের জন্য এক কয়েদী আরেক কয়েদীর রাতভর পা টিপে দেয়। শরীর ম্যাসেজও করে দেয়।

লক্ষীপুর জেলা থেকে আবদুল জলিল এসেছেন কারাগারে ছেলেকে দেখতে। তিন ঘন্টা পর তার সিরিয়াল এসেছে। ছেলের সঙ্গে মিনিট দশেক কথা বলে কারাগার থেকে বের হয়ে আবদুল জলিল বলেন, দশ টাকার টিকেট কেটে অপেক্ষা করেছি তিন ঘন্টা। আর আমার বহু পরে এসে একশ টাকার বিনিময়ে চার-পাঁচজন লোক তাদের লোকের সঙ্গে দেখা করে গেল। আফসোস নিয়ে আবদুল জলিল বলেন, বাড়তি টাকা দিতে পারিনি বলে তিন ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে।

কবিরহাটের জমির বলেন, আমি এসেই আমার পরিচিত এক কারারক্ষীকে পাই। যাকে ১০০ বা ৫০ টাকা দেই। উনি সব ম্যানেজ করে ১০ থেকে ১৫ মিনিটেই আমাকে দেখার সুযোগ করে দেয়। আমি দিনে দু-তিন বারও দেখা করতে পারি। আমার এক স্বজনকে গত ছয় মাসে ধরে এভাবেই দেখছি। এমন আরো বহু অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায়।

সরেজমিনে কারাগারের বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করে দেখা যায়, দর্শনার্থী যারা আসেন তারা কারারক্ষীদের ম্যানেজ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। কারা ফটকের সামনে দাঁড়ানো দুজন কারারক্ষীকে দেখা যায়। অপরিচিত কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। এর মাঝেই নাম পরিচয় জানানো ছাড়াই চার-পাঁচজনকে দেখা যায় হাসতে হাসতে কারাগারে প্রবেশ করতে। পরে জানা যায় তারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের লোক। কারারক্ষীদের ম্যানেজ করা আছে বলেই তাদের পথ আটকায় না মূল ফটকের কারারক্ষীরা। অথচ শতাধিক দর্শনার্থী ফটকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও কারারক্ষীদের অনুমতি না থাকায় দীর্ঘ সময় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে একজন কারারক্ষী জানান, প্রতি মাসে ডিসি সাহেব একবার কারাগার পরিদর্শনে আসেন। যেদিন তিনি কারাগার পরিদর্শনে আসবেন, তার আগের দিন কয়েদীদের কোনো ধরনের অভিযোগ-অনুযোগ না জানানোর জন্য হুঁশিয়ার করা হয়। কারা অভ্যন্তরে পরিপাটি করে সাজানো হয় যেন ডিসি কোনো অনিয়ম না দেখেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে নোয়াখালী জেলা কারাগারের জেল সুপার বলেন, আমরা যে কোন ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সজাগ আছি। তারপরেও কোন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ পেলে অবশ্যই খতিয়ে দেখবো|

 

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!