চট্রগ্রাম অফিস
————–
করোনার প্রাদুর্ভাব আপাত সামলে বিভিন্ন রুটে বিমান যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়ে ওঠার সাথে সাথেই আকাশপথে চোরাচালানেরও হিড়িক পড়েছে।
দেশে-বিদেশে অবস্থানরত আন্তর্জাতিক মাফিয়াচক্র স্বর্ণ ও মাদক পাচারের জন্য বিমান বন্দরগুলোকে ব্যবহারের দিকেই ঝুঁকে পড়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার হযরত শাহজালাল এবং চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চোরাপথে পাচারকালে স্বর্ণের বার, ইয়াবা ও সিগারেটের একাধিক চালান জব্দ করা হয়েছে।
একের পর এক স্বর্ণ ও ইয়াবার চালান জব্দের ঘটনায় মাফিয়াচক্র বিমানবন্দরকে চোরাকারবারের নিরাপদ রুট হিসেবে বেছে নিয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন।
বিমানবন্দর সূত্র জানিয়েছে, সর্বশেষ গতকাল শনিবার রাজধানীর হযরত শাহজালাল ও বন্দরনগরীর শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইয়াবা ও স্বর্ণের পৃথক দুটি চালান জব্দ করেছে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর।
এর মধ্যে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে এক হাজার আটশ’ ৭৮ পিস ইয়াবাসহ সৌদিগামী সোহেল রানা নামে এক যাত্রীকে আটক করা হয়। তার জাজিরা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে কুয়েত হয়ে সৌদি আরব যাওয়ার কথা ছিল।
একইদিন সকালে নগরীর শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৮০টি স্বর্ণের বারসহ মো. বেলাল উদ্দিন নামে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ( বেবিচক) এক কর্মচারীকে আটক করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। আটক বেলাল উদ্দিন বেবিচকের এএসজি পদে কর্মরত।
তিনি বিমানবন্দরের টয়লেট থেকে স্বর্ণের বারগুলো পাওয়ার কথা স্বীকার করলেও কোথায় কাকে দেয়ার কথা ছিল সে সম্পর্কে কিছু জানান নি। জব্দকৃত স্বর্ণের বারের বারের ওজন নয় কেজি দুইশ গ্রাম। বাজারমূল্য আনুমানিক পাঁচ কোটি টাকা।
এর আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১৮ হাজার পিস ইয়াবাসহ মো. স্বপন মাতব্বর নামে সৌদি আরবের দাম্মামগামী এক যাত্রীকে আটক করা হয়।
শাহ আমানত বিমানবন্দরে কর্তব্যরত শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সুলতান মাহমুদ বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা ও চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদেশ থেকে চোরাপথে নিয়ে আসা স্বর্ণের বার ও সিগারেটের পাশাপাশি দেশ থেকে নিয়ে যাওয়ার পথে ইয়াবার একাধিক চালান জব্দ করা হয়েছে।
এতে ধারণা করা হচ্ছে, করোনার আপাত নিয়ন্ত্রিত সময়কালে আন্তর্জাতিক মাফিয়ারা আকাশপথকেই তাদের পণ্য পাচারের জন্য ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে। সেই প্রেক্ষাপটে আমরাও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও নজরদারির পাশাপাশি তল্লাশি কার্যক্রমও জোরদার করেছি। এ কারণে স্বর্ণ কিংবা ইয়াবার চালানগুলো ধরা পড়ছে।
শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, বিমানবন্দর দিয়ে কেবল স্বর্ণের বার ও ইয়াবা নয়, গত কয়েকবছর ধরে বিমানবন্দর দিয়ে লাগেজের আড়ালে ভিনদেশি বা শুল্ক ফাঁকি দিয়ে সিগারেট নিয়ে আসার পরিমাণও জ্যামিতিক হারে বেড়েছে।
গত বছরের ডিসেম্বর মাসেই জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে বিমানবন্দরে মোট পাঁচটি পৃথক চালানে দুই হাজার পাঁচশ’ ২৩ কার্টন বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেট জব্দ করা হয়েছে।
তবে বিগত ২০১৮ সালের ২৯ এপ্রিল ফেল্ট (এক ধরনের ফোম) আনার ঘোষণা দিয়ে বিমানবন্দর দিয়ে ১৩ কোটি টাকা বাজারমূল্যের ‘৩০৩’ ও ‘মন্ড’ ব্র্যান্ডের ছয়শ’ ৫০ কার্টন ভিনদেশি সিগারেট আনা হয়।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষের দাবি, বিমানবন্দরে এ পর্যন্ত জব্দকৃত বিদেশি সিগারেটের মধ্যে সেটিই এখন পর্যন্ত সর্ববৃহৎ চালান। ওই বছরের ৭ মে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৬৬ লাখ ৯৪ হাজার শলাকা সিগারেট জব্দ করা হয়।
সর্বশেষ গত ৩১ আগস্ট বিমানবন্দরে কর্তব্যরত জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার একটি দল দুবাই থেকে ছেড়ে আসা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এক যাত্রীর লাগেজ থেকে সাত লাখ ৫৬ হাজার টাকা দামের বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেট জব্দ করেছে।
ওই ফ্লাইটের যাত্রী লোহাগাড়ার আনিসুল ইসলামের ব্যাগেজ থেকে দুইশ’ ৫২ কার্টন মন্ড, ডানহিল ও ৩০৩ ব্র্যান্ডের সিগারেট পাওয়া যায়। প্রতি কার্টন সিগারেটের বাজারমূল্য তিন হাজার টাকা হিসাব করলে এসব সিগারেটের দাম দাঁড়ায় সাত লাখ ৫৬ হাজার টাকা।
অভিযোগ রয়েছে, বিমানবন্দরে দায়িত্বে নিয়োজিত কতিপয় শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেই বাধা পেরিয়ে আসে স্বর্ণ বা সিগারেটসহ চোরাচালানের নানা পণ্য।
স্বর্ণ বা সিগারেটের চালান বিমানবন্দরে আসার আগেই কর্মকর্তাদের পকেটে চুক্তিবদ্ধ টাকা পৌঁছে দেয় চোরাকারবারিরা। বিমানবন্দরে কে কখন দায়িত্বরত রয়েছেন সেই তথ্য কর্মকর্তারাই ফোনে নিশ্চিত করেন চোরাকারবারিদের।
তথ্য পাওয়ার পর বহনকারীদের সিগারেটভর্তি লাগেজসহ আরব আমিরাতের দুবাই কিংবা শারজাহ, সৌদি আরবের জেদ্দা কিংবা ওমান বিমানবন্দর দিয়ে ফ্লাইটে তুলে দেন চোরাচালান চক্রের সদস্যরা। ফ্লাইট অবতরণের পর বহনকারীকে সিগারেটভর্তি লাগেজসহ বিমানবন্দরের বাধা ডিঙাতে বেগ পেতে হয় না।
চুক্তির হেরফের কিংবা নির্ধারিত কর্মকর্তা কোনও কারণে দায়িত্বে না থাকলেই কেবল ধরা পড়ে সিগারেটের চালান।
তবে কোনও চোরাচালানের সাথেই বিমানবন্দরে দায়িত্বরত কাস্টমস কর্মকর্তাদের যোগসাজশের অভিযোগ মোটেও সত্য নয় বলেই দাবি শুল্ক ও গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষের।
Leave a Reply