দিশারী ডেস্ক : তালগাছ ঘিরেই একসময় বাবুইপাখির বাসা আর কিচিরমিচির কলবর জুড়েই থাকতো গ্রামবাংলার আবহমান জনপদ। কালের বিবর্তনে আজ প্রায় বিলুপ্ত শিল্পের কারিগর এই বাবুইপাখি ও তার বাসা।
কবি বলেছেন –
“বাবুই পাখীরে ডাকি’ বলিছে চড়াই,—
“কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই?
আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে
তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে!”
বাবুই হাসিয়া কহে, “সন্দেহ কি তায়!
কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়;
পাকা হোক্, তবু ভাই, পরের ও-বাসা;
নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর—খাসা!”
বাসা তৈরিতে যে এমন সুনিপুণ কারিগর সে তো শিল্পের বড়াই করতেই পারে। কিন্তু কবি রজনীকান্ত সেনের কালজয়ী ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতাটির নায়ক আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী নিপুণ বাসা তৈরির কারিগর বাবুই পাখি আজ বিলুপ্তির পথে।
বাবুই পাখি সাধারণত তালপাতা, ঝাউ, খড়, ও কাশবনের লতাপাতা দিয়েই উঁচু তালগাছের ময়ুর পেখুম ঢালে বাসা তৈরি করে। উঁচু তালগাছে বাঁধা খড়কুটোর সেই বাসা দেখতে বেশ আকর্ষণীয় ও মজবুত হয় এবং প্রবল ঝড়ো বাতাসেও তা ঝরে পড়তো না। বাবুই পাখির শক্ত বুননের বাসা শিল্পের অনন্য সৃষ্টি। যা একজন মানুষের কাছে সহজে টেনে ছেঁড়া সম্ভব হত না।
বাসা তৈরির শুরুতে বাসায় দুটি নিম্নমুখী গর্ত থাকলেও পরে একদিক বন্ধ করে বাবুই পাখিরা তাতে ডিম রাখার জায়গা তৈরি করে। অপর দিকটি লম্বা করে তৈরি করে প্রবেশ ও প্রস্থানের পথ।
বাবুই পাখি বাসা তৈরি করার পর সঙ্গী খুঁজতে যেত অন্য বাসায়। সঙ্গী পছন্দ হলে পুরুষ বাবুই পাখি স্ত্রী বাবুই পাখিকে সাথী বানানোর জন্য ভাব-ভালোবাসা নিবেদন করে এবং বাসা তৈরির কাজ অর্ধেক হতেই স্ত্রী বাবুইকে কাঙ্ক্ষিত বাসা দেখাতো।
কারণ বাসা পছন্দ হলেই কেবল এদের সম্পর্ক গড়ে ওঠবে। স্ত্রী বাবুই পাখির বাসা পছন্দ হলে বাকি কাজ শেষ করতে পুরুষ বাবুই পাখির সময় লাগে মাত্র চার থেকে পাঁচদিন।
পুরুষ বাবুই পাখি এক মৌসুমে প্রায় পাঁচ ছয়টি বাসা তৈরি করতে পারে। স্ত্রী বাবুই পাখির প্রেরণায় পুরুষ বাবুই পাখি মনের আনন্দে শিল্পসম্মত ও নিপুণভাবে বিরামহীন বাসা তৈরির কাজ শেষ করতো।
তবে প্রেমিক বাবুই পাখি যতই ভাব-ভালোবাসা প্রকাশ করুক না কেন, প্রেমিকা বাবুই পাখির ডিম দেয়ার সাথে সাথেই প্রেমিক বাবুই পাখি আবার খুঁজতে থাকে অন্য সঙ্গী। বাবুই পাখি সাধারণত খুটে খুটে বিভিন্ন ধরনের বীজ, ধান, ভাত, পোকা, ঘাস, ছোট উদ্ভিদের পাতা, ফুলের মধু-রেণু ইত্যাদি খেয়ে জীবনধারণ করে।
নোয়াখালীর গ্রামীণ জনপদেই প্রায় বিলুপ্তির পথে বাসা তৈরির কারিগর বাবুই পাখি ও তার বাসা। আগের মতো এখন আর প্রকৃতি প্রেমীদেরও চোখে পড়েনা বাবুই পাখি, চোখে পড়েনা বাবুই পাখির তৈরি দৃষ্টিনন্দন ছোট্ট বাসা ও বাসা তৈরির নয়নাভিরাম নৈসর্গিক দৃশ্য।
একসময় প্রতিটি গ্রামাঞ্চলে সারি সারি উঁচু তালগাছের পাতার সঙ্গে বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা দেখা যেত। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলা দৃষ্টিনন্দন বাবুই পাখি ও তাদের নিজের তৈরি বাসা আজ বিলুপ্তপ্রায়, কালের বিবর্তনে এখন তা আর সচরাচর চোখে পড়ে না।
নোয়াখালীর একজন প্রাণী বিশেষজ্ঞ বলেন’ ‘বাবুই পাখির বিলুপ্তির অন্যতম কারণ হচ্ছে তাদের তাদের নিরাপদ বাসস্থান সংকট। তাল গাছকে ঘিরেই মূলত তারা বাসস্থান গড়ে তুলে। কিন্তু আগে আমরা যে পরিমাণ তালগাছ দেখতে পেতাম তা মারাত্মকভাবে কমে গেছে। যার কারণে এ পাখিটি বাসস্থান গড়ে তুলতে পারছে না। অন্যান্য গাছে তারা বাসা তৈরি করলেও তা ক্ষণস্থায়ী।
এছাড়া পাখির প্রধান খাদ্য ধান। ধানের ফসলি জমিতে বিষাক্ত কীটনাশক ও ফসল রক্ষা করতে যে জাল ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে পাখিটি মারা যাচ্ছে।’
তবে পাখিটি তাল গাছে যে সুনিপুণ নজরকাড়া মজবুত খড়ের বাসা তৈরি করতো এটিকে ঘিরেই মূলত তাদের প্রজনন বৃদ্ধি হতো। এ বাসস্থান সংকটই পাখিটি বিলুপ্তির অন্যতম প্রধান কারণ বলছেন নোয়াখালীর এ প্রাণীবিদ।
Leave a Reply