সয়াবিনের নামে কী খাচ্ছি

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ২৩, ২০২১
  • 388 পাঠক

 নিজস্ব প্রতিনিধি

——————-

এক সময় দেশে রান্নায় একচেটিয়া দাপট ছিল সরিষার তেলের। সেই জায়গা এখন নিয়েছে সয়াবিন। রান্না থেকে শুরু করে যেকোন খাবার তৈরিতে ভোজ্যতেল ব্যবহারে প্রথম পছন্দ এখন সয়াবিন তেল।

কিন্তু দেশে প্রতি বছর যে পরিমান সয়াবিন তেল আমদানি হয়, পামঅয়েল আমদানি হয় তার প্রায় দ্বিগুণ। এই বিপুল পরিমান পামঅয়েল যাচ্ছে কোথায়? নাকি ভোক্তারা বেশি দাম দিয়ে সয়াবিনের নামে পামঅয়েল কিনে প্রতারিত হচ্ছেন? এ প্রশ্ন সংশ্লিষ্টদের? 

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মোট ২১ লাখ ১৬ হাজার টন ভোজ্যতেল আমদানি করা হয়েছে।

এর মধ্যে সয়াবিন তেল ৬ লাখ ৭৩ হাজার টন, পামঅয়েল ১২ লক্ষ ৬১ হাজার টন, সরিষার তেল ১ লাখ ৮২ হাজার টন আমদানি করা হয়েছে।

এছাড়া আমদানিকৃত সয়াবীজ থেকে স্থানীয়ভাবে ৩ লাখ ২৬ হাজার টন সয়াবিন তেল উৎপাদন করা হয়েছে। এই উৎপাদিত সয়াবিনের বড় অংশই পশুখাদ্য তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়।

তবে শুধু চলতি বছরই নয়, গত ৫ বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সয়াবিনের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ পরিমানে পামঅয়েল আমদানি হয়েছে। ২০২০ সালে মোট ২৩ লাখ ৫ হাজার টন ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে।

এরমধ্যে সয়াবিন তেল ৮ লাখ ৩২ হাজার টন, পামঅয়েল ১৩ লাখ ১২ হাজার টন, সরিষা ১ লাখ ৬১ হাজার টন তেল আমদানি করা হয়েছে। এছাড়া আমদানিকৃত সয়াবীজ থেকে স্থানীয়ভাবে ৩ লাখ ৮৪ হাজার টন তেল উৎপাদন করা হয়েছে।

২০১৯ সালে মোট ২৪ লাখ ৩০ হাজার টন ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে। এরমধ্যে সয়াবিন তেল ৮ লাখ ১৩ হাজার টন, পামঅয়েল ১৫ লাখ টন, সরিষার তেল ১ লাখ ১৭ হাজার টন আমদানি করা হয়েছে।

এছাড়া  আমরাদানি করা সয়াবীজ থেকে স্থানীয়ভাবে ৩ লাখ ৪০ হাজার টন তেল উৎপাদন করা হয়েছে। ২০১৮ সালে মোট ২৬ লাখ ৬২ হাজার টন ভোজ্যতেল আমদানি করা হয়েছে। এরমধ্যে সয়াবিন তেল ৯ লাখ ৩১ হাজার টন, পামঅয়েল ১৭ লাখ টন, সরিষার তেল ৩১ হাজার টন আমদানি করা হয়েছে।

এছাড়া সয়াবীজ থেকে স্থানীয়ভাবে ২ লাখ ৬ হাজার টন তেল উৎপাদন করা হয়েছে। ২০১৭ সালে মোট ২৬ লাখ ৩৮ হাজার টন ভোজ্যতেল আমদানি করা হয়েছে। এরমধ্যে সয়াবিন ৮ লাখ ৯৭ হাজার টন, পামঅয়েল ১৭ লাখ টন ও সরিষার তেল ৪১ হাজার টন আমদানি করা হয়েছে।

এছাড়া আমদানিকৃত সয়াবীজ থেকে স্থানীয়ভাবে ২ লাখ ৭ হাজার টন সয়াবিন তেল উৎপাদন করা হয়েছে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, গত কয়েক বছর ধরেই সয়াবিনের চেয়ে প্রায় দ্বিগুন পরিমানে পামঅয়েল আমদানি হচ্ছে। মালয়েশিয়ান পামওয়েল কাউন্সিলের (এমপিওসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে উদ্ভিদজাত চর্বি বা বনস্পতি শিল্পে বছরে চার লাখ ৫০ হাজার টন, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে দুই লাখ টন, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ফাস্ট ফুড ইত্যাদিতে দুই লাখ টন পাম তেল ব্যবহার হচ্ছে।

আর রান্নায় ব্যবহার হয় সাত লাখ টন পামঅয়েল। কিন্তু রান্নায়তো দেশের মানুষের প্রথম পছন্দ সয়াবিন তেল। এ ব্যাপারে এক ধরনের প্রচারণাও রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বর্তমানে খুচরা বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা ও খোলা পামঅয়েল ১২৫ থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ লিটারে ১৫ টাকা বেশি। তাই অধিক মুনাফার লোভে তুলনামূলক কম দামের পামঅয়েলকে সয়াবিন বলে বিক্রি করছে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী।

এমপিওসি প্রায় দুই দশক আগে এ ব্যাপারে বাংলাদেশে একটি গবেষণা করেছিল। সেসময় আজকের মতো সয়াবিন তেল এতটা জনপ্রিয় হয়নি। তখনই সয়াবিনের নামে বেশি দাম দিয়ে পামঅয়েল কিনে ভোক্তারা প্রতি মাসে ২৮ থেকে ৩০ কোটি টাকা প্রতারিত হচ্ছেন বলে গবেষণায় তুলে ধরা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে দুই দশকের আগের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি ভোজ্যতেল আমদানি হচ্ছে। সয়াবিনের আমদানি যেমন বেড়েছে, সেইসাথে বেড়েছে পামঅয়েলের আমদানিও।

এ হিসেবে বর্তমানে ভোক্তারা সয়াবিনের নামে বেশি দামে পামঅয়েল কিনে প্রতি মাসে এক’শ থেকে দেড়’শ কোটি টাকার বেশি দিতে হচ্ছে। আর বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা প্রতারিত হচ্ছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মূলত খোলা সয়াবিন, পামঅয়েল কেনার ক্ষেত্রে ভোক্তারা বেশি প্রতারিত হচ্ছেন। কারণ, সাধারণ মানুষ খোলা সয়াবিন ও পামঅয়েলে মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন না। আর এই সুযোগটাই নেন এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী।

এ প্রসঙ্গে ভোজ্যতেল বিশেষজ্ঞ ও  মালয়েশিয়ান পামওয়েল কাউন্সিলের সাবেক রিজিওনাল ম্যানেজার (বাংলাদেশ ও নেপাল) এ. কে. এম. ফখরুল ইসলাম বলেন, পামঅয়েলের গুণগত মান অনেক ভালো। দামেও সয়াবিনের চেয়ে কম।

আর গ্রামাঞ্চলের বিক্রেতারা বেশি এই সুযোগটা নেয়। তবে তেলের সঙ্গে অন্য কিছু মেশানো যায় না। তেলের সাথে শুধু তেলই মেশানো যায়।

বর্তমানে বাজারে চাহিদার ৩০ শতাংশ ভোজ্যতেল বোতলজাত করে বিক্রি করা হয়। বাকিটা খোলা বিক্রি করা হয়। ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করা কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)’র সহ-সভাপতি এফ. এম নাজির হোসেইন জানান, বেশি দাম দিয়ে সয়াবিনের নামে পামঅয়েল কিনে দীর্ঘদিন ধরেই ভোক্তারা প্রতারিত হচ্ছেন।

এ ব্যাপারে আমরা সরকারের নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেছি। তাদের বলেছি, বোতল বা প্যাকেটজাত ভোজ্যতেলের বাইরে কোন তেল বিক্রি করা যাবে না। সয়াবিন কিংবা পামঅয়েল যে তেলই হোক তা প্যাকেট করে বিক্রি করতে হবে।

তিনি বলেন, এতে ভোক্তাদের প্রতারিত হওয়ার সুযোগ কমে আসবে। কারণ, ভোক্তারা জানবেন তিনি সয়াবিন কিনছেন নাকি পামঅয়েল কিনছেন।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!