———————–
কথায় আছে, ভূতের পা পেছনদিকে। ভূত সামনে যাওয়ার জন্য যতই দৌড়ুক, ভূত কেবল পেছনেই যায়। দুর্বল বা কৃত্রিম গণতন্ত্রে বা গণতন্ত্রবিহীন রাষ্ট্রব্যবস্থায় উন্নয়নের অগ্রগতি ভূতের পায়ে দৌড়ানোর মতোই। এ উন্নয়ন জাতিকে অগ্রগতির দিকে না নিয়ে পেছনে ঠেলে দেয়।
ভূতের পাঁচটি পা এবং প্রত্যেকটা পা-ই অশুভ। অর্থাৎ পাঁচটি পা পাঁচটি অশুভকে ইঙ্গিত করে। অবশ্য বিভিন্ন যুগে এ পাঁচটি অশুভের ধরন পালটায়। দুর্বল বা কৃত্রিম গণতন্ত্রে বা গণতন্ত্রবিহীন রাষ্ট্রব্যবস্থায় ভূতের পাঁচটি পায়ের মতোই পাঁচটি অশুভ অবস্থা বিদ্যমান থাকে এবং প্রকৃত উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। এ অশুভগুলো হচ্ছে বিতর্কিত নির্বাচন, অপশাসন, দুর্নীতি, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয় এবং সামাজিক বৈষম্যের আধিক্য।
রাষ্ট্র বা সমাজের উন্নয়নের মাপকাঠি কেবল আর্থিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হতে পারে না। অথচ দুর্বল ও কৃত্রিম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এ আর্থিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নকেই উন্নয়নের মাপকাঠি ধরে ঢাকঢোল পেটানো হয়। উন্নয়নের অর্থ জীবন মানের উন্নয়ন।
জীবন মানের উন্নয়নের বহু উপাদানের মাঝে নৈতিকতার ও মূল্যবোধের উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে আর্থিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকে সমাজ ধাবিত হলে, সমাজ যে অন্ধকারের পথে ধাবিত হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সামাজিক উন্নয়নের দ্বারাই কেবল প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব। কারণ সামাজিক উন্নয়ন ব্যবস্থায় ব্যক্তি ও সামাজিক শক্তি, দক্ষতা, গুণমান, উৎপাদনশীলতা, জটিলতা নিরসনে সক্ষমতা, বোধ্যগম্যতা, সৃজনশীলতা, পছন্দ, আয়ত্ত, উপভোগ এবং কৃতিত্বের ঊর্ধ্বমুখী গতি থাকে। কিন্তু দুর্বল ও কৃত্রিম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বা গণতন্ত্রবিহীন ব্যবস্থায় সামাজিক উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ না করে অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়।
মহামারির সময়ও এর কোনো ব্যত্যয় হয় না। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যে মহামারি এসেছে, তার ব্যাপক বলি দরিদ্র শ্রেণির জনগণ। কারণ মহামারি চলাকালে শিল্পপতি এবং ধনিক ও শাসকশ্রেণি থাকে সুরক্ষাবলয়ে। কিন্তু তারা তাদের আয় যাতে কমে না যায় বা তাদের নিজস্ব উন্নয়ন যাতে থেমে না যায়, সেজন্য দরিদ্র শ্রেণিকে সুরক্ষাবলয়ের বাইরে ঠেলে দেয় জীবিকার এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দোহাই দিয়ে।
জীবিকার প্রয়োজনে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সুরক্ষাবলয়ে অবস্থান করার কোনো সুযোগও থাকে না। অভুক্ত সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে জীবিকার সন্ধানে। এ সুযোগটাই গ্রহণ করে সুরক্ষাবলয়ে অবস্থানকারী ধনিক ও শাসকশ্রেণি। এ ছাড়া বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় দুর্ঘটনায় শিশু ও নারী শ্রমিকদের ব্যাপক প্রাণহানি, গার্মেন্টস কর্মীদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার স্বার্থে যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং তারাও যেভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা সামাজিক উন্নয়নের ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
ব্যক্তির উন্নয়ন, সামাজিক উন্নয়ন, রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন একইসূত্রে গাঁথা। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা রক্ষার দ্বারাই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন টেকসই হয়। এ ছাড়া সামাজিক উন্নয়নের দ্বারা সমাজের প্রতিটি ব্যক্তির জীবনমানের যেমন উন্নয়ন হয়, রাষ্ট্রের উন্নয়ন দ্বারা তদ্রূপভাবে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটে।
প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রতিটি নাগরিক আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদার সঙ্গে তাদের স্বপ্নের দিকে যাত্রা করে। কারণ সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কল্যাণ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত থাকে।
কেবল প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক বিকাশের দ্বারা একটা সুস্থ সমাজ গড়ে ওঠে। শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ব্যক্তিই কেবল আত্মবিশ্বাসী হতে পারে এবং এ আত্মবিশ্বাসী নাগরিকরাই রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল নাগরিক হয়ে ওঠে এবং সমাজ তথা রাষ্ট্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে, ইতিবাচক পরিবর্তনকে সাদরে গ্রহণ করে, নেতিবাচক পরিবর্তনকে প্রতিহত বা প্রতিরোধ করে।
উন্নয়ন এমন একটি প্রক্রিয়া যা বৃদ্ধি করে প্রবৃদ্ধি, অগ্রগতি, ইতিবাচক পরিবর্তন বা ভৌত অবকাঠামো, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত, সামাজিক ও জনসংখ্যার উপাদানগুলোর সংযোগ। উন্নয়নের উদ্দেশ্য হলো জনগণের জীবনযাত্রার স্তর ও মানের উন্নয়ন এবং পরিবেশের কোনোরূপ ক্ষতিসাধন না করে স্থানীয়, আঞ্চলিক আয় বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সম্প্রসারণ। জীবনমানের গুণগত পরিবর্তনের ধারা সৃষ্টি ও অব্যাহত রাখার বিষয়টি দৃশ্যমান হয়, যা দুর্বল ও কৃত্রিম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে আন্তর্জাতিক মহল উন্নয়নের প্রতি মনোনিবেশ শুরু করে। ওই সময় একটি ধারণা সৃষ্টি হয়, জনগণের জীবনযাত্রার স্তর ও জীবনমানের উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অতি প্রয়োজনীয় নয়, যতটা প্রয়োজনীয় সম্পদের সুষম বণ্টন। এ ছাড়া উন্নয়ন এমন একটি হাতিয়ার যা একজন ব্যক্তিকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিকভাবে কর্মের স্বাধীনতা দিয়ে তাকে তার সক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তরে উপনীত হওয়ার সুযোগ প্রদান করে।
এ ছাড়া লিঙ্গ বৈষম্য হ্রাস এবং নারীর ক্ষমতায়নের গতি বৃদ্ধি পাওয়াও উন্নয়নের লক্ষণ। প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শোষণ এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক নিপীড়নসহ বিভিন্ন ধরনের দারিদ্র্যের ফাঁদগুলো বন্ধ করা সম্ভব হয়, যা দুর্বল ও কৃত্রিম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সম্ভব হয় না। যার জন্য প্রয়োজন প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের দ্বারা দারিদ্র্যের এ ফাঁদগুলোকে বন্ধ করে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে উন্নয়নকে সংযুক্ত করার প্রয়াসকে এগিয়ে নেওয়া।
দুর্বল বা কৃত্রিম গণতন্ত্রে বা গণতন্ত্রবিহীন রাষ্ট্রব্যবস্থায় ক্ষমতার কেন্দ্রের অর্থাৎ সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের চারপাশে একটা দুষ্টচক্র মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ দুষ্টচক্র নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সর্বদাই সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানকে প্রকৃত অবস্থা অনুধাবনে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
এ দুষ্টচক্র যত শক্তিশালী হয়, দেশ ও সমাজে ততই অপশাসন, দুর্নীতি ও সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধি পায় এবং প্রকৃত উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া পরিবেশগত সম্পদের ক্ষতি না করে জীবনযাত্রার স্তর ও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি এবং স্থানীয়, আঞ্চলিক আয় এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি বা সম্প্রসারণ করার উন্নয়নের যে উদ্দেশ্য, তা-ও ব্যাহত হয়।
মনে রাখতে হবে, নাগরিকদের নৈতিকতার উন্নয়ন ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ব্যতীত উন্নয়ন অর্থহীন। যে রাষ্ট্রব্যবস্থায় উন্নয়নের স্বার্থে নৈতিকতাকে বিসর্জন দেওয়া হয়, ওই রাষ্ট্রকে উন্নত রাষ্ট্র হিসাবে গণ্য করার কোনো সুযোগ থাকে না। তেমনিভাবে জীবন ও জীবিকার দ্বন্দ্বে যে সমাজে জীবিকার কাছে জীবন হেরে যায়, ওই সমাজকে উন্নত সমাজ বলা গেলেও সুস্থ সমাজ বলা যাবে না।
মো. ফিরোজ মিয়া : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব, চাকরি ও আইন সংক্রান্ত গ্রন্থের লেখক।
Leave a Reply