তাওহীদুল হক চৌধুরী : একসময় গ্রাম বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে রান্না-বান্না, খাওয়া-দাওয়া, অতিথি আপ্যায়ন, বিয়ে-শাদীসহ প্রায় সবকাজেই ব্যবহার করা হতো মাটির তৈরি হাড়ি পাতিল ও অন্যন্য সরঞ্জামাদি। গ্রাম বাংলার এ ঐতিহ্য হাজার বছরের পুরোনো। স্বাস্থ্যকর আর সহজলভ্য ছিল বলে সব পরিবারেই ছিল মাটির দ্রব্যাদির বিপুল ব্যবহার।
শীতে খেজুর রস সংগ্রহের জন্য মাটির হাড়ি-কলসি, দধির পাতিল, বাহারি চিতই, পুলিপিঠা ও ভাপাপিঠাসহ নানান জাতের পিঠা তৈরীর জন্য খোলা, টালি, ঘট, মুচি, মুটকি, থালা-বাসনসহ বিভিন্ন মাটির সরঞ্জাম তৈরি করতো গ্রামবাংলার কুমোরেরা। তাদের আয়-রোজগারের একমাত্র মাধ্যম ছিলো এই পেশা। বংশ পরস্পরায় এ পেশায় খড়, কাঠি আর মাটির সাথে তাদের জীবনপণ যুদ্ধ ছিলো আজীবনের।
আগেকার দিনে কুমোরদের মাটির তৈরি বাহারি সরঞ্জাম তৈরি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন কুমোর পাড়ায় ভীড় জমাতো। কাঁচা মাটির তৈরি সরঞ্জামাদি পোড়ানোর সময় কুমোরেরা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী আয়োজন করতো নানান অনুষ্ঠানের। আগত অতিথি বা দর্শকদের তারা এ সময় বিলি করতো মিষ্টি,চিড়া কিংবা মুড়ির মোড়া। এটাই ছিল তখনকার গ্রাম বাংলার কুমোরদের বাড়ির চিত্র।
সময়ের পেক্ষাপটে হারিয়ে গেছে এসব চিত্র। সময়ের বিবর্তনে সিরামিক, প্লাস্টিক এবং স্টীলসহ নানাবিধ ধাতব পণ্যের দৌরাত্বে মাটির তৈরী পণ্যের চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় বর্তমানে কুমোরেরা তাদের বংশানুক্রমিক পেশা ছেড়ে ভিন্নপেশায় ধাবিত হচ্ছে। এর ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে হাজার বছরের গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য মৃৎশিল্প।
নোয়াখালী জেলার ৯টি উপজেলায় এক সময়ে হাজারের অধিক পরিবার মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত থাকলেও সময়ের প্রেক্ষাপটে এবং বর্তমান যান্ত্রিক যুগে কুমোর পরিবারের সংখ্যা নেমে এসেছে দেড় শতাধিকে।
এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, জেলার সুবর্ণচর উপজেলায় এখন মাত্র ১৮ থেকে ২০টি পরিবার, সদর উপজেলায় ৮ থেকে ১০ পরিবার, বেগমগঞ্জ উপজেলা ২৫ থেকে ৩০টি পরিবার, সোনাইমুড়ীতে ১০ থেকে ১৫টি পরিবার, চাটিখিলে ৮ থেকে ১০ টি পরিবার, হাতিয়া উপজেলায় ৩৫ থেকে ৪০ টি পরিবার, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ১২ থেকে ১৫টি পরিবার, কবিরহাট উপজেলায় ১০ থেকে ১২ টি পরিবার, সেনবাগ উপজেলায় ১৫ থেকে ২০টি পরিবার মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত।
সরেজমিনে সুবর্ণচর উপজেলার পুর্বচর বাটা ইউনিয়নের ছমিরহাট বাজার এলাকায় কয়েকজন কুমোরের সাথে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে এ পেশার সাথে জড়িত থেকে সংসার পরিচালনা তাদের অনেক দুর্বিসহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিমল পাল নামে এক কুমোর ও তার স্ত্রী জানান তাদের দুর্বিসহ কষ্টের কথা । এ পেশায় ঠিকমতো সংসার চলেনা তাদের। খেয়ে না খেয়েই কাটে তাদের সংসার । এ পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় যাওয়ার পুঁজি নেই বলে পেশা পরিবর্তন করতে পারছেন না তারা। থলেশ্বর পাল নামে আরেক কুমোর জানান, একসময় মাটি পেতাম বিনা মুল্যে আর এখন তা ক্রয় করতে হয়।
কিন্তু বর্তমান বাজারে মাটির তৈরি দ্রব্যাদির চাহিদা না থাকায় ভালো দাম নেই। ফলে বিক্রয় মূল্যের সাথে তৈরী খরচ তেমন ওঠে আসে না। অপরদিকে, গত দুবছর আগেও প্রতি গাড়ি মাটির দাম ছিল মাত্র চারশো টাকা। এখন তা বারশত টাকায় কিনতে হচ্ছে।
অন্যদিকে, কাঁচামাল পোড়ানোর জন্য ব্যবহৃত কাঠ আর খড়ের দাম বেড়েছে গত কয়েক বছরে কয়েকগুন। সব মিলিয়ে বাজারের সব কিছুর দাম বাড়লেও দাম বাড়েনি মাটির তৈরি সরঞ্জামের । একটি খোলা তৈরিতে প্রায় দশ টাকা খরচ হলেও বিক্রি করতে হয় বার টাকা। অথচ গত দশ বছরের এটির দাম বাড়েনি।
এছাড়াও আগের মতো এখন আর মাটির পাত্রের চাহিদা নেই। কারো প্রয়োজন হলে মাঝেমধ্যে নেন। বছরের অধিকাংশ সময়ই কাটে কুমোরদের বসে থেকে। এ পেশায় থাকার কারনে আর কোন কাজ করতে পারেন না তারা। এজন্য সংসার চালাতেও তাদের খুব কষ্ট হয়। কুমোর পেশার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা মূলত পাল বংশের। একসময় পালদের সবাই ছিল কুমোর পেশার সাথে জড়িত থাকলেও যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে পড়াশোনা করে চাকরি আর নানা পেশায় যেতে বাধ্য হয়েছে।
ব্যাংক কর্মকর্তা খোকন, সরকারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অনুপম এবং সহকারি স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শিমুল পাল জানান, বর্তমানে এই পেশার পণ্যের চাহিদা না থাকায় এ পেশার সাথে জড়িতরা এখন অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছে। যুগের সাথে তারা তাল মিলিয়ে বাপ-দাদার পেশাকে ছেড়ে অন্য পেশায় যাচ্ছে। তারা জানান, সরকারি সহযোগিতা আর বাজারের চাহিদা থাকলে হয়তো হাজার বছরের ঐতিহ্য এ পেশাটিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। নতুবা কালের আবর্তনে হারিয়ে যাবে বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প। এ শিল্পকে ধরে রাখতে সরকারি অর্থায়নের পাশাপাশি জনসাধারনকে মাটির দ্রব্যাদির ব্যবহারের পরামর্শ দেন তারা।
Leave a Reply