দিশারী রিপোর্ট
—————————-
দেশে ক্রমশ বাড়ছে শিশু নির্যাতন ও হত্যা। বিভিন্ন সংগঠন থেকে পাওয়া তথ্য মতে, শিশুর প্রতি সহিংসতার এই মাত্রা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। পথে-ঘাটে, মাঠে, স্কুল-মাদ্রাসায়ও আজ শিশুরা নিরাপদ নয়।
শিশুকে শারীরিক শাস্তি, সহিংস আক্রমণ, ঘুমন্ত শিশুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা, হত্যার পর শিশুর লাশ টুকরো করে ডাস্টবিনে ফেলে রাখা ও অপহরণের মতো ঘটনা যেন দৈনন্দিন সংবাদের মুখরোচক গল্পে পরিণত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতার অভাব ও বিকৃত মানসিকতার কারণে শিশুর প্রতি এমন নির্মমতা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। পাশাপাশি মানসিক অস্থিরতা, স্বামী-স্ত্রীর পরকীয়ার কুপ্রভাব ও মাদকাসক্তির কারণেও সর্বস্তরেই শিশুরা প্রতিহিংসার বলি হচ্ছে। শিশু আইন ২০১৩-এর ৭০ ধারা অনুযায়ী শিশুর প্রতি শারীরিক ও মানসিক নিষ্ঠুর আচরণ শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ।
আইনে বলা আছে, কোনো শিশুকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করার ঘটনা বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত ২৭, ৩১, ৩২ ও ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদে বর্ণিত সাংবিধানিক অধিকার সমূহের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কিন্তু আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নেই। অপরাধের প্রেক্ষাপটে ইতিবাচক পরিবর্তন দৃশ্যমান হচ্ছে না। ফলে নির্মমতার বলি হচ্ছে শিশুরা।
বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ১০ মার্চ রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের দূর্গাপুর গ্রামে বিষ মেশানো মিষ্টি খাইয়ে দুই সহোদর শিশু ইয়াছিন ও মোরসালিন খানকে হত্যা করে তার মা। টানা সাত মাসের পরকীয়া প্রেম ও দফায় দফায় শারীরিক সম্পর্কের পর প্রেমিক শিশুদের নিয়ে বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় তাদের দুনিয়া থেকে সরাতে পথ খুঁজতে থাকে তারা। একপর্যায়ে বিষ মেশানো মিষ্টি পাঠায় পরকীয়া প্রেমিক।
সেই বিষ মেশানো মিষ্টি খাইয়ে দুই সন্তানকে হত্যা করা হয়। গত ১৩ এপ্রিল নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে জমি নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে পূর্ববিরোধের জেরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয় বাবার কোলে থাকা শিশু জান্নাতুল ফেরদাউস তাসপিয়া। এদিকে ১৮ এপ্রিল সিলেটের হাওলাদারপাড়া থেকে রাহুল দাস নামে তিন বছর বয়সি শিশুর লাশ বাঁশঝাড় থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।
এমন নির্মমতার বলি শুধু শিশু ইয়াসিন, মোরসালিন, তাসপিয়া অথবা রাহুল দাসই নয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, জানুয়ারি এপ্রিল পর্যন্ত ১৭৬টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। পাশাপাশি শিশু হত্যা, বলাৎকার, শিক্ষকদের দ্বারা শিশু নির্যাতন, শাররিক নির্যাতন, গুম, যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটেছে ৩৬৬টি।
বিভিন্নভাবে সহিংসতার শিকার শিশুদের মাঝে শূন্য থেকে ছয় বছর বয়সি ৪৩ জন, সাত থেকে ১২ বছর বয়সি ৮১ জন এবং ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সি ৮৩ জন। আসকের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালে শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে ৫২১টি, ২০১৯ সালে এই সংখ্যা কিছুটা কমে ৪৮৮টি হলেও পরবর্তী বছর ২০২০ সালে এই সংখ্যা ৫৮৯টি। সর্বশেষ ২০২১ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৯৬।
অপরদিকে শিশুর প্রতি বহুমাত্রিক সহিংসতার পরিসংখানে দেখা গেছে, ২০১৮ সাথে সহিংসতার শিকার হয় ১০১১ জন, ২০১৯ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬২২। পরবর্তী বছর ২০২০ সালে সহিংসতার ঘটনা আরও বেড়ে ১৭১৮-তে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ২০২১ সালে এ সংখ্যা ১৪২৬ হলেও ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মাঝেই ৩৬৬ জন শিশু নানাভাবে সহিংসতার শিকার হয়।
এদিকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদ জানিয়েছে, ২০২১ সালে তিন হাজার ৭০৩ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১২৩৫ জন। এর মধ্যে ৬২৯ জন কন্যাশিশুসহ ১০১৮ জন ধর্ষণের শিকার, ৬২ জন কন্যাশিশুসহ ১৭৯ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, ২২ জন কন্যাশিশুসহ ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৩১ জন, ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন আরও সাতজন।
দেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের সাথে পাল্লা দিয়ে শিশুর প্রতি সহিংসতার এমন ঘটনার কারণ ও সমস্যা নিরসনে কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে এমন প্রশ্নের উত্তরে অপরাধ বিশেষজ্ঞ মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, শিশু হত্যা ও সহিংসতা ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাওয়া জাতির জন্য অশনিসংকেত। পারিবারিক কলহ, শিশুর সুষ্ঠু বিকাশের পরিবেশ বিঘ্নিত করা, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দেয়া, সুস্থ বিনোদনের অভাব, পশ্চিমা সংস্কৃতির করাল থাবা ইত্যাদি কারণে শিশু হত্যা ও সহিংসতার হার পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
গৃহকর্মী দ্বারা শিশু নির্যাতন হচ্ছে অহরহ। তাছাড়া পরিবার প্রধানের সাথে শত্রুতার রেশ ধরে শত্রু কর্তৃক শিশুরা নির্যাতিত হয়ে থাকে, পাশাপাশি অল্প আয়ের মানুষের কাছে শিশুরা অনেক সময় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, সময়ের সাথে সাথে এই বোঝাই রূপ নিচ্ছে সহিংসতায়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইলে শিশুদের প্রতি সদয় দৃষ্টি দিতে হবে।
এছাড়া কাউন্সেলিংয়ের বিকল্প নেই, পরিবার প্রধানের সঙ্গে শিশুদের সুসম্পর্ক ও পরস্পরকে বুঝার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। কর্মজীবী মায়েদের জন্য কার্যকরী ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করতে হবে। সর্বোপরি সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুসংহত ও জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
এ প্রসঙ্গে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের এক অধ্যাপক বলেন, শিশুমৃত্যুর এই সংখ্যাগুলো উদ্বেগের। কিন্তু আমরা আগে সংখ্যা জানতে পারতাম না, ফলে মৃত্যু অনেক কম মনে হতো। কিন্তু বর্তমানে তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগ অবারিত হওয়ায় এ সমস্যা কমে এসেছে। ওঠে আসছে সমাজের আসল চিত্র। মূলত সামাজিক অবক্ষয় থেকেই এই অপরাধগুলো ঘটছে। এর জন্য আমাদের সমাজব্যবস্থা অনেকখানি দায়ী।
তবে শিশুর প্রতি সহিংসতার প্রধান কারণ পারিবারিক অস্থিরতা ও দাম্পত্য কলহ। বাবা-মায়ের মাঝে দাম্পত্য কলহ একপর্যায়ে শিশুর প্রতি সহিংসতা এমনকি হত্যা অবধি পৌঁছায়। পাশাপাশি শিশুদের আদর ও শাসনের সমন্বয় না থাকাও আরেকটি সমস্যা। বাবা-মায়ের যথাযথ প্যারেন্টিংয়ের অভাব রয়েছে।
এছাড়া ঘনিষ্ঠজনদের সাথে সম্পর্ক কমে গিয়ে ক্রমাগত মোবাইল ফোনের আসক্তিও অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহুরে পরিবারগুলোতে মা-বাবারা অতিরিক্ত অর্থ আয়ের পিছনে ছুটে যান্ত্রিক জীবনযাপন করছেন। ফলে সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছেন না, এসব ক্ষেত্রে দেখা যায় শিশুরা গৃহ পরিচারিকার দ্বারাও নির্যাতনের শিকার হয়। সমস্যা সমাধানে সরকারি-বেসরকারিভাবে প্যারেন্টিং প্রশিক্ষণ ও স্কুল-কলেজ এবং মাদ্রাসাগুলোতেও মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে শিশুদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নির্যাতন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, যেকোনো সমাজেই সুশাসনের অভাব ঘটলেই এ ধরনের অপরাধ বৃদ্ধি পায়। সাথে সাথে মানুষ যখন মনে করে অপরাধ করেও পার পেয়ে যাবে তখনই এ সমস্যা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে।
সুতরাং বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও সুশাসনের অভাব দেখা দিলেই সমাজে সাধারণত অপরাধ বাড়তে থাকে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে শিশু হত্যার মতো এমন জঘন্য ঘটনার পেছনে সামাজিক অস্থিতিশীলতা কাজ করে। পাশাপাশি মানুষের ব্যক্তি জীবনের হতাশা, বেকারত্ব ও আইনশৃঙ্খলার অবনতিতেই অপরাধ বাড়ছে। সমস্যা সমাধানে আইনকে নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে।
আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আইনের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিচার দেয়ার মাধ্যমে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সে বিষয়েও খেয়াল রাখা জরুরি। সাথে সাথে কাউন্সেলিং করলেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
দেশে শক্ত আইন থাকার পরও এমন সমস্যা ক্রমশ বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে ব্যারিস্টার কাজল বলেন, আমাদের দেশে আইন থাকলেও আইনের পর্যাপ্ত প্রয়োগ নেই। তাছাড়া বিচারের দীর্ঘসূত্রতা আরও বড় সমস্যা। বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা হলে বিচারের যে প্রভাব সমাজে রাখার কথা তা সম্ভব হয় না।
Leave a Reply