মানবাধিকার : গলায় ফিতা ঝুলিয়ে অভিনব ধান্ধা

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ১৫, ২০২১
  • 778 পাঠক

দিশারী রিপোর্ট ||

জেলা শহরের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। সর্বদাই গলায় মানবাধিকার কর্মীর পরিচয় ঝুলিয়ে অভিনব ধান্ধায় ঘুরঘুর করেন। মক্কেল খোঁজেন।

কোন অসহায়, নির্যাতিত, হতাশাগ্রস্ত ও অধিকার বঞ্চিত মানুষ পেলেই বেশ হয়ে গেলো। চা দোকান বা কারো সাথে ভাবজমানো ছোটখাটো দরবারে ওই মানুষদের নিয়ে নিজেকে নিজে বাহনা দেন। বলেন , আমি অমুককে এটা করেছি, তমুককে ওঠা দিয়েছি।

জেলা শহরে ভবঘুরে গলায় ফিতা লাগানো কথিত এক মানবাধিকার কর্মীর বিষয়ে বিস্তারিত খোজঁ খবর নিয়ে জানা গেছে, তিনি নিজের নাম দস্তখতও জানেননা। অথচ, এ লোকটিও নিজেকে মানবাধিকার কর্মী পরিচয়ে হাবভাব দেখান।

জানা গেছে, এসব ধান্ধাবাজের পেছনেও রয়েছে বিশেষ কোন না কোন মক্করবাজ। অবশ্য গুরু সম্বোধনের এই মক্করবাজরা প্রায় থাকেন পর্দারও আড়ালে আবড়ালে। তবে ধান্ধা-কান্ধার ব্যাপারে একচুলও ছাড় নেই তাদের। কর্মীর মাধ্যমে হাতিয়ে নেন একেবারে চুলছেরা হিসেব।

অবশ্য, এ ধান্ধাবাজরাও ফায়দা লুটার আড়ালে নিজেকে সরাসরি মানবাধিকার কর্মীর পরিচয় না দিয়ে সাংবাদিক বা অন্যকোন পরিচয়ে তকমা জুড়ান।

মানব অধিকারের নামে চলছে সাধারণ মানুষকে তুমুল হয়রানি। অধিকার আদায়ের নামে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পুঁজি করে একশ্রেণীর কথিত মানবাধিকার কর্মীরা দিনরাত ২৪ ঘন্টা অবৈধভাবে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।

নারী-নির্যাতন, জমি জবরদখল, আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার, শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন অফিস আদালতে মানবাধিকার নামধারী এ ধান্ধাবাজরা নিরবে নির্ভৃতে মানবাধিকারকেই পঙ্গুদশায় নিপাতিত করছে।

পাড়া-মহল্লা, অলিগলিতে মানবাধিকার সংগঠনের ছড়াছড়ি। সাইনবোর্ড ও প্যাডসর্বস্ব ভুঁইফোড় এসব সংগঠনের কর্মকাণ্ডে ক্ষুণ্ন হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ভাবমূর্তি।

নোয়াখালীর একজন আইনজীবি জামাল উদ্দিন ভ‚ঁঞা বলেন, নামসর্বস্ব কথিত মানবাধিকার সংগঠনগুলো লব্ধ প্রতিষ্ঠিত মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে এমনভাবে নিজেদের নাম রাখছে, যাতে বিভ্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

আরেকজন সচেতন নাগরিক বলেন, এসব সংগঠনের মানবাধিকার ‘বাণিজ্য’ এখন বেশ জমজমাট। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বাহারি নামের কথিত মানবাধিকার সংগঠনগুলো দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপপ্রচার চালানোর মাধ্যমে বিদেশি অর্থ আদায় থেকে শুরু করে থানা ও আদালতে তদবিরের মাধ্যমে অপরাধী ছাড়ানোর মতো কাজেও লিপ্ত। এমনকি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে নির্যাতিতদের আইনি সহায়তা দেয়ার নামেও সাধারণ ভুক্তভোগী মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোথা কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে দ্রুত বাদী-বিবাদীর কাছে পৌঁছে যান কথিত এসব সংগঠনের তদন্ত কর্মকর্তারা। তারপর সালিশ-বৈঠক ও সমঝোতা করে দেয়ার নাম করে হাতিয়ে নেয়া হয় টাকা।

জেলা, উপজেলা ও পৌরসভা এলাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে মানবাধিকার সংগঠনের শাখা অফিস তৈরি করে এবং মানবাধিকারকর্মীর পরিচয়পত্র বিক্রির মাধ্যমেও টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে।

কথিত এসব মানবাধিকার সংগঠনের পরিচালনা পর্ষদে সর্বজনগ্রহণযোগ্য বিচারপতি, উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের নাম রেখেও প্রতারণা করা হচ্ছে।

দেশের বিশিষ্ট মানবাধিকার সংগঠক ও বিচারপতিদের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ধনাঢ্য ব্যক্তি ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকেও মাসোয়ারা নেয়ার অভিযোগ ওঠেছে।

এসব সংগঠন সুযোগ পেলেই কোন ইস্যুতে বিদেশি বিভিন্ন দাতা সংস্থা, ব্যক্তিবর্গ ও কোন প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সঙ্গে গোপন আঁতাতের মাধ্যমে নানা সুযোগ-সুবিধা লুটে নিচ্ছে।

এ বিষয়ে একজন সরকারী কর্মকর্তা বলেন, কথিত মানবাধিকার কর্মীদের প্রতারনার খবর সরকারেরও জানা রয়েছে। যে কারণে সরকারের জাতীয় মানবাধিকার সংস্থা এখন জনগণের যে কোন সেবা দিতে পাশে রয়েছে।

শিগগিরই এসব সংগঠনের নিবন্ধন বাতিলসহ আইনি পদক্ষেপ নেয়া জরুরী বলে মনে করেছেন সচেতন মহল।

এবিষয়ে ক্ষুব্ধ শাহাদাত হোসেন বলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত মানবাধিকার সংগঠনের নামের সঙ্গে মিল রেখে প্রতারণার জাল ছড়ানো হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ও রাস্তার পাশে টানিয়ে দেয়া হয়েছে নানা চটকদার সাইনবোর্ড।

সাইনবোর্ডে ‘বিয়ে, তালাক, যৌতুক, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, পারিবারিক বিরোধ, জমি নিয়ে ঝামেলা, দেনমোহরসহ গরিব-অসহায়দের বিনামূল্যে আইনি সহায়তা’ দেয়ার আশ্বাস দিয়ে সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলা হয়।

পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও আইনি সহায়তার নামে প্রতারণা করা হয়। অনেকে নামের মারপ্যাঁচের ঘোরে পড়ে এসব প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হয়ে মানবাধিকারের সুরক্ষা পাওয়া দূরে থাক,উল্টো হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

জয়াগের সমাজসেবক মাসুদ আলম বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নাম ব্যবহার করে কিছু অসাধু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার ব্যক্তিদের আর্থিক ও মানসিকভাবে হয়রানি এবং প্রতারিত করছে। তারা জেলা উপজেলায় আইডি কার্ড বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।

রাজনৈতিক কর্মী জমির হোসেন বলেন, নিবন্ধনকারী কর্তৃপক্ষ ও আদালত এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে মানবাধিকার নিয়ে যাচ্ছেতাই হবে। এদের কারণে প্রায়ই বিব্রত হতে হচ্ছে আমাদের।

তিনি আরও জানান, এসব প্রতিষ্ঠানের লাগাম টেনে ধরার জন্য তিনি আহ্বান জানান। কথিত এই মানবাধিকার কর্মীরা সমাজের বিভিন্নমহলে সালিশ-বৈঠকের নামে উভয় পক্ষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়।

মানবাধিকার কর্মী সাজ্জাদ কবির বলেন, ঢাকায় অনেক প্রতারক রয়েছে, যারা নিজেদের চেয়ারম্যান দাবি করে সারাদেশে কার্ড বানিজ্য করে। বাস্তবে এরা নিজেরাই কঠিন প্রতারক। তিনি বলেন, ঢাকায় এক প্রতারক মানবাধিকার সংগঠন ও পাশাপাশি পত্রিকার মালিকানা হাসিল করে হরদমছে মানুষের সাথে প্রতারনা করে আসছিলে। একপর্যায়ে, পুলিশের হাতে ধরা খেয়ে হালে সে লাপাত্তা।

মানবাধিকার সংগঠনের নামে প্রেস লেখা আইডি কার্ড বিক্রি করাই এ সংগঠনের মূল কাজ। সারাদেশে তাদের প্রায় ১৫ হাজার সদস্যকে সাংবাদিক লেখা পরিচয়পত্র দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

অভিযোগ রয়েছে, এই সংগঠনগুলোর প্রধান কাজই হচ্ছে সদস্য সংগ্রহের নামে কার্ড বিক্রি করা, খুন-ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের মীমাংসা করে দিতে সালিশ-বৈঠকের নামে সুবিধা আদায় করা।

এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠিত একটি মানবাধিকার সংগঠনের এক সংগঠক ড. বশির আহমেদ বলেন, নামে-বেনামে প্রতিনিয়ত ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠছে নামসর্বস্ব মানবাধিকার সংগঠন।

বীমা সংগঠক ঈমাম হোসেন স্বপন বলেন, এ সংগঠনগুলো সরকারের কোনো বিভাগের নিয়ন্ত্রণে নেই। জবাবদিহিরও বাইরে এদের কার্যক্রম। থানাগুলোতেও এদের নিয়মিত যাতায়াত। সেখানে তারা সাধারণ মানুষকে নানা বিপদ থেকে উদ্ধার করার নামে নগদ টাকা হাতিয়ে নেয়।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!