মানসিক রোগের কারণ ও চিকিৎসা

  • আপডেট সময় সোমবার, জুলাই ১৮, ২০২২
  • 311 পাঠক

ডা.এম এ হক
পি.এইচ.ডি
————

সাধারণত দেহের রোগকেই রোগ বলে গণ্য করা হয় এবং তারই চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের কাছে উপস্থিত হতে হয়। মানসিক সুস্থতা বা অসুস্থতা বড় একটা লক্ষ্য করা হয় না। যখন মনের এরূপ অবস্থা হয় যে, কোনো ব্যক্তির দ্বারা আর সাংসারিক কাজ-কর্ম চলে না অর্থাৎ যাকে লোকে ‘পাগল’ বলে, তখনই কেবল তাকে সুস্থ করার জন্য চিকিৎসকের কাছে আনা হয়।

যদি সাংসারিক কাজের কোনো অসুবিধা না হয়, অর্থাৎ হিসাবনিকাশ বা লোকজনের সঙ্গে ব্যবহারের বিষয়ে কোনো বিশৃঙ্খলা না ঘটে, তবে মানসিক যে অবস্থাই হোক না কেন, তা কেউই নজর রাখে না এবং চিকিৎসার প্রয়োজন বলে মনে করে না। একটু যত্নসহকারে লোক-চরিত্র পর্যবেক্ষণ করলেই বেশ বুঝতে পারা যায় যে, শত শত ব্যক্তির মধ্যে একজনও বোধ হয় মানসিকভাবে সুস্থ নেই।

অথচ মানসিক রোগ চিকিৎসার জন্য কারো মধ্যে বড় কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। অবস্থা দেখে মনে হয় যেন সম্পূর্ণ সমাজের একই অবস্থা। তাহলে কে কার অসুস্থতা বুঝতে পারবে?

মানসিক রোগ
———–

মানসিক রোগ মানে মনের ব্যাধি। যেমন: হ্যালোসিনেশন বা ভ্রান্ত বস্তু দেখা অথবা কথা শুনা, বিষণ্ন্নতা বা ডিপ্রেশন, ওসিডি বা শুচিবাই, সিজোফ্রেনিয়া, ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ, বাইপোলার ডিজঅর্ডার, পোস্ট-ট্রমা স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, অনিদ্রা, পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার, ক্লিপ্টোম্যানিয়া, অটোফ্যাজিয়া ইত্যাদি। মানসিক রোগের ক্ষেত্রে সকল প্রকার অসুস্থতা সর্বপ্রথম মানুষের মনে দেখা দেয়।

ধীরে ধীরে শরীর যন্ত্রের মধ্যে নানারকম বিশৃঙ্খলা প্রকাশ পায়। এই অসুস্থতা ও বিশৃঙ্খলা হতে দ্রুত, বিনাকষ্টে, স্বল্পতম সময়ে, সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য ও নির্দোষ উপায়ে সহজবোধ্য নীতির সাহায্যে সামগ্রিকভাবে রোগের লক্ষণ দূরীকরণ ও বিনাশ সাধন এবং স্থায়ীভাবে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন।

রুগ্ন্ন মানব জাতির স্বাস্থ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিার মতো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্র্ণ দায়িত্ব সুষ্ঠুরূপে পালন করতে হলে একদিকে যেমন শরীর বিজ্ঞানী, অপরদিকে তেমনি জীবন শিল্পীর প্রয়োজন। জীবদেহ জৈব ও অজৈব পদার্থের রাসায়নিক সংযোগ। এদের কোনোটির ক্রিয়ার অভাব হলেই শরীর ব্যাধিযুক্ত হয়। জীবদেহের এই স্বভাব প্রকৃত অবস্থায় আছে কিনা তা নির্ধারণ করা এবং না থাকলে তাকে স্বভাবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং চিকিৎসা-শাস্ত্র অনুযায়ী ব্যাধি নিরাময় করাই আমাদের প্রত্যাশা।

মানসিক রোগের কারণসমূহ
———————

বিভিন্ন কারণে মানসিক রোগ হয়ে থাকে যেমন ১. জেনেটিক (পিতা-মাতা বা পূর্ব পূরুষদের মস্তিষ্ক বিকৃতি থাকলে অনেক সময় সন্তানদেরও মানসিক রোগ প্রকাশ পায়) ২. শরীরে কোনো কঠিন ব্যাধি ৩. অতিরিক্ত নেশা ৪. মস্তিষ্কে আঘাত লাগালে ৫. হঠাৎ ভয় পেলে ৬. মানসিক উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, অত্যধিক আনন্দ, দুঃখ, নিরাশ। ৭.পরিবেশগতভাবে ৮. নিদ্রাহীনতা ইত্যাদি।

মানসিক রোগীর আচরণ
——————-

(মন অর্থে জ্ঞানশক্তি, বোধশক্তি ও ইচ্ছাশক্তি, এই তিনটি শক্তির সমষ্টি) যদি মানুষের মনে রোগ হয়, তাহলে তার ফলে জ্ঞান, বোধ ও ইচ্ছা এই তিনটিই অসুস্থ হয়। যার যেমন মন, তার তেমনই চিন্তা এবং তেমনই কর্ম। আগে মনে ইচ্ছা ও কল্পনার সৃষ্টি হয়, পরে সেই ইচ্ছা ও কল্পনা অনুসারে কাজ হয়। অসুস্থ মনে, অসুস্থ ইচ্ছা ও অসুস্থ কল্পনাই বেশি দেখা যায়। আর অসুস্থ মনে, অসুস্থ ইচ্ছা ও অসুস্থ কল্পনা হতে যে কাজ হয় তা অসুস্থ হতে বাধ্য করে। অসুস্থ মনে সামান্য ঘটনাও বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে থাকে, কিন্তু সুস্থ মনে তা হয় না।

আমরা প্রায়ই দেখি যে, সবার মন সমান ক্রোধী নয়। কেউ হয়তো সামান্য কারণেই ভয়ানক অগ্নিশর্মা হয়ে উঠে, অনেকের সহিষ্ণুতা অতীব প্রশংসনীয়। এই প্রকারের তারতম্য, কেবলমাত্র মানসিক সুস্থতা ও অসুস্থতার ওপর নির্ভর করে। মানসিক রোগগ্রস্ত ব্যক্তি কোনটি সঠিক এবং কোনটি সঠিক নয় এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য উপলব্ধি করতে পারে না। সে অধিকাংশ সময়ই মন্দটিকেই সঠিক মনে করে।

কোনো ব্যক্তি যখন সাপের কামড়ের ফলে সাপের বিষ দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন তার নিকট কাঁচা মরিচ মিষ্টি মনে হয়। কিন্তু একজন সুস্থ ব্যক্তি কাঁচা মরিচ খেলে তার আসল বৈশিষ্ট্য ঝালযুক্তই পাবে। কোনো ব্যক্তি যখন জ্বরে আক্রান্ত হয় তখন তার অনেক প্রিয় খাবারও মুখে অরুচি বোধ হয়। কারণ সে অসুস্থ এবং তার মুখটি জ্বরাগ্রস্ত।

চোখের রোগ হলে মানুষ যেমন সঠিকভাবে দেখতে পায় না, তেমনি মানসিক রোগগ্রস্ত ব্যক্তিও মানসিক রোগের কারণে সঠিকভাবে বুঝতে বা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় না।

মানসিক রোগগ্রস্ত ব্যক্তিরা সব সময় ভুল চিন্তা করতে থাকে। তারা ভালো-মন্দ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। ক্রমান্বয়ে ভুল কাজ করতে করতে তাদের মানসিক অবস্থা এমন হয়ে যায় যে তারা বিবেক বুদ্ধি-শূন্য হয়ে পড়ে। ভুল কাজ করেও তাদের বিন্দুমাত্র অনুশোচনাবোধ জাগ্রত হয় না।

তারা মনে করে, তাদের কাজটিই ঠিক হয়েছে, বরং অন্যদেরটি ভুল। মানসিক রোগগ্রস্ত ব্যক্তিরা শুধুমাত্র নিজেদের জন্যই বিপজ্জনক নয় এরা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক। অতএব উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে, মানসিক ব্যাধি কত মারাত্মক। আমাদেরকে অবশ্যই ক্ষতিকর মানসিক রোগ থেকে পরিত্রাণের সঠিক পথ বের করতে হবে।

মানসিক রোগের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা
——————————

আমাদের সমাজে হ্যালোসিনেশন, ডিপ্রেশন, শুচিবাই, অনিদ্রা, সিজোফ্রেনিয়া, ডিমেনশিয়, প্রেমে প্রত্যাখ্যাত উন্মাদ আজ লাখ লাখ। এদের চিকিৎসার জন্য হোমিওপ্যাথির ভাণ্ডারে অমৃতসম যে সব ওষুধ নিপুণভাবে সাজানো আছে- সেসব ওষুধের প্রকৃত পরিচয় ও তার প্রয়োগ প্রণালি জানা থাকলে জগতে পাগলাগারদের সংখ্যা যে কমে যেত তাতে সন্দেহ নেই।

বাস্তব অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি, এসব মানসিক রোগী হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার মাধ্যমে কত সহজেই স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়েছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, মানসিক রোগীদের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে স্বল্পসময়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তাই আজ সচেতন নাগরিকরা তাদের মানসিক রোগীর রোগ নিরাময়ে সফলতার কারণে হোমিও চিকিৎসার দিকে ঝুঁকছেন।

লেখক: পিএইচ. ডি (স্বাস্থ্য), এম. ফিল. (স্বাস্থ্য), ডি এইচএমএস. পুরাতন ও জটিল রোগের অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। চেম্বার-হক হোমিও ক্লিনিক, মোহাম্মদপুর, ঢাকা। প্রয়োজনে-০১৭১২-৪৫০৩১০।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!