ডেস্ক রিপোর্ট
—————
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করা মেধাবী শিক্ষার্থী সিনথিয়া হাসান। বাবা-মা দুজনেই সরকারি চাকরি করেন। লেখাপড়া শেষ করার কিছুদিনের মাথায় পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় আরেক সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে। স্বামীর সঙ্গেই থাকতেন গুলশানের একটি বাসায়। বিয়ের পর কয়েক মাস ভালোই চলছিল তাদের সংসার। তারপর থেকেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নানা বিষয়ে মনমালিন্য শুরু হয়। স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে প্রায়ই সিনথিয়া বাবার বাসায় চলে আসতেন। পারিবারিকভাবে তাদের ঝগড়াঝাটির অবসান ঘটিয়ে ফের তারা সংসার শুরু করেন। কিন্তু তবুও তাদের সংসার ঠিকেনি। এক সময় সিনথিয়া নিজেই স্বামীকে তালাক দেন।
তাদের দু’জনের সংসার ভাঙার কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিল তুচ্ছ কারণে ভুল বোঝাবুঝি, অহেতুক সন্দেহ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে বাধা। শুধু সিনথিয়া নয় এ রকম হাজার হাজার নারী এখন নিজে থেকেই স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের আবেদন করছেন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের এক হিসাবে দেখা গেছে নারীরা তালাকের রেকর্ড করেছেন। সেই তুলনায় পুরুষরা বিচ্ছেদের বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন কম।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) হিসাবে দেখা গেছে, ২০১১ সাল থেকে ২০২২ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় ১২ বছরে করপোরেশনের বিভিন্ন অঞ্চলে মোট ৫৮ হাজার ৩০টি তালাকের আবেদন পড়েছে। এর মধ্যে ৩৭ হাজার ৭৯২টি আবেদন করেছেন নারীরা। আর পুরুষরা করেছেন ১৮ হাজার ৬৬৪টি। একইভাবে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) গত ৩ বছরে তালাকের আবেদন পড়েছে ২১ হাজার ২৮৮টি। এরমধ্যে ১৪ হাজার ৯৯৪টি করেছেন নারীরা আর ৬ হাজার ২৯৪টি আবেদন করেছেন পুরুষরা।
ডিএনসিসি’র হিসাবে দেখা গেছে, ২০১১ সালে ২ হাজার ৮৬৪টি তালাকের আবেদনের মধ্যে ১ হাজার ৯১টি আবেদন পুরুষ ও ১ হাজার ৭৭৩টি নারীরা করেছেন। একইভাবে ২০১২ সালে ২ হাজার ৮৮৪টি আবেদনের মধ্যে ১ হাজার ২৩টি পুরুষ ও ১ হাজার ৮৬১টি নারী। ২০১৩ সালে ৩ হাজার ২৩৮টির মধ্যে ১ হাজার ৭২টি পুরুষ ও ২ হাজার ১৬৬টি নারী। ২০১৪ সালে ৪ হাজার ৪৪৫টির মধ্যে ১৪৭৯টি পুরুষ ও ২৯৬৬টি নারী। ২০১৫ সালে ৪ হাজার ৭৭টি’র মধ্য ১ হাজার ৩০৩টি পুরুষ ও ২ হাজার ৭৭৪টি নারী। ২০১৬ সালে ৪ হাজার ৮৪৭টির মধ্যে ১ হাজার ৪২১টি পুরুষ ও ৩ হাজার ৪২৬টি নারী। ২০১৭ সালে ৫ হাজার ৪৬টির মধ্যে ১ হাজার ৫৫৬টি পুরুষ ও ৩ হাজার ৪৯০টি নারী।
২০১৮ সালে ৫ হাজার ৭৭৫টির মধ্যে ১ হাজার ৭২৪টি পুরুষ ও ৪০৫১টি নারী। ২০১৯ সালে ৬ হাজার ১৪৪টির মধ্যে ২৩২০টি পুরুষ ও ৩৮২৪টি নারী। ২০২০ সালে ৬ হাজার ১৬৮টির মধ্যে ২ হাজার ১১৫টি পুরুষ ও ৪ হাজার ৫৩টি নারী। ২০২১ সালে ৭ হাজার ৪১৬টির মধ্যে ১ হাজার ৭৬২টি পুরুষ ও ৪ হাজার ৮১টি নারী। ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৫ হাজার ১২৬টির মধ্যে ১ হাজার ৭৯৮টি পুরুষ ও ৩ হাজার ৩২৭টি আবেদন নারীরা করেছেন।
একইভাবে ডিএসসিসি’র এক হিসাবে দেখা গেছে, ৩ বছরে করপোরেশনের বিভিন্ন অঞ্চলে তালাকের আবেদন জমা পড়েছে ২১ হাজার ২৮৮টি। এরমধ্যে ১৪ হাজার ৯৯৪টি আবেদন করেছেন নারীরা আর পুরুষরা করেছেন ৬ হাজার ২৯৪টি। এরমধ্যে ২০২০ সালের ৬ হাজার ৩৪৫টি আবেদনের মধ্যে ৪ হাজার ৪২৮টি নারী ও ১ হাজার ৯১৭টি পুরুষ। ২০২১ সালে ৭ হাজার ২৪৫টির মধ্যে ৫ হাজার ১৮৩টি নারী ও ২ হাজার ৬২টি পুরুষ এবং ২০২২ সালে ৭ হাজার ৬৯৮টির মধ্যে ৫ হাজার ৩৮৩টি নারী ও ২ হাজার ৩১৫টি আবেদন করেছেন পুরুষরা।
দুই সিটিতে নারীদের করা আবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘুরে ফিরে একই সমস্যার কথা উল্লেখ করে নারীরা আবেদন করেছেন। এরমধ্যে স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়া, ভরণ-পোষণ না দেয়া, স্বামীর সন্দেহবাতিক মনোভাব, ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিবাহ বন্ধনে আবব্ধকরণ, কাবিন না হওয়া, স্বামীর মাদকাসক্তি, পুরুষত্বহীনতা, নির্যাতন, যৌতুক, মানসিক পীড়ন, পরকীয়া, আর্থিক সমস্যা ও ব্যক্তিত্বের সংঘাতের কথা বলা হয়েছে। আর পুরুষরা পরকীয়া, বেপরোয়া জীবনযাপন, বদমেজাজ, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, সন্তান না হওয়া, অবাধ্য হওয়া, টিকটকসহ সামাজিক মাধ্যমে অবাধ বিচরণ করা, ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী না চলাসহ বিভিন্ন কারণের কথা উল্লেখ করছেন।
সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, তুচ্ছ কারণেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তালাক হচ্ছে এবং সেটি সমানতালে ধনী-গরিব সব শ্রেণিতে হচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে নারীরা তালাকে এগিয়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে নারীরা এখন অনেক স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারা নিজেদের অধিকার আদায় করে নিতে শিখেছে। নারীরাও উপার্জনক্ষম। আগে ছেলেদের উপর নির্ভরশীল থাকতে হতো। তারা আগের মতো এখন সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে না। কারণ শিক্ষা এবং অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা। স্বামী শাররিক মানসিক নির্যাতন করলে, মাদসক্ত হলে বা ভুল বুঝাবুঝি, মনোমালিন্য হলে প্রথমে প্রতিবাদ করে। পরে সমস্যার সমাধান না হলে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়।
সম্প্রতি সিটি করপোরেশনে তালাকের আবেদন করা নারীর সঙ্গে কথা হয় । তিনি ঢাকার বড় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। সামিয়া নামের এই নারী বলেন, সংসারের প্রয়োজনে আমার স্বামী যেমন পরিশ্রম করতেন ঠিক ততটুকু আমিও করতাম। কিন্তু সংসারের কোনো সিদ্ধান্তই আমি নিতে পারতাম না। অথচ আমরা দুজনেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা করেছি।
এ ছাড়া তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া লাগতো। পাশাপাশি আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমাদের মধ্যে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি ঢুকে পড়েছে। আমি আমার স্বামীর কথাবার্তা চলাফেলায় সেগুলো লক্ষ্য করেছি। একই সময়ে দুজনের অফিস ছুটি হলেও সে বাসায় আসতে দেরি করতো। আমি অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু হয়নি। পরে বাধ্য হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
সমাজ বিজ্ঞানী অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, নারীরা এখন তাদের অধিকারের বিষয়ে অনেক বেশি সচেতন। এ ছাড়া নারীদের কাজ করার পরিধি অনেকটা বেড়েছে। তারা এখন অনেক বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণ। এজন্য তারা নির্যাতনের শিকার হয় এমন কারও সঙ্গে থাকতে চায় না।
এ ছাড়া এখন কোনো মেয়ের বাবাও চায় না যে তার মেয়ে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এমন কারও সঙ্গে থাকুক। আরেকটি বিষয়, আগে যখন আমরা একান্নবর্তী পরিবারে বসবাস করতাম, সেখানে বোঝানোর মতো অভিভাবক ছিল। সমস্যা হলে কাউন্সেলিং করা হতো। সেই জায়গাটি এখন আর নেই। পরিবারের প্রতিটি মানুষ এখন পৃথক ও স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে। ফলে তাদের সিদ্ধান্তগুলোয় এখন পরিবারের কারও সহযোগিতা নেয় না। বরং তালাকের সময়ে তারা বন্ধুদের শরণাপন্ন হয় এবং তারা সংসার থেকে বেরিয়ে আসতে উপদেশ দেয়। এভাবে তারা সঠিক পরামর্শ পাচ্ছে না। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের সকলের কাউন্সিলের সংখ্যা বাড়ানো উচিত। পিতা-মাতাকে বন্ধুসুলভ আচরণ করে সন্তানদের সচেতন করা উচিত।
Leave a Reply