অনুমোদনহীন পরিবহন চলাচলে এশিয়ায় শীর্ষে খুলনা ও ঢাকা

  • আপডেট সময় সোমবার, মে ১৫, ২০২৩
  • 145 পাঠক

দিশারী ডেস্ক

————

জাতিসংঘের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের (এসকাপ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেই এমন যানবাহন (ইনফরমাল ট্রান্সপোর্ট) চলাচলে এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশের দুই শহর খুলনা ও ঢাকা। এর মধ্যে খুলনা শহরে যত যানবাহন চলে তার ৫৮ শতাংশেরই কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেই। আর রাজধানীতে অননুমোদিত পরিবহনের পরিমাণ ৫৪ শতাংশ।

—————————–

ইউএন-এসকাপের প্রতিবেদন

—————————-

গত সপ্তাহে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘সাব-রিজিওনাল মিটিং অ্যান্ড ক্যাপাসিটি বিল্ডিং ওয়ার্কশপ অন এক্সিলারেটিং দ্য ট্রানজিশন টু ইলেকট্রিক মোবিলিটি ইন এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’ শীর্ষক এক কর্মশালায় ওই প্রতিবেদনের এসব তথ্য উপস্থাপন করেন ইউএন-এসকাপের পরিবহন বিভাগের কর্মকর্তা মদন বি রেগমি। তিনি জানান, এশিয়া মহাদেশের বড় শহরগুলোর মধ্যে ‘ইনফরমাল ট্রান্সপোর্ট’ চলাচলে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশের খুলনা। শহরটিতে ইনফরমাল ট্রান্সপোর্টের ‘মোড শেয়ার’ ৫৮ শতাংশ।

দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ঢাকার ‘মোড শেয়ার’ ৫৪ শতাংশ। ইনফরমাল ট্রান্সপোর্ট চলাচলে এরপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা (৫০ শতাংশ), ফিলিপাইনের ম্যানিলা (৩৮ শতাংশ), ভারতের সুরাট (৩০ শতাংশ), ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং (১৭ শতাংশ), কম্বোডিয়ার নম পেন (১২ দশমিক ৪ শতাংশ), ইন্দোনেশিয়ার সুরাবায়া (১১ শতাংশ) ও ভারতের জয়পুর (১১ শতাংশ)।

দেশের সড়ক ও মহাসড়কে ২০ ধরনের যানবাহন চলাচলের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। যদিও কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের বাইরে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহর ও গ্রামাঞ্চলে আরো বেশ কয়েক ধরনের যানবাহন চলাচল করে।

যাত্রী পরিবহনের জন্য রিকশা, স্কুলভ্যান, ইজিবাইক, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের থ্রি-হুইলার কিংবা ঘোড়ার গাড়ির মতো অননুমোদিত যানবাহনের ব্যবহার সড়কে রয়েছে। এর পাশাপাশি চলাচলের অনুমতি থাকলেও মেয়াদোত্তীর্ণ এবং ফিটনেসবিহীন বাস-মিনিবাস, মাইক্রোবাস, সিএনজি অটোরিকশা ও প্রাইভেটকারের মতো যানবাহনও সড়কে চলছে।

‘ইনফরমাল ট্রান্সপোর্ট’ সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘কোনো দেশের রাস্তায় কী ধরনের যানবাহন চলাচল করবে, সেসব যানবাহনের মডেল কী হবে—এ ধরনের বিষয়গুলো ওই দেশের সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দেয়। এটাকে আমরা “টাইপ মডেল” অনুমোদন বলি। এ টাইপ মডেলের অনুমোদন নিয়েই যানবাহন আমদানি বা উৎপাদন করে সেগুলো রাস্তায় চালানো হয়।

কিন্তু অনেক অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলে। এ ধরনের যানবাহনকে আমরা বলি ‘ইনফরমাল ট্রান্সপোর্ট’। যেহেতু কর্তৃপক্ষের অনুমোদন থাকে না, সেহেতু এসব যানবাহনের কাঠামোগত দুর্বলতা, নিরাপত্তার ঘাটতির মতো বিষয়গুলো থেকেই যায়।’

বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ বর্তমানে ২০ ধরনের যানবাহনকে রাস্তায় চলাচলের অনুমোদন দেয়। এর মধ্যে রয়েছে অ্যাম্বুলেন্স, অটোরিকশা, অটো টেম্পো, বাস, কার্গো ভ্যান, কাভার্ড ভ্যান, ডেলিভারি ভ্যান, হিউম্যান হলার, জিপ, মাইক্রোবাস, মিনিবাস, মোটরসাইকেল, পিকআপ, প্রাইভেট কার, স্পেশাল পারপাজ ভেহিকল, ট্যাংকার, ট্যাক্সিক্যাব, ট্রাক্টর, ট্রাক ও অন্যান্য।

বিআরটিএর তথ্য বলছে, চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এ ২০ ক্যাটাগরিতে দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৫৭ লাখের বেশি। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী, এসব ক্যাটাগরির যানবাহন ছাড়া সড়ক-মহাসড়কে চলাচল করা সব ধরনের মোটরযানই অবৈধ।

অননুমোদিত পরিবহন চলাচলে এশিয়ার শীর্ষে থাকা খুলনা শহরজুড়ে রয়েছে ইজিবাইকের দাপট। এসব যানবাহনের বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে খুলনা সিটি করপোরেশন ১০ হাজার ইজিবাইক চলাচলের অনুমতি দিয়েছে। যদিও এ ধরনের অনুমতি দেয়ার ক্ষমতা সিটি করপোরেশনের নেই। স্থানীয়দের অভিযোগ, অনুমতি পাওয়া ১০ হাজারের বাইরে আরো প্রায় ৪০ হাজার ইজিবাইক বর্তমানে এ শহরে চলাচল করছে। মূলত ইজিবাইকের কারণেই খুলনা অননুমোদিত পরিবহন চলাচলে এশিয়ার শীর্ষ শহরে পরিণত হয়েছে বলে মনে করেন অধ্যাপক হাদিউজ্জামান।

অন্যদিকে প্যাডেলচালিত রিকশা, ব্যাটারি রিকশা, ইজিবাইক, বিভিন্ন ধরনের থ্রি-হুইলার যানবাহনের আধিক্যের কারণে ঢাকা দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বলে জানান তিনি।

‘এসব যানবাহন কিন্তু লুকিয়ে চলে না। কর্তৃপক্ষের সামনে দিয়েই চলে। আবার ইজিবাইকসহ বিভিন্ন ধরনের অননুমোদিত যানবাহন ও যানবাহনের যন্ত্রাংশ কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া উৎপাদন বা আমদানি করাও সম্ভব নয়। অন্যদিকে এসব যানবাহনকে কেন্দ্র করে একটা ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠছে। যখন এসব যানবাহন ঠেকানোর উদ্যোগ নেয়ার প্রয়োজন ছিল, তখন কর্তৃপক্ষ অলস বসে থেকেছে’, বলেন অধ্যাপক হাদিউজ্জামান।

তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক যে অননুমোদিত যানবাহনগুলোয় নিরাপত্তার ঘাটতি রয়েছে। কাঠামোগত ত্রুটিসহ নানা ধরনের অসংগতি আছে। কিন্তু এসব যানবাহন রাস্তা থেকে তুলে দেয়া উচিত হবে না। বরং অননুমোদিত যানবাহনগুলোর কাঠামোগত মানোন্নয়ন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে এগুলো অনুমোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি চালকদের প্রশিক্ষণ ও নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে। আরেকটা বিষয় মনে রাখতে হবে, এসব যানবাহন যেন কখনই শহরের মূল সড়ক ও মহাসড়কের গণপরিবহন না হয়। শুধু শহরের ফিডার রোড ও সরু সড়কগুলোতেই এসব যানবাহন চলাচলের অনুমতি দিতে হবে।’

বাংলাদেশের শহরগুলোতে অননুমোদিত পরিবহনের আধিক্যের বিষয়টির সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও। তবে তারা বলছেন, মানুষের দৈনন্দিন যাতায়াত এবং বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবিকার স্বার্থে চাইলেও এসব অননুমোদিত যানবাহন রাস্তা থেকে তুলে দেয়া সম্ভব নয়। তবে পর্যায়ক্রমে এসব যানবাহন তুলে দিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা করার কথা জানিয়েছেন তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের শহরগুলোকে বলা হয় রিকশার শহর। সংস্কৃতিগতভাবেই কিন্তু এটা চলে আসছে। দেশের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ শহরে বসবাস করে। এসব মানুষের দৈনন্দিন যাতায়াতের জন্য রিকশা, ইজিবাইকের মতো যানবাহন দরকার। কোনো ধরনের বিকল্প ব্যবস্থা না করেই যদি আমরা এসব যানবাহন বন্ধ করে দিই, তাহলে পাঁচ কোটি মানুষের জীবিকার কী হবে?’

‘এটা মানুষের বিহেভিয়ারেরও বিষয়। অনেক কিছু জোর করে পরিবর্তন করা যায় না। যখন বিকল্প আসবে, মানুষ সেটাকে বেছে নেবে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ঢাকার মতো জনবহুল একটা শহরে কিন্তু চাইলেই আমরা রিকশা তুলে দিতে পারি না। তবে আমরা বসে নেই। বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। এক সময় ঢাকা শহরে ঘোড়ার গাড়ি ছিল। এখন কিন্তু তা ওঠে গেছে। আমরা ঢাকার বেশ কয়েকটি শহরে রিকশা চলাচল বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছি। জাতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করে দেশ থেকে সব ধরনের অননুমোদিত যানবাহন তুলে দেয়া হবে।’

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!