অলসতা মানুষকে অশুভ পরিণতির দিকে নিয়ে যায়

  • আপডেট সময় শুক্রবার, আগস্ট ১১, ২০২৩
  • 152 পাঠক

মুফতি ইবরাহিম সুলতান । ১১ আগস্ট, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ।

অলসতা এমন এক ধ্বংসাত্মক ব্যাধি, যা মানুষকে ধীরে ধীরে অশুভ পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। মানুষের ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনকে মূল্যহীন করে দেয়। প্রাণবন্ত জীবনের সজীবতা ও কর্মময় জীবনের গতিময়তাকে উদাসীনতায় পর্যবসিত করে দেয়। এ জন্যই একজন প্রকৃত মুমিন অলসতাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে।

আল্লাহর কাছে এর কবল থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয় চায়। তা ছাড়া অলসতা সমস্ত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ। ইমাম রাগেব (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তি অলসতা করেছে সে ধ্বংস হয়েছে। অলস ব্যক্তি মানুষ তো নয়; বরং জীবজন্তুর কাতারেও পড়ে না।

সে হলো মৃতদের মতো। যে ব্যক্তি অলসতাকে নিজের অভ্যাসে পরিণত করে এবং অত্যধিক আরাম-আয়েশের দিকে ঝুঁকে পড়ে, সে নিজের শান্তি হারিয়ে ফেলে। বলা হয়ে থাকে, যদি তুমি চাও কখনো ক্লান্ত হবে না, তাহলে (পরিশ্রম করে) ক্লান্ত হও। যাতে সামনে তোমাকে ক্লান্তি ছুঁতে না পারে।

অন্যত্র বর্ণিত আছে, অলসতা ও ক্রোধ থেকে নিজেকে রক্ষা করো। কারণ তুমি অলস হলে কোনো হক বা দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে পারবে না। আর ক্রোধান্বিত হলে হকের ওপর অটল থাকতে পারবে না। সুতরাং যে ব্যক্তি নিজের মর্যাদাকে উন্নত করতে চায় তার জন্য করণীয় হলো অলসতা পরিহার করে নিজ লক্ষ্যে পৌঁছতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।

অলসতার ব্যাপারে পবিত্র কোরআনেও নিন্দা এসেছে। আল্লাহ তাআলা অলসদের তীব্র নিন্দা করেছেন এবং অলসতাকে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ, নিজেদের অস্ত্র তুলে নাও এবং পৃথক পৃথক সৈন্যদলে কিংবা সমবেতভাবে বেরিয়ে পড়ো। আর তোমাদের মধ্যে এমনও কেউ কেউ রয়েছে, যারা অবশ্য বিলম্ব করবে এবং তোমাদের ওপর কোনো বিপদ উপস্থিত হলে বলবে, আল্লাহ আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন যে আমি তাদের সঙ্গে যাইনি।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৭১-৭২)

এই আয়াতে স্পষ্টভাবে মুনাফিকদের অলসতাকে তুলে ধরা হয়েছে। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, আপনি বলুন, তোমরা ইচ্ছায় অর্থ ব্যয় করো বা অনিচ্ছায়, তোমাদের থেকে তা কখনো কবুল হবে না, তোমরা নাফরমানের দল। তাদের অর্থ ব্যয় কবুল না হওয়ার এ ছাড়া আর কোনো কারণ নেই যে তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি অবিশ্বাসী, তারা নামাজে আসে অলসতার সঙ্গে, ব্যয় করে সংকুচিত মনে। (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৫৩-৫৪)

উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুনাফিকদের নিন্দা করেছেন। কারণ তারা গাফলত ও উদাসীনতার সঙ্গে নামাজে দাঁড়ায়। পক্ষান্তরে মুমিনের অবস্থা তার বিপরীত। মুমিন নামাজে দাঁড়ায় হিম্মত, উদ্যম ও আগ্রহ নিয়ে। ফলে তারা শেষরাতের ঘুমের আরাম ত্যাগ করে রাতের নামাজে দাঁড়িয়ে যায়।

আল্লাহ তাদের প্রশংসা করে বলেন, ‘তাদের পার্শ্ব শয্যা থেকে আলাদা থাকে। তারা তাদের পালনকর্তাকে ডাকে ভয়ে ও আশায় এবং আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে।’ (সুরা : সিজদাহ, আয়াত : ১৬)

মূলত শয়তান চায় সর্বদা মুমিন বান্দার ইবাদতে আলস্য সৃষ্টি করতে। কারণ শয়তান মুমিনের ভালো কাজগুলো সহ্য করতে পারে না। তাইতো সে মানুষের দেহমনে অলসতা সৃষ্টি করে ভালো কাজ থেকে সরিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করে।

হাদিসের ভাষায়, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন শয়তান তার ঘাড়ের পশ্চাদংশে তিনটি গিঁট দেয়। প্রতি গিঁটে সে এ বলে চাপড়ায়, তোমার সামনে রয়েছে দীর্ঘ রাত, অতএব তুমি শুয়ে থাকো। অতঃপর সে যদি জাগ্রত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে একটি গিঁট খুলে যায়, পরে অজু করলে আরো একটি গিঁট খুলে যায়, অতঃপর সালাত আদায় করলে আরো একটি গিঁট খুলে যায়। তখন তার প্রভাত হয় উৎফুল্ল মনে ও অনাবিলচিত্তে। অন্যথায় সে সকালে ওঠে কলুষ কালিমা ও আলস্য সহকারে। (বুখারি, হাদিস : ১১৪২)

এ জন্য নবী করিম (সা.) অলসতা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। তা হলো-

‏اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ وَالْعَجْزِ وَالْكَسَلِ وَالْجُبْنِ وَالْبُخْلِ ‏ ‏وَضَلَعِ ‏ ‏الدَّيْنِ وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ

উচ্চারণ : ‘ আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল হামমি ওয়াল হুজনি, ওয়া আউজুবিকা মিনাল আজজি ওয়াল কাসালি, ওয়া আউজুবিকা মিনাল জুবনি ওয়াল বুখলি, ওয়া আউজুবিকা মিন গলাবাতিদ দাইনি ওয়া কহরির রিজাল।’

অর্থ : ‘ হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা থেকে আশ্রয় চাই। আমি আশ্রয় চাই অক্ষমতা ও অলসতা থেকে, আপনার কাছে আশ্রয় চাই ভীরুতা ও কার্পণ্য থেকে, আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই ঋণের বোঝা ও মানুষের রোষানল থেকে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ১৫৫৫)

এ প্রসঙ্গে আনাস (রা.) বলেন, একদা নবী (সা.)-এর কাছে এক আনসারি ব্যক্তি এসে ভিক্ষা চাইলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ঘরে কিছু আছে কি ? সে বলল, একটি কম্বল আছে, যার কিছু অংশ আমরা পরিধান করি এবং কিছু অংশ বিছাই। একটি পাত্রও আছে, তাতে আমরা পানি পান করি।

তিনি বলেন, সেগুলো আমার কাছে নিয়ে এসো, লোকটি তা নিয়ে এলে রাসুলুল্লাহ (সা.) তা হাতে নিয়ে বলেন, এ দুটি বস্তু কে কিনবে? এক ব্যক্তি বলল, আমি এগুলো এক দিরহামে নেব। তিনি দুইবার অথবা তিনবার বলেন, কেউ এর অধিক মূল্য দেবে কি? আরেকজন বলল, আমি দুই দিরহামে নিতে পারি।

তিনি ওই ব্যক্তিকে তা প্রদান করে দিরহাম দুটি নিলেন এবং ওই আনসারিকে তা প্রদান করে বললেন, এক দিরহামে খাবার কিনে পরিবার-পরিজনকে দাও এবং আরেক দিরহাম দিয়ে একটি কুঠার কিনে আমার কাছে নিয়ে এসো। লোকটি তা-ই করল। রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বহস্তে তাতে একটি হাতল লাগিয়ে দিয়ে বললেন, যাও, তুমি কাঠ কেটে এনে বিক্রি করো। পনেরো দিন যেন আমি আর তোমাকে না দেখি।

লোকটি চলে গিয়ে কাঠ কেটে বিক্রি করতে লাগল। অতঃপর সে এলো, তখন তার কাছে দশ দিরহাম ছিল। সে এর থেকে কিছু দিয়ে কাপড় এবং কিছু দিয়ে খাবার কিনল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ভিক্ষা করে বেড়ানোর চেয়ে এ কাজ তোমার জন্য অধিক উত্তম। কেননা ভিক্ষার কারণে কিয়ামতের দিন তোমার মুখমণ্ডলে একটি বিশ্রি কালো দাগ থাকত।

ভিক্ষা করা তিন ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারোর জন্য বৈধ নয়। (১) ধুলা-মলিন নিঃস্ব ভিক্ষুকের জন্য; (২) ঋণে জর্জরিত ব্যক্তি; (৩) যার ওপর রক্তপণ আছে, অথচ সে তা পরিশোধ করতে অক্ষম। (আবু দাউদ, হাদিস : ১৬৪১)

সারকথা, মানুষ যখন অত্যধিক পরিমাণে আরাম-আয়েশে মত্ত হয়ে নিজের দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে উদাসীন হয়ে যায়, তখন সে মানসিক অশান্তিতে ভোগে এবং অন্যদের চোখেও ছোট হয়ে যায়। অলসতার বিভিন্ন স্তর রয়েছে। যে ব্যক্তি অলসতার কোনো একটি পর্যায়ে পৌঁছে যাবে সেটি তাকে এর নিচের স্তরে পৌঁছে দেবে।

এভাবে সে প্রাণশক্তি থাকা সত্ত্বেও মৃত বলে গণ্য হবে। অলসতা মানুষকে এমন অবস্থায় পৌঁছে দেয় যে সে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও জোগাড় করতে পারে না। ফলে মানুষের কাছে হাত পেতে নিজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে।

ইসলামের শিক্ষা হলো, স্বাবলম্বী হয়ে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকা। কর্মময় জীবনের প্রতি উৎসাহ প্রদান করে নবী করিম (সা.) বলেন, তোমাদের মাঝে কোনো লোক সকালে গিয়ে কাঠ সংগ্রহ করে তা পিঠে করে বহন করে এনে তা থেকে প্রাপ্ত উপার্জন থেকে সে দান-খয়রাত করল এবং লোকদের কাছে হাত পাতা থেকে বিরত থাকল।

তার জন্য এটা অনেক উত্তম অন্যের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা থেকে। আর অন্য লোকের কাছে চাইলে সে তাকে দিতেও পারে আবার না-ও দিতে পারে। কেননা নিচের হাত থেকে ওপরের হাত (দান গ্রহণকারীর চেয়ে প্রদানকারী) উত্তম। নিজের প্রতিপাল্যদের কাছ থেকে (অর্থ ব্যয় ও দান-খয়রাত) শুরু করো। (তিরমিজি, হাদিস : ৬৮০)

আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, যাতে তিনি আমাদের অলসতা থেকে বাঁচার জন্য সুদৃঢ় হিম্মত দান করেন।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!