মুহাম্মদ আবু সালেহ। ২৩ অক্টোবর, ২০২৩।
মানব জীবনের শান্তি ও সফলতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছতে যেসব গুণ ও বৈশিষ্ট্য অত্যধিক প্রভাব বিস্তার করে থাকে তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ক্ষমা, মার্জনা ও সহনশীলতার গুণ।
অন্যের দোষ-ত্রুটি বা অনিয়মের কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে কিংবা কষ্ট পেলে উদার মনে প্রশস্ত হূদয়ে তাকে ক্ষমা করে দেয়া। শক্তি-সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও শাস্তি বা প্রতিশোধমূলক কোনো ব্যবস্থা না নেয়া এবং ওই ব্যক্তির আচরণকে মূর্খচিত মনে করে এড়িয়ে যাওয়ার নাম ক্ষমা ও সহনশীলতা।
কোরআনের ভাষায় আস-সাফহুল জামিল। অর্থাৎ দেখেও না দেখা, শুনেও না শোনা, জেনেও না জানা। তথ্যবিদগণ এর ব্যাখ্যা এভাবে করেন- কারও অন্যায় অপ্রীতিকর আচরণ এমনভাবে উপেক্ষা করা যে, কষ্ট বা বিরক্তিকর ও প্রকাশ না ঘটে। আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে এর স্বভাব অর্জনের জন্য অনেক শক্তির প্রয়োজন।
আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা ও সহনশীলতার প্রতি কোরআনুল কারিমে নানাভাবে তাঁর বান্দাদের উৎসাহিত ও উদ্দীপ্ত করেছেন। মহাগ্রন্থে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাপ্রাপ্ত জান্নাতি মানুষের গুণ ও আমল প্রসঙ্গে বলেন, ‘যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল উভয় আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, ক্রোধ হজম (নিয়ন্ত্রণ) করে, এবং মানুষের দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করে (তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও জান্নাত)। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা এমন নেক্কারদের পছন্দ করেন।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৩৪)।
আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, সাদকা করাতে সম্পদের ঘাটতি হয় না। যে ব্যক্তি ক্ষমা করে আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। আর কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিনীত হলে তিনি তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন।’ (মুসলিম: ৭/১১৪)।
জুলুম ও বাড়াবাড়ির উপযুক্ত প্রতিশোধের আইনি বৈধতা রয়েছে (বিশেষত যদি তা পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক শৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত হয়)। তবে সেক্ষেত্রে জুলুম-অত্যাচার সহ্য করে ক্ষমা করতে কোরআনুল কারিমে উৎসাহিত করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে সবুর করে ও ক্ষমা সুন্দর আচরণ করে এটা তার বড় হিম্মতের কাজ।’ (সুরা শুরা: ৪৩)।
অর্থাৎ সবর ও ক্ষমা এমন বিষয় যা অতি কাম্য। আর তার পুরস্কারও অনেক বড়। আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে উচ্চাভিলাসী মুমিনের জন্য তা অতি আবশ্যক। মুমিনের বৈশিষ্ট্য হওয়া চাই এমন যে, তারা আখিরাতের বিষয়ে উচ্চাভিলাসী হবে। ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা কখনই উচ্চাভিলাসের পথে বাধা হবে না। কারণ মুমিনের সর্বোচ্চ বিশ্বাস ও আস্থা যে সুখ-দুখ, হাসি-খুশি, ভালো-মন্দ সবকিছুই সমাধান আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়। ব্যক্তি শুধু চেষ্টা করে। আর তার ফলাফল আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে।
এককথায় মুমিনের উচ্চাভিলাসের উপাদান নিজস্ব ক্ষমতা নয়। বরং আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়াই ভরসা। অপর এক আয়াতে মুমিনের গুণ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, ‘যখনই ক্রোধ দেখা দেয়, তখনই তারা ক্ষমার নীতি অবলম্বন করে।’ (সুরা শুরা: ৩৭)।
কোরআনের সুরা নূরের শুরুর কয়েকটি আয়াতের প্রেক্ষাপট ছিল উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.)-এর জীবনের এক মর্মান্তিক ও মহাসৌভাগ্যের ঘটনা। যা সিরাত গ্রন্থে ইফকের (অপবাদ) ঘটনা নামে প্রসিদ্ধ। ঘটনাটি একদিকে ছিল মর্মান্তিক। কারণ, আম্মাজানের মতো পূতপবিত্র সতী নারীর পতি অপবাদ আরোপ।
অপরদিকে ছিল মহাসৌভাগ্যের। কারণ, অপরাধী মুনাফিকদের জবাবে এবং আম্মাজানের পূতপবিত্রতার ঘোষণায় স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাজিল করেছেন। আম্মাজান বলেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আল্লাহ পাক ওহির মাধ্যমে রাসুল (সা.) কে সত্য জানিয়ে দেবেন। তবে কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে অবগত করবেন এটা ছিল ধারণাতীত! (সুবহানাল্লাহ)।
যা হোক! পরে যখন আল্লাহ তায়ালা ওহির মাধ্যমে সত্যতা সবার সামনে উন্মোচিত করে দেন। তখন অপবাদকারীদের মধ্যে একজন ছিল আবু বকর (রা.)-এর নিকটাত্মীয় মিফতাহ। আবু বকর (রা.) যাকে নিয়মিত আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা করতেন। কিন্তু মুনাফিকদের অপপ্রচারে প্রভাবিত হয়ে তিনিও অপবাদ দেন। পরে সত্য উম্মোচিত হওয়ার পর তিনি লজ্জিত হয়ে আল্লাহর কাছে তওবা করেন।
আয়েশা (রা.)-এর পিতা আবু বকর (রা.)-এর কাছে এটা ছিল অসহনীয় ও বড়ই দুঃখের। তাই তিনি তার জন্য বরাদ্দ আর্থিক সাহায্য বন্ধ করে দেন। তিনি সংকল্প করেন যে আর কখনো তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করবেন না।
এ প্রেক্ষাপটেই আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাজিল করেন- ‘ তোমাদের মধ্যে যারা উচ্চমর্যাদা ও আর্থিক প্রাচুর্যের অধিকারী, তারা যেন কসম না খায় যে, তারা আত্মীয়-স্বজনকে, অভাবগ্রস্তকে এবং আল্লাহর পথে হিজরতকারীদের কিছুই দেবে না। তাদের ক্ষমা করা উচিত এবং দোষক্রটি উপেক্ষা করা উচিত। তোমরা কি কামনা কর না যে, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করেন? নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম করুণাময়।’ (সুরা নুর: ২২)
আল্লাহ তায়ালা এ আয়াতে ক্ষমা করে দেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করার আগে মানুষের প্রতি উদার হতে, দয়া দেখাতে নসিহত পেশ করেছেন। সম্পদশালী ব্যক্তিদের প্রতি এ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন, তারা যেন তাদের অধীনস্ত, গরিব কিংবা আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে যারা অভাবগ্রস্ত তাদের কোনো কিছু না দেয়ার ব্যাপারে কসম না করে।
এ আয়াতটি শুনে আবু বকর (রা.) অনেক বড় মনের পরিচয় দেন। নিজের মর্যাদা নিয়ে যান অনেক উচ্চতায়। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠেন— ‘হ্যাঁ’, আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই চাই আমার রব আমাকে ক্ষমা করুন।’ তারপর তিনি মিসতাহর প্রতি আর্থিক সাহায্য পুনরায় বহাল করে নেন এবং বলেন, ‘এ সাহায্য কোনদিন বন্ধ হবে না।’ (বুখারি, তাফসিরে কুরতুবি)।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, মুসলিম উম্মাহ ও বিশ্বমানবতার সবার উচিত নিকটাত্মীয়, গরিব-অসহায়দের প্রতি উদারতা কিংবা ক্ষমা দেখানো।
লেখক: সহকারী মুফতি, মারকাযুদ্ দাওয়াহ ওয়াল ইরশাদ, ঢাকা।
Leave a Reply