মুসলিম জীবনে ফতোয়া যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, অক্টোবর ১, ২০২৪
  • 52 পাঠক

ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা । ০১ অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।

ফতোয়া একটি চলমান প্রক্রিয়া। যত দিন ইসলাম ও মুসলমান থাকবে, তত দিন ফতোয়াও থাকবে। ইসলামকে জানা ও মানার তাগিদে ফতোয়া জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফতোয়ার অনুসরণ অপরিহার্য।

ফতোয়া পরিচিতি :

ফতোয়া অর্থ—রায়, মত, সিদ্ধান্ত। পরিভাষায়—শরিয়ত বিষয়ে শরিয়ত বিশেষজ্ঞের রায় হলো ফতোয়া। মূলত কোনো কাজ বৈধ বা অবৈধ হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহর বিধান জানিয়ে দেওয়াই হলো ফতোয়া। আধুনিক পণ্ডিত ব্যক্তিরা মনে করেন, ইসলামী আইনে বিশেষজ্ঞ কর্তৃক আনুষ্ঠানিক আইনগত মতামত প্রদান হলো ফতোয়া।

সামগ্রিক বিবেচনায় বলা যায়, ইসলামী জ্ঞান-গবেষণায় একশ্রেণির মানুষ বিশেষজ্ঞ হবেন, অন্য শ্রেণির মানুষ বিশেষজ্ঞ হবেন না। যাঁরা বিশেষজ্ঞ নন তাঁদের অনেক বিষয়ে জানার প্রয়োজন দেখা দেবে—এটাই স্বাভাবিক। তখন তাঁরা বিশেষজ্ঞ শ্রেণির কাছে জিজ্ঞাসা করবেন। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যদি তোমরা না জানো, তাহলে যারা জানে তাদের জিজ্ঞেস করো। ’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৪৩)

এরূপ জিজ্ঞাসার জবাবে বিশেষজ্ঞরা ইসলামী নীতিমালা অনুসরণ করে যে সিদ্ধান্ত প্রদান করেন সেটিই ফতোয়া। পবিত্র কোরআনে একাধিক স্থানে ফতোয়া শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়। যেমন বলা হয়েছে—‘ লোকে তোমার কাছে ফতোয়া জানতে চায়। বলো, পিতা-মাতাহীন নিঃসন্তান ব্যক্তি সম্বন্ধে তোমাদেরকে আল্লাহ ফতোয়া জানাচ্ছেন…।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৭৬)

ফতোয়া নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়

অনেক সময় অযোগ্য ব্যক্তি কর্তৃক ফতোয়া প্রদান এবং গ্রাম্য মাতব্বর কর্তৃক বিচার-সালিসের মাধ্যমে ফতোয়ায় অপব্যবহার হয়। এ অপব্যবহারকে কেন্দ্র করেই একসময় হাইকোর্ট কর্তৃক সব ধরনের ফতোয়া নিষিদ্ধ হয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে ২০০০ সালে নওগাঁয় কিছু অযোগ্য ব্যক্তির ফতোয়ার অপপ্রয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০১ সালের জানুয়ারি মাসে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সব ধরনের ফতোয়াকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় প্রদান করেন।

সে রায়ে বলা হয়, একমাত্র আদালতই মুসলিম বা অন্য কোনো আইন অনুযায়ী আইনসংক্রান্ত কোনো প্রশ্নে মতামত দিতে পারেন। কেউ ফতোয়া দিলে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য হবে। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয়।

আপিলের এক দশক পর ২০১১ সালের মার্চ মাস থেকে এর ওপর পূর্ণাঙ্গ শুনানি শুরু হয়। শুনানি শেষে আপিল বিভাগ ১২ মে সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেন। তাতে বলা হয়, ‘ ধর্মীয় বিষয়ে ফতোয়া দেয়া। শিক্ষিত লোকেরাই শুধু ফতোয়া দিতে পারবেন। গ্রহণের বিষয়টি হতে হবে স্বতঃস্ফূর্ত। কারো ওপর কোনো শক্তি প্রয়োগ করা যাবে না।’

সংক্ষিপ্ত নির্দেশ শেষে আদালত এও বলেছেন, ‘ যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাইকোর্ট ফতোয়াকে অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন সে ঘটনায় দেয়া ফতোয়াটি অবৈধ।’ পরবর্তী সময়ে সুপ্রিম কোর্ট থেকে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে।

ফতোয়ার অপব্যবহারের কারণ

ফতোয়ার অপব্যবহারের মৌলিক কারণ হলো, প্রথমত. শরিয়তের খুঁটিনাটি বিষয়ে না জেনে এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন না করে ফতোয়া প্রদান করা। অনেকেই দু-একটি বই পড়ে বা ইলেকট্রনিকস বা প্রিন্ট মিডিয়া অনুসরণ করে ফতোয়া দেয়ার চেষ্টা করে।

বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ আলেমদের তোয়াক্কা না করে, বরং ক্ষেত্রবিশেষে তাঁদের সঙ্গে বিতর্ক করে। এটি জঘন্য অপরাধ এবং কিয়ামতের একটি অন্যতম আলামত।

দ্বিতীয়ত, সাধারণত দুটি বিষয়ে অযোগ্য ব্যক্তি বা গ্রাম্য মাতব্বর কর্তৃক ফতোয়া প্রদান ও তা কার্যকর করার বিষয়টি পরিলক্ষিত হয় এবং অনেকে ফতোয়াকে এ দুটি বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ মনে করে। অথচ এ দুটি বিষয়ের প্রচলিত ফতোয়া ইসলাম সমর্থিত নয়। একটি হলো বিবাহবহির্ভূত যৌনাচার এবং অপরটি হলো হিল্লা বিয়ে।

বিবাহবহির্ভূত যৌনাচারবিষয়ক ফতোয়া

বিবাহবহির্ভূত যৌনাচারের ক্ষেত্রে যে ফতোয়া দেয়া হয় তাহলো সামাজিকভাবে বয়কট বা একঘরে করে রাখা অথবা ১০০টি বেত্রাঘাত করা ইত্যাদি। সামাজিকভাবে এ ধরনের ফতোয়া প্রদান বা কার্যকর করার কোনো বৈধতা কোরআন ও সুন্নায় নেই। বিবাহবহির্ভূত যৌনাচার একটি জঘন্য অপকর্ম। এতে কোনো সন্দেহ নেই।

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না, নিশ্চয় তা অশ্লীল কাজ ও মন্দ পথ।’ (সুরা : আল-ইসরা, আয়াত : ৩২)

কাজেই সামাজিকভাবে বিবাহবহির্ভূত যৌনাচার রোধ করতে ব্যভিচারসংক্রান্ত কোরআন ও সুন্নাহর বর্ণনাগুলো প্রচার করতে হবে এবং ব্যভিচারের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে যৌক্তিকভাবে ও প্রজ্ঞার সঙ্গে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

কোরআন ও সুন্নায় উল্লিখিত ব্যভিচারের শাস্তি কার্যকর করার দায়িত্ব সরকারের। ইসলামী শাসনব্যবস্থা থাকলে সেগুলো কার্যকর হবে। পারিবারিক বা সামাজিকভাবে এসব শাস্তি বাস্তবায়ন করা যাবে না। সামাজিকভাবে এসব কার্যকরের চেষ্টা করা ফতোয়ার অপব্যবহার।

হিল্লা বিবাহবিষয়ক ফতোয়া

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে চূড়ান্ত পর্যায়ের বিচ্ছেদ হওয়ার পর তারা আবার সংসার করতে চাইলে অনেকে হিল্লা বিয়ের ফতোয়া প্রদান করে। অর্থাৎ দ্বিতীয় একজন পুরুষের সঙ্গে সেই মহিলার বিয়ে দিতে হবে ; এরপর দ্বিতীয় স্বামী তালাক দেবে, তারপর প্রথম স্বামী তাকে গ্রহণ করবে। অথচ শরিয়তে এমন কোনো ফতোয়া নেই। তালাক ইসলামে নিরুৎসাহ একটি বিষয়।

ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘ আল্লাহ তাআলার কাছে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট হালাল কাজ হলো তালাক।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২১৭৫)

একান্তই তালাকের প্রয়োজন দেখা দিলে এক বা দুই তালাক দিয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। তাহলে পরে সম্মত হলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বহাল করা যাবে। কিন্তু তিন তালাক দিয়ে ফেললে চূড়ান্তভাবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে যাবে। যেমন—আল্লাহ বলেন, ‘ তালাক হলো দুবার পর্যন্ত, তারপর হয় নিয়মানুযায়ী রাখবে, না হয় সহৃদয়তার সঙ্গে বর্জন করবে।… অতঃপর যদি সে স্ত্রীকে তৃতীয়বার তালাক দেয়, তবে সে স্ত্রী যে পর্যন্ত তাকে ছাড়া অন্য কোনো স্বামীর সঙ্গে বিয়ে করে না নেবে, তার জন্য হালাল নয়।

অতঃপর যদি দ্বিতীয় স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দেয়, তাহলে তাদের উভয়ের জন্যই পরস্পরকে আবার বিয়ে করাতে কোনো পাপ নেই। যদি উভয়ে মনে করে যে, তারা আল্লাহর সীমারেখা রক্ষা করে চলতে পারবে।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২২৯- ২৩০)

আয়াতের বিধানটি আমরা এভাবে বুঝতে পারি যে মনে করি ‘ক’ স্বামী আর ‘খ’ স্ত্রী। তাদের বিয়ের পর বিচ্ছেদ ঘটেছে এবং সেটা তিন তালাকের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ। তাহলে তারা আর কখনো একত্র হতে পারবে না। তবে যদি তাদের এই বিচ্ছেদের পর ‘খ’ তার ইদ্দত শেষ করে ‘গ’ পুরুষের সঙ্গে বিয়ে করে এবং তাদের স্বাভাবিক জীবন-সংসার চলতে থাকে।

হঠাৎ ‘গ’ মারা যায় অথবা বনিবনা না হওয়ায় ‘খ’কে তিন তালাক প্রদান করে। সে ক্ষেত্রে ‘খ’-এর ইদ্দত পূর্তির পর আবার চাইলে ‘ক’-কে বিয়ে করতে পারে। আল্লাহ তাআলা এমনটিই বলেছেন। তিন তালাকের মাধ্যমে বিচ্ছেদের পর স্ত্রীকে শর্তের সঙ্গে অন্য পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার পর আবার তার কাছ থেকে তালাক নিয়ে বিয়ে করার কোনো অবকাশ নেই।

এভাবে দ্বিতীয়জনের সঙ্গে বিয়ে দেয়ার নাম হিল্লা বিয়ে। এমনটি নিষেধ। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে হিল্লা বিয়ে করে এবং যার জন্য হিল্লা বিয়ে করা হয়—উভয়কেই রাসুলুল্লাহ (সা.) অভিসম্পাত করেছেন। (তিরমিজি, হাদিস : ১১২০)

তালাক নিকৃষ্ট একটি কাজ। চূড়ান্ত প্রয়োজন হলে এক বা দুইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। তিন তালাক দিলে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ হবে এবং একত্রে ঘরসংসার করা যাবে না। তবে কাকতালীয়ভাবে স্ত্রীর অন্য স্বামীর সঙ্গে বিয়ে হলে এবং তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটলে বা সেই স্বামী মারা গেলে প্রথম স্বামীর সঙ্গে আবার ঘর বাঁধতে পারবে। শর্ত করে বিয়ে দিয়ে আবার তালাক নিয়ে ঘর বাঁধার নিয়ম নেই।

কাজেই এমন ফতোয়ারও কোনো অবকাশ নেই। এ জন্য হিল্লা বিয়ের ফতোয়া (যা অভিশপ্ত বিষয়) এবং শাস্তি প্রয়োগের ফতোয়া (যা প্রয়োগের অধিকার কেবল রাষ্ট্র বা সরকারের) শুধুই ফতোয়ার অপব্যবহার।

এসব ফতোয়ার কারণেই ফতোয়ার প্রতি মানুষের অনাসক্তি তৈরি হয়। সেগুলো সঠিক ফতোয়া নয়, আবার ফতোয়া এগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধও নয়; বরং ইসলামী সব বিষয়ের যথার্থ সমাধানই ফতোয়া, যা মানবজীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

 

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!