নিজস্ব প্রতিনিধি
—————–
সরকারী নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার হচ্ছে ক্ষতিকর পলিথিন। এতে ভেঙে পড়েছে শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা। দূষিত হচ্ছে পানির তলদেশ, উর্বরতা হারাচ্ছে মাটি। ভরাট হচ্ছে নদীনালা, খালবিল। অতিমাত্রায় পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহারের কারণে মানব শরীরে বাসা বাঁধছে ক্যানসারসহ নানা রোগ।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, অনেক দেশ আইন করে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে স্থলের পর এবার সাগর-মহাসাগরকে বিষিয়ে তুলছে বিষাক্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক। তারপরও সচেতনতা বাড়ছে না। মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশকে রক্ষা করতে পলিথিন ও ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। তারা বলছেন, পলিথিন নিষিদ্ধ হওয়ার পরও সারা দেশে চলছে এর রমরমা ব্যবহার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখের সামনেই সারা দেশেই পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার চলছে। ছোট্ট পণ্য থেকে শুরু করে বড় পণ্য—সবকিছুই বিক্রেতারা পলিথিনের ব্যাগে ভরে ক্রেতাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারে চর্মরোগ ও ক্যানসারসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারেন যে কেউ। অথচ ২০০২ সালে আইন করে পলিথিন উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। আইনের বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উৎপাদন, আমদানি বা বাজারজাত করে তা হলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দণ্ডও হতে পারে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) দেয়া তথ্য অনুসারে বিশ্বের ৮৭টি দেশে একবার ব্যবহার উপযোগী পলিথিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে।
সরেজমিনে নোয়াখালী পৌর বাজার, দত্তের হাট, সোনাপুর, বসুর হাট, চৌমুহনীসহ জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে পলিথিনের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা গেছে। দোকানিরা প্রতিটি পণ্যই পলিথিনের ব্যাগে ভরে বিক্রি করছেন। এ ক্ষেত্রে ক্রেতাদেরও অসচেতনতা লক্ষ করা যায়। কোনো ক্রেতাকেই এ বিষয়ে মুখ খুলতে দেখা যায়নি।
তবে বড় বড় সুপারশপগুলোতে পলিথিনের ব্যবহার দেখা যায়নি। পাড়ায়-মহল্লায় মুদির দোকানগুলো থেকে শুরু করে মাছ বাজার থেকে ভ্যানগাড়ির ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলোতেও পলিথিনের ব্যাপক ব্যবহার দেখা গেছে।
তথ্য মতে, শুধু নোয়াখালীতেই দিনে প্রায় কয়েক হাজার পলিথিন ব্যাগ জমা হচ্ছে। জানা যায়, নোয়াখালী শহরের প্রায় প্রাণ বলে পরিচিত খালগুলোর পানি এখন পলিথিনের কারণে ভয়াবহ দূষিত।
এসব খালের তলদেশে জমাট বেঁধেছে প্রায় ৪/৫ ফুট পুরো পলিথিনের স্তর। ভয়াবহ দূষণের কারণে এই খালের পানি থেকে ছড়াচ্ছে তীব্র দুর্গন্ধ। প্রাণ ও পরিবেশ বাঁচাতে শাস্তির বিধান রেখে আইন করা হয়। বিকল্প হিসেবে ব্যবহার শুরু হয় কাগজের ব্যাগ। সচেতনতা ও আইনের প্রয়োগ না থাকায় পলিথিনের উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নোয়াখালী শহরে জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ পলিথিন। জেলা শহর ও বিভিন্ন উপজেলা শহরের খালগুলো মরে যাওয়ার জন্যও অনেকাংশে দায়ী পলিথিন। পলিথিনের বহুবিধ ব্যবহারের কারণে মানবদেহে বাসা বাঁধছে ক্যানসারসহ নানা জটিল রোগ। পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যবহারের মানবদেহে হরমোনের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে দেখা দিতে পারে বন্ধ্যত্ব, নষ্ট হতে পারে গর্ভবতী মায়ের ভ্রূণ, বিকল হতে পারে লিভার ও কিডনি।
তারপরও পলিথিনের ব্যবহার কমছে না, বরং দিন দিন বেড়েই চলছে। মাঝে মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান হলেও তা পলিথিনের ব্যবহার কমাতে পারছে না। পলিথিন ব্যাগের বা প্লাস্টিক পণ্যের জনপ্রিয়তার কারণ হিসেবে জানা যায়, পলিথিন ব্যাগ সহজলভ্য ও দাম কম। পলিথিনকে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভবিষ্যতে সুয়্যারেজ লাইন বন্ধ হয়ে যাবে, নদী খাল মরে যাবে, প্রাণিজ সম্পদ ধ্বংস হওয়ার মাধ্যমে পরিবেশের মহাবিপর্যয় ঘটবে।
পরিবেশ আন্দোলনের এক কর্মী এ বিষয়ে বলেন, পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধে আইন থাকলেও এর কার্যকারিতা নেই। পলিথিন দূষণ আমাদের ভূমি, নদী-সাগর সব বিষাক্ত করছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার কারণে নিষিদ্ধ পলিথিন এখনো অবাধে উৎপন্ন ও বাজারজাত হচ্ছে। নোয়াখালীর চৌমুহনীতে অর্ধশত কারখানায় নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরি হচ্ছে। এগুলোর বেশির ভাগই বাজারের ভেতরে।
আরেক পরিবেশবাদী বলেন, আইনে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকলেও সারা দেশে ব্যাপকহারে ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু দেখার কেউ নেই। পলিথিনের কারণে পরিবেশ দূষণের সবচেয়ে বড় প্রমাণ শহরের খালগুলোর তলদেশ। তিনি বলেন, সাগরে মাছের তুলনায় পলিথিনের সংখ্যা বেশি। শহরের ড্রেনগুলো পলিথিন ও প্লাস্টিক দ্রব্যে ভরে গেছে। একটু বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। বড় বাজেটের প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও এর সুরাহা করা সম্ভব হয়নি।
তিনি আরো জানান, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে পচনশীল দ্রব্যে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ব্যবহারের সাময়িক অনুমোদন নিয়ে এর ব্যবহার অব্যাহত রাখা হয়। পলিথিন বন্ধে অভিযান এক সময় চললেও এখন অজ্ঞাত কারণে বন্ধ আছে। এখন যেভাবে পলিথিন ব্যবহৃত হচ্ছে তা বেআইনি।
Leave a Reply