নিজস্ব প্রতিনিধি, নোয়াখালী
————————–
জেলার দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া থেকে জেলা শহরে ভালো চিকিৎসার আশায় এসেছেন ফারুক মিয়া। শহরের হাসপাতাল সড়কের প্রাইম হসপিটালে বসা একজন চিকিৎসককে দেখিয়েছেন। বের হয়ে ফারুক মিয়া খুব উৎফুল্ল হয়ে কথা বলছেন।
জানান, স্যার আসলেই গরিবের ডাক্তার। যেভাবে দেখলো, এভাবে কেউ দেখে না। তাও ৬০০ টাকা নিলো। এখন তো গ্রামেও রোগ নিয়ে কোন ফার্মেসীর ডাক্তারের কাছে গেলেই ওষুুধের সাথে কতগুলো টাকা নিয়ে নেয়। এই চিকিৎসকের চিকিৎসা নেয়া ফি নিয়ে তিনি বেশ আনন্দিত।
কারণ যেখানে কোন কোন গ্রামেও পল্লী চিকিৎসকরা ২০০ টাকা নেয়, ঠিক সেসময়ে জেলা শহরের একজন চিকিৎসকের কাছে ৬০০ টাকায় ভালো চিকিৎসক পাওয়া অনেকটা তেমনই কঠিন বিষয়।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নোয়াখালীর প্রায় চিকিৎসকরা আটশত টাকার নিচে রোগী দেখেন খুব কম। এখন ভালো চিকিৎসক মানে লম্বা সিরিয়াল আর মোটা অঙ্কের টাকা। যার পরিমাণ এক হাজার থেকে ১২০০টাকাও হয়।
এছাড়া বিশেষজ্ঞ কতেক চিকিৎসক প্রথম ফি ১২০০ এবং দ্বিতীয় ফি ৭০০ টাকা।
বিষয়টি মানবতাহীন উল্লেখ করে নাম প্রকাশ না করার শর্তে নোয়াখালী আবদুল মালেক উকিল মেডিকেলের এক চিকিৎসক বলেন, এক সময় এ জেলায় অনেক ভালো চিকিৎসকও মাত্র ২০০ ও ৩০০ টাকা করে ভিজিট নিতেন। আর এখন এসব সত্যি যেন কল্পনা করা যায় না।
নামমাত্র ফির জন্যে তিনি সাবেক সিভিল সার্জন ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন ও মোহাম্মদ আলীর নামও উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হেলথ ইকোনমিকস ইউনিটের তৈরি করা ‘ বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস ১৯৯৭-২০১৫’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে স্বাস্থ্য খাতে অর্থ ব্যয়ের মাত্র ২৩ ভাগ বহন করে সরকার, বাকি ৬৭ ভাগ ব্যয় করে ব্যক্তি নিজে।
এমনকি সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মানুষই স্বাস্থ্যের জন্য নিজের পকেট থেকে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে। এসব বন্ধ করতে আইন তৈরি ও বাস্তবায়ন জরুরি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ অর্ডিন্যান্স ১৯৮২’ অনুযায়ী বর্তমান বেসরকারি চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
কিন্তু সেখানে চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণ সম্পর্কে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। ফলে বেসরকারি চেম্বারে ইচ্ছোমতো অর্থ আদায় করছে একটি চিকিৎসা-বাণিজ্য সিন্ডিকেট। আবার নতুন স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন ২০১৯-এর খসড়ার ১০ অনুচ্ছেদে ফি নির্ধারণে গেজেট বা প্রজ্ঞাপনের কথা থাকলেও তার কোনো বাস্তবায়ন নেই।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, সেবার নামে চিকিৎসা ব্যাণিজ্যের লাগাম টেনে ধরতে সরকার ‘ বেসরকারি চিকিৎসাসেবা আইন ২০১৬’-এর খসড়া তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। যেখানে রোগীদের মানসম্মত সেবা নিশ্চিতের পাশাপাশি চিকিৎসা ব্যয় কমানোর বিষয়টি গুরুত্বারোপ করা হয়। কিন্তু কাজটা সেখানে থেমে যায়। এরপর সেই খসড়াটি স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন ২০১৯ নামে গত অক্টোবর মাসে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে পাঠানো হয়।
কিন্তু এর আলোকে নীতিমালা না থাকার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের যে কোন বড় হাসপাতাল থেকে শুরু করে নামকাওয়াস্তের ক্লিনিক, ডায়াগনোস্টিক সেন্টার ও চেম্বারে চিকিৎসকরা লাগাম ছাড়া ফি নিচ্ছেন।
তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ে সরেজমিন জেলার একাধিক নামিদামি বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সেখানে অধ্যাপক, সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপক চিকিৎসকদের ন্যূনতম ভিজিট ৭০০ থেকে ১২০০ হাজার টাকা পর্যন্ত। মোটা অংকের এই ফি আদায়ের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডক্টর চেম্বার কর্তৃপক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা করছে।
স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন-২০১৯ এর খসড়ায় বলা আছে, এই আইন পাস হলে সরকারি চাকরিতে কর্মরত কোনো চিকিৎসক অফিস সময়ে বেসরকারি হাসপাতাল বা ব্যক্তিগত চেম্বারে চিকিৎসা দিতে পারবেন না। অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে এক লাখ টাকা এবং বেসরকারি হাসপাতাল বা প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা গুনতে হবে।
এমনকি ছুটির দিনে চিকিৎসকদের নিজ নিজ কর্মস্থলের জেলার বাইরে বেসরকারি হাসপাতালে বা ব্যক্তিগত চেম্বারে টাকার বিনিময়ে সেবা দিতেও সরকারের অনুমতি নিতে হবে।
এছাড়া প্রস্তাবিত খসড়া আইনের ১০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, রোগীদের চিকিৎসকের ফি সম্পর্কে জানাতে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ফি তালিকা চেম্বারের সামনে টাঙানো ও উক্ত ফি-এর রশিদ রোগীকে দিতে বাধ্য থাকবেন। সেবাগ্রহীতা বা তার অভিভাবককে ওই রশিদের অনুলিপি প্রদান করতে হবে। চেম্বারে রোগ পরীক্ষার নূন্যতম চিকিৎসা সরঞ্জাম থাকতে হবে।
অনুমোদিত ডিগ্রি ছাড়া অন্য কোনো ডিগ্রির বিবরণ সাইনবোর্ড বা নামফলক কিংবা ভিজিটিং কার্ডে উল্লেখ করা যাবে না। ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ও ভিজিটিং কার্ডে বিএমডিসির নিবন্ধন নম্বর লেখা থাকতে হবে। মহিলা রোগীর পরীক্ষার জন্য মহিলা নার্স বা সহায়ক থাকতে হবে।
তবে জটিল পরিস্থিতিতে যৌক্তিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এই শর্ত শিথিলযোগ্য। এক্ষেত্রে আইন অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে এক লাখ টাকা জরিমানা। একইসঙ্গে আদালত সংশ্লিষ্ট বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রের মালিককে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড দেয়া হবে।
স্বাস্থ্যসেবাদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি সহিংস কাজ করলে তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে বলে আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে সেবাদানকারী ও প্রতিষ্ঠানের কোনো সম্পত্তির ক্ষতিসাধন, বিনষ্ট করা, ধ্বংসের মতো অপরাধের শাস্তি তিন বছরের সশ্রম কারাদন্ড এবং সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করা হবে।
বেসরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে জরুরি সেবা প্রদানের ব্যবস্থা না থাকলে পাঁচ লাখ টাকা অর্থদন্ড এবং অনাদায়ে তিন মাসের বিনাশ্রম শাস্তি ভোগ করতে হবে। চিকিৎসাকেন্দ্রে যদি রোগীর বসার স্থান না থাকে তা হলে ডাক্তারকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে।
সেবাগ্রহীতাকে টাকার রশিদ না দিলে বা সার্ভিস চার্জ মূল্য হাসপাতালে সংরক্ষণ করা না হলে দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ টাকা জরিমানা ও ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদন্ড দেয়া হবে। এই আইনের যেকোনো ধারা লঙ্ঘন করলে বা লঙ্ঘনে প্ররোচনা দিলে বা সহযোগিতা করলে দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের দুই লাখ টাকা জরিমানা এবং একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি হলে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা ও ৩ মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড ভোগ করতে হবে।
খসড়া অনুসারে, রোগী ও রোগীর স্বজনদের চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য দিতে হবে। প্রয়োজনে রোগীকে বিকল্প চিকিৎসা দিতে হবে এবং তা রোগীর স্বজনদের জানাতে হবে। চিকিৎসাকালীন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, চিকিৎসা পদ্ধতি এবং অস্ত্রোপচারের জটিলতা রোগীর স্বজনদের জানাতে হবে। চিকিৎসা ব্যয় অর্থাৎ কোন খাতে কত ব্যয় হবে তা রোগীর স্বজনদের জানাতে হবে। চিকিৎসা দেয়ার অনুমতি নিতে হবে।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের নোয়াখালীর এক নেতা বলেন, আইনজীবীদের তো ফি নির্ধারণ করা যায় না। তারা তাদের মতো করে ফি নির্ধারণ করে।
ঠিক তেমনিভাবে চিকিৎসাও তো একটা স্বাধীন পেশা আইনজীবীদের ফি নির্ধারণ করা সম্ভব না হলে চিকিৎসকদের ফি কি নির্ধারণ করা সম্ভব নাকি। তারপরও সরকার চাইলে এখানে উভয়পক্ষের সঙ্গে আলাপচারিতার মাধ্যমে একটি ফি নির্ধারণ করে দিতে পারে।
খসড়া আইনে চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণের বিষয়ে স্বাস্থ্য সচেতন এক নাগরিক বলেন, দেশে অনেক আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই। স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইনের এই খসড়া ২০১৬ সালে একবার করা হয়েছিলো।
কিন্তু সেটা আর আলোর মুখ দেখেনি। এই যে দীর্ঘসূত্রতা এর জন্য কিন্তু সরকার দায় এড়াতে পারে না। আবার চিকিৎসকরা আইন না মানলে সেটাও সরকারের ব্যর্থতা। তবে পৃথিবীর কোথাও সরকার চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণ করে দেয় না। সেসব দেশে চিকিৎসক সংগঠন ও সরকার সমন্বয় করে।
Leave a Reply