মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ
————————-
মানুষ উপার্জনের সবটুকু একা ভোগ করতে পারে না। নিজের উপার্জিত অর্থে পরিবার ও অভাবী মানুষের অধিকার আছে। সম্পদ কোথায় বা কোন খাতে ব্যয় করব—এ বিষয়ে কোরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। বৈধ পন্থায় অর্জিত সম্পদের যে অংশ নিজের প্রয়োজন মেটানোর পর অবশিষ্ট থাকে, তা অন্যদের জন্য ব্যয় করা উচিত।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘…মানুষ তোমার কাছে জানতে চায়, তারা (আল্লাহর পথে) কী (পরিমাণ) খরচ করবে? বলে দাও, যা তোমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত…। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২১৯)
নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ ব্যয় করা মহাপুণ্যের কাজ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা পূর্ব কিংবা পশ্চিম দিকে মুখ ফেরালে তা কিন্তু প্রকৃত পুণ্যের কাজ নয়; বরং প্রকৃত নেক কাজ হলো, মানুষ ঈমান আনবে আল্লাহর প্রতি, পরকালের প্রতি, ফেরেশতাদের প্রতি, কিতাবের প্রতি, নবীদের প্রতি; আর আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় অর্থসম্পদ ব্যয় করবে আত্মীয়দের জন্য, এতিমদের জন্য, মিসকিনদের ও পথিকদের জন্য, সাহায্যপ্রার্থীদের জন্য এবং মানুষকে গোলামির জিঞ্জির থেকে মুক্ত করার জন্য…। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৭৭)
আর দান ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালোটি বেছে নিতে হবে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘ তোমরা কখনো পুণ্য লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা নিজেদের পছন্দনীয় জিনিস আল্লাহর পথে ব্যয় করবে। আর তোমরা যা কিছু ব্যয় করো, সে সম্পর্কে আল্লাহ পূর্ণ জ্ঞাত। ’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৯২)
দান, প্রয়োজন পূরণ ও অর্থব্যয়ের ক্ষেত্রে মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্ত, প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথি ও অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অধিকার সবচেয়ে বেশি।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘ আল্লাহর দাসত্ব করো। তাঁর সঙ্গে কাউকেও শরিক করো না। দয়া ও সহানুভূতিমূলক আচরণ করো মা-বাবার সঙ্গে, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে, এতিমদের সঙ্গে, মিসকিনদের সঙ্গে, নিকট-প্রতিবেশীদের সঙ্গে, দূর-প্রতিবেশীদের সঙ্গে, সঙ্গী-সাথিদের সঙ্গে, পথিকদের সঙ্গে এবং তোমাদের অধীনস্থ ভৃত্যদের সঙ্গে। নিশ্চয়ই আল্লাহ গর্ব ও অহংকারী লোকদের ভালোবাসেন না, যারা নিজেরা কার্পণ্য করে, অন্যদেরও কৃপণতার শিক্ষা দেয় এবং আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের যা দান করেছেন তা লুকিয়ে রাখে। এরূপ অকৃতজ্ঞ লোকদের জন্য আমি (আল্লাহ) অপমানকর শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি। ’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৩৬-৩৭)
যেসব মানুষ দ্বিন-ধর্মের কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন কিংবা ইসলাম প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নিজেকে নিয়োজিত রাখার দরুন অর্থ উপার্জনে মনোযোগ দিতে পারেন না, এমন মানুষের জন্য যথাসাধ্য ব্যয় করা মুসলিম ধনাঢ্য ব্যক্তিদের অন্যতম দায়িত্ব।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘এটা (অর্থ) প্রাপ্য অভাবগ্রস্ত লোকদের; যারা আল্লাহর পথে এমনভাবে ব্যাপৃত যে দেশময় ঘোরাফেরা করতে পারে না; কারো কাছে না চাওয়ার কারণে অজ্ঞ লোকেরা তাদের অভাবমুক্ত মনে করে—তুমি তাদের লক্ষণ দেখে চিনতে পারবে। তারা মানুষের কাছে নাছোড় হয়ে হাত পাতে না। যে ধন-সম্পদ তোমরা ব্যয় করো আল্লাহ তো তা বিশেষভাবে জানেন। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৭৩)
বর্তমানেও যেসব লোক নিজেদের পুরো সময় দ্বিনের জ্ঞান লাভ, শিক্ষাদান, দ্বিনের প্রচার এবং সমাজের অন্য কল্যাণমূলক কাজে নিয়োগ করে এবং ব্যক্তিগত আয় রোজগারের দিকে দৃষ্টিপাত করার সুযোগ পায় না, তারাও এ আয়াতে উল্লিখিত মানুষের অন্তর্ভুক্ত।
নিজের অধীনস্থ কর্মচারীদের সুখ-দুঃখ দেখা এবং তাদের জন্য যথাসাধ্য ব্যয় করাও অর্থব্যয়ের অন্যতম খাত। ইরশাদ হয়েছে, ‘…তোমাদের ক্রীতদাসদের মধ্যে যারা চুক্তি সম্পাদন করতে চায়, তোমরা তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হও—যদি তাদের মধ্যে কোনো কল্যাণ আছে বলে তোমরা মনে করো। আর তাদের আল্লাহর সেই অর্থসম্পদ থেকে দান করো, যা তিনি তোমাদের দান করেছেন…। ’ (সুরা নূর, আয়াত : ৩৩)
অর্থব্যয় ও পরোপকারে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো, অর্থব্যয় করতে হবে পার্থিব কোনো বিনিময় গ্রহণের আশা ছাড়া—শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। কোরআনে এসেছে, ‘আর (সৎ লোকেরা) আল্লাহর ভালোবাসায় খাবার খাওয়ায় মিসকিন, এতিম এবং বন্দিদের, আর বলে, আমরা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই তোমাদের আহার করাচ্ছি। তোমাদের কাছ থেকে কোনো ধরনের বিনিময় বা কৃতজ্ঞতা লাভের আমরা আকাঙ্ক্ষী নই। ’ (সুরা দাহর, আয়াত : ৮-৯)
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত এসব খাতে ব্যয় করাকে কোরআন শুধু একটি মৌলিক নেক কাজ বলেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এ কথাও বলে দিয়েছে যে এমনটি না করলে সামগ্রিকভাবে সমাজের ধ্বংস অনিবার্য। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আল্লাহর পথে ব্যয় করো আর নিজেদের হাতেই নিজেদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়ো না। মানুষের প্রতি অনুগ্রহ-ইহসান করো। আল্লাহ অনুগ্রকারীদের ভালোবাসেন। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৯৫)
Leave a Reply