মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির নেপথ্যের দুই কুশীলব

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, আগস্ট ২২, ২০২৩
  • 82 পাঠক

————————————————————————————————————————————–
জেক সুলিভান ও উইলিয়াম জে বার্নস

————————————————————————————————————————————–

দিশারী ডেস্ক। ২২ আগস্ট, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ।

জেক সুলিভান ও উইলিয়াম জে বার্নস। একসময় তারা পরিচিত ছিলেন হিলারি ক্লিনটনের ঘনিষ্ঠ দুই সহযোগী হিসেবে। জেক সুলিভানকে হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মিনেসোটার সিনেটর অ্যামি ক্লোবাচার। এর সূত্র ধরে সাবেক মার্কিন ফার্স্ট লেডির নির্বাচনী উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। হিলারি ক্লিনটনই তাকে প্রশাসনে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ে এসেছিলেন। আর মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির রাজনৈতিক দিকগুলো নিয়ে হিলারি ক্লিনটনকে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হয়েছে উইলিয়াম জে বার্নসের (বিল বার্নস নামেও পরিচিত) সঙ্গে। হিলারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে বিল বার্নস ছিলেন আন্ডারসেক্রেটারি অব স্টেট ফর পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স।

নেপথ্য বা গোপন কূটনৈতিক তৎপরতার (কূটনীতিক মহলে ব্যাক চ্যানেল ডিপ্লোমেসি হিসেবে পরিচিত) জন্য এ দুজনের ওপর নির্ভর করতেন হিলারি ক্লিনটন। হিলারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সফলতম উদাহরণগুলোর বড় কৃতিত্ব দেয়া হয় জেক সুলিভান ও উইলিয়াম জে বার্নসের ব্যাক চ্যানেল ডিপ্লোমেসিকে।

শত শত বছর ধরেই প্রকাশ্য কূটনীতিকে কার্যকর ও শক্তিশালী করতে ব্যাক চ্যানেল ডিপ্লোমেসির ওপর নির্ভর করতে হয়েছে বিভিন্ন দেশের সরকারকে। কোনো কোনো সময় তা প্রকাশ্য কূটনৈতিক তৎপরতাকে ছাপিয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এটি হয়ে উঠেছে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম বড় অবলম্বন।

বর্তমান বাইডেন প্রশাসনেও জেক সুলিভান ও উইলিয়াম জে বার্নসকে দেখা হচ্ছে ব্যাক চ্যানেল ডিপ্লোমেসি বা নেপথ্য কূটনীতির প্রধানতম কুশীলবদের অন্যতম হিসেবে। জেক সুলিভান এখন যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেন প্রশাসনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন। উইলিয়াম জে বার্নস দায়িত্ব পালন করছেন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর পরিচালক হিসেবে।

জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বৈরী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি এখন মূলত জেক সুলিভানই দেখভাল করে থাকেন। গত বছরের শেষদিকে রুশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার গোপন আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বেশকিছু প্রতিবেদন ও মতামত প্রকাশ হয়। সে সময় এ প্রসঙ্গে জেক সুলিভান বলেছিলেন, রুশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে চলার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্যই জরুরি।

চলতি বছরের শুরুর দিকে ‘‌গুপ্তচর বেলুন’ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে কূটনৈতিক সংকট ও উত্তেজনা তৈরি হয়। এর ধারাবাহিকতায় চীনে পূর্বনির্ধারিত সফর বাতিল করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেন। গত মে মাসে ভিয়েনায় যুক্তরাষ্ট্রের আরেক বৈরী প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীনের শীর্ষ কূটনৈতিক ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবশালী সদস্য ওয়াং ইর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জেক সুলিভান। এরপর জুনে চীন সফরে যান অ্যান্থনি ব্লিংকেন। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা প্রশমনে জেক সুলিভান ও ওয়াং ইর বৈঠকটির বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মার্কিন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

জেক সুলিভানকে হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সিনেটর অ্যামি ক্লোবাচার। সুলিভান তখন একটি ল ফার্মের চাকরি ছেড়ে ক্লোবাচারের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছিলেন। সাবেক ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটন ২০০৮ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগ্রহ নিয়ে কার্যক্রম শুরু করলে তার নির্বাচনী শিবিরের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান জেক সুলিভান।

যদিও পরে হিলারি ক্লিনটন বারাক ওবামার সমর্থনে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। এর আগ পর্যন্ত নির্বাচনী বিতর্কগুলোর প্রস্তুতি নেয়ার সময় জেক সুলিভানের ওপরই নির্ভর করতে হতো হিলারি ক্লিনটনকে। বারাক ওবামার প্রশাসনে হিলারি ক্লিনটন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান। সে সময় তার চিফ অব স্টাফ ও মন্ত্রণালয়ের পলিসি প্ল্যানিং বিভাগের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান জেক সুলিভান। এর পর থেকে হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে ১১২টি দেশে সফরসঙ্গী হিসেবে গিয়েছেন জেক সুলিভান।

ইরানের সঙ্গে ২০১৫ সালে পরমাণু চুক্তি সইয়ের বিষয়টিকে ধরা হয় গত দশকে মার্কিন কূটনীতির সবচেয়ে বড় সাফল্যগুলোর অন্যতম হিসেবে। এ প্রয়াসকে সফল করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন জেক সুলিভান ও সে সময়কার অভিজ্ঞ প্রবীণ কূটনীতিক উইলিয়াম জে বার্নস। পরমাণু চুক্তিটি সফলভাবে সইয়ের পেছনে তাদের উভয়ের নেতৃত্বে পরিচালিত ব্যাক চ্যানেল ডিপ্লোমেসিকে কৃতিত্ব দেয়া হয় সবচেয়ে বেশি।

হিলারি ক্লিনটন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর ইরান নিয়ে করণীয় জানতে চেয়ে বিল বার্নসকে একটি নোট দিয়েছিলেন। এর জবাবে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে বার্নস তাকে একটি গোপন মেমোরেন্ডাম পাঠান, যা সম্প্রতি মার্কিন ন্যাশনাল সিকিউরিটি আর্কাইভে অবমুক্ত হয়েছে। ওই মেমোরেন্ডাম ছিল ইরানে হিলারি ক্লিনটনের অধীন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কূটনৈতিক তৎপরতার বড় ভিত্তি।

২০১৩ সালে জেক সুলিভান ও উইলিয়াম জে বার্নসের নেতৃত্বে গোপন একটি কূটনৈতিক চ্যানেল গড়ে তোলা হয়। এ চ্যানেলে পরিচালিত তৎপরতার ধারাবাহিকতায় পিএম ৫+১ দেশগুলোর ( জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন ও ফ্রান্স এবং জার্মানি ) সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন একটি চুক্তি সই করে ইরান। অন্তর্বর্তীকালীন এ চুক্তির প্রক্রিয়া চলাকালে মার্কিন পক্ষে চালকের আসনে ছিলেন উইলিয়াম জে বার্নস। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তিটি সই হয়।

দি আটলান্টিকে ২০১৩ সালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে উইলিয়াম জে বার্নসকে উল্লেখ করা হয়েছিল ‘‌মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে কণ্টকিত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নিয়োজিত গোপন কূটনৈতিক অস্ত্র’ হিসেবে।

কূটনৈতিক জীবনের স্মৃতিচারণ করে ‘‌ দ্য ব্যাক চ্যানেল : আ মেমোয়ার্স অব আমেরিকান ডিপ্লোমেসি অ্যান্ড দ্য কেস ফর ইটস রিনিউয়াল ’ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন। সে বই সম্পর্কে মতামত দিতে গিয়ে হিলারি ক্লিনটন উল্লেখ করেছেন ‘‌ বিল বার্নস হলেন মার্কিন কূটনীতির এক বহুমূল্য সম্পদ’।

উইলিয়াম জে বার্নসই সিআইএর ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগ পাওয়া প্রথম ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট। গোপন কূটনৈতিক তৎপরতার জন্য পরিচিত এ কূটনীতিকই এখন বিদেশের মাটিতে মার্কিন গোয়েন্দা তৎপরতার প্রধান চালক। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী, তার অধীনে সিআইএর কার্যক্রমেও মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকারগুলোই বেশি প্রাধান্য পাওয়ার কথা।

দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের অনানুষ্ঠানিক কূটনৈতিক তৎপরতা বেড়েছে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তারা দুজনই এখন অন্যতম কুশীলব। দ্য ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতে শ্রীলংকায় এক গোপন সফরে গিয়েছিলেন বিল বার্নস। শ্রীলংকার সংকটের সময় তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে গভীর ভূমিকা রাখেন।

আর সর্বশেষ কিছুদিন আগে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে জেক সুলিভানের আলোচনা হয়। সে সময় অজিত দোভাল তার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পাশাপাশি ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলো নিয়েও আলোচনা করেন বলে বিভিন্ন অসমর্থিত সূত্রের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ওঠে এসেছে।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!