আতাউর রহমান খসরু। ০১ অক্টোবর, ২০২৩ খ্রি.।
সুপ্রাচীনকাল থেকে পৃথিবীতে জাদুবিদ্যার চর্চা হয়ে আসছে। তবে মানব ইতিহাসে জাদুবিদ্যা কখনো সভ্যতা-সংস্কৃতির মূলধারার সঙ্গে যুক্ত হতে পারেনি। জাদু মানুষের ভেতর আশা ও আস্থার পরিবর্তে ভয়ই বেশি সৃষ্টি করেছে।
শরিয়তে জাদুবিদ্যার চর্চা নিষিদ্ধ। ইসলাম জাদুচর্চাকারীদের জন্য ইহকাল ও পরকালে কঠোর শাস্তি ঘোষণা করেছে।
ইসলামের দৃষ্টিতে জাদুবিদ্যার উৎস
কোরআন ও হাদিসের ভাষ্য মতে, জাদুবিদ্যার মূল উৎস শয়তান ও মন্দ জিন। তারাই মানব সমাজে জাদুবিদ্যার প্রসার ঘটিয়েছিল। জাদুকরদের সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আরো এই যে কতিপয় মানুষ কতক জিনের শরণাপন্ন হতো, ফলে তারা জিনদের অহংকার বাড়িয়ে দিত। ’ (সুরা : জিন, আয়াত : ৬)
আয়েশা (রা.) বলেন, লোকজন নবী (সা.)-কে জ্যোতিষদের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করল (যারা তৎকালীন যুগে জাদুও চর্চা করত)। তিনি বললেন, তারা মূলত কিছুই নয়। তারা জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রাসুল! কখনো কখনো তারা তো এমন কিছু কথাও বলে ফেলে, যা সত্য হয়। এতে নবী (সা.) বললেন, এসব কথা সত্য।
জিনরা এসব কথা প্রথম শোনে, (মনে রেখে) পরে এদের দোসরদের কানে মুরগির মতো করকর ধ্বনিতে নিক্ষেপ করে দেয়। এরপর এসব জ্যোতিষী সামান্য সত্যের সঙ্গে শত মিথ্যার মিশ্রণ ঘটায়। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৫৬১)
জাদুর সঙ্গে সুলাইমান (আ.)-এর সম্পৃক্ততা
আল্লাহ তাআলা সুলাইমান (আ.)-কে অনুগ্রহস্বরূপ বিশেষ কিছু ক্ষমতা দান করেছিলেন। যেমন—পশুপাখির কথা বোঝা, বাতাসে ভাসমান সিংহাসন, জিনদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি। ফলে কিছু মানুষের ধারণা সুলাইমান (আ.) জাদু জানতেন।
প্রকৃতপক্ষে এগুলো ছিল তাঁর মুজিজা বা অলৌকিকত্ব। তিনি জাদুচর্চা করতেন না। তবে তাঁর সময়ে সমাজে জাদুচর্চা বেড়ে যাওয়ায় আল্লাহ পরীক্ষাস্বরূপ দুজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন। যারা জাদুর ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করত।
আল্লাহ বলেন, ‘এবং সুলাইমানের রাজত্বে শয়তানরা যা আবৃত্তি করত তারা তা অনুসরণ করত। সুলাইমান কুফরি করেনি, কিন্তু শয়তানরাই কুফরি করেছিল। তারা মানুষকে জাদু শিক্ষা দিত এবং যা বাবেল শহরে হারুত ও মারুত ফেরেশতাদ্বয়ের ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল। তারা কাউকে শিক্ষা দিত না এই কথা না বলে যে, আমরা পরীক্ষাস্বরূপ; সুতরাং তুমি কুফরি কোরো না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১০২)
জাদুচর্চার বিধান
গবেষক আলেমরা একমত যে জাদু শেখা, শেখানো এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রাখা হারাম। আল্লামা ইবনে কুদামা (রহ.) লেখেন, নিশ্চয়ই জাদু শেখা এবং তা শেখানো হারাম। এই বিষয়ে আলেমদের কোনো মতভিন্নতা নেই। (আল মুগনি : ১০/১০৬)
ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক ও ইমাম আহমদ (রহ.)-সহ বেশির ভাগ ইমামের মতে জাদুবিদ্যা চর্চা করা কুফরি। তাঁরা নিম্নোক্ত আয়াত দ্বারা দলিল পেশ করেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘সুলাইমান কুফরি করেনি, কিন্তু শয়তানগুলো কুফরি করেছে। তারা মানুষকে জাদু শিক্ষা দিয়েছে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১০২)
জাদু নিষিদ্ধ কেন
কোরআন ও হাদিসে জাদুর ভয়াবহতা নানাভাবে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন :
১. জাদু ধ্বংসাত্মক : রাসুলুল্লাহ (সা.) জাদু থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, তোমরা ধ্বংসাত্মক বিষয় পরিহার করো। তা হলো, আল্লাহর সঙ্গে শিরিক ও জাদু। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৭৬৪)।
২. জাদু কুফরি : মহানবী (সা.) জাদুকরের কাছে যাওয়া ও তার কথা সত্যায়ন করাকে কুফরি বলেছেন। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি কোনো (জাদুকর) জ্যোতিষীর কাছে গেল এবং তার কথা সত্যায়ন করল, সে মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি অবতীর্ণ বিষয়গুলো অস্বীকার করল। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৬৩৯)।
৩. জাদু মন্দ কাজে উদ্বুদ্ধ করে : জাদুবিদ্যা অর্জন করলে তা মানুষকে মন্দ কাজে উদ্বুদ্ধ করে। যেমন পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, তাদের (হারুত-মারুত) উভয়ের কাছ থেকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যা বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে তা শিক্ষা করত, অথচ আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া তারা কারো কোনো ক্ষতিসাধন করতে পারত না। তারা যা শিক্ষা করত তা তাদের ক্ষতিসাধন করত এবং কোনো উপকারে আসত না; আর তারা নিশ্চিতভাবে জানত যে ব্যক্তি তা ক্রয় করে পরকালে তার কোনো অংশ নেই। তা কত নিকৃষ্ট যার বিনিময়ে তারা স্বীয় আত্মাকে বিক্রি করেছে, যদি তারা জানত! (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১০২)।
৪. জাদু দণ্ডনীয় অপরাধ : ইসলামের দৃষ্টিতে জাদু দণ্ডনীয় অপরাধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জাদুকরের শাস্তি হলো তরবারির আঘাতে মৃত্যুদণ্ড। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১৪৬০)।
ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, জাদু যদি কুফরির পর্যায়ভুক্ত হয় তবে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আর কুফরির চেয়ে নিম্নতর হলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে না। (সুনানে তিরমিজি)।
৫. জাদু আমল নষ্ট করে : জাদুর সঙ্গে সম্পৃক্ত আমল নিষ্ফল করে দেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি গণকের কাছে যাবে তার ৪০ দিনের আমল গ্রহণ করা হয় না। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২২৩০)।
জাদুর পরিণতি
জাদু প্রকৃতপক্ষে অন্তঃসারশূন্য একটি বিষয়। যার প্রভাব সাময়িক। জাদু ও জাদুকরদের ব্যর্থতা অপরিহার্য। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা যা করেছে তা তো কেবল জাদুকরের কৌশল। জাদুকর যেখানেই আসুক সফল হবে না।’ (সুরা : ত্বহা, আয়াত : ৬৯)।
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘মুসরা বলল, তোমরা যা এনেছ তা জাদু, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে অসার করে দেবেন। আল্লাহ অবশ্যই অশান্তি সৃষ্টিকারীদের কাজ সার্থক করেন না।’ (সুরা : ইউনুস, আয়াত : ৮১)।
জাদু থেকে বাঁচার উপায়
রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে জাদু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। তখন তিনি আল্লাহর কাছে বারবার দোয়া করতেন। দোয়ার বরকতে আল্লাহ তাঁকে জাদুর প্রভাব থেকে মুক্ত করেন। হাদিসে এসেছে, একটি কূপ থেকে একটি সুতা বের করা হয়, যাতে ১১টি গিঁট ছিল। জিবরাঈল (আ.) সুরা নাস ও ফালাকের ১১টি আয়াত তিলাওয়াত করেন এবং ১১টি গিঁট খোলেন। ফলে তিনি জাদুমুক্ত হন। (সহিহ বুখারি ও নাসায়ি)।
আল্লাহ সবাইকে জাদুচর্চা থেকে দূরে রাখুন এবং জাদুকরের ক্ষতি থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
Leave a Reply