মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনুল কারিমে ইরশাদ করেছেন- ‘তিলকার রুসুলু ফাদ্দালনা বাদাহুম আলা বাদিন’ অর্থাৎ আল্লাহপাকের বার্তাবাহক রাসুলগণের অবস্থা এমন যে, তিনি তাদের কাউকে কারও ওপরে মর্যাদা দান করেছেন।
নবুয়ত ও রিসালতের পতাকা বহনকারী সেই বহরের বিশেষায়িত ও মর্যাদাপ্রাপ্ত নবী-রসুলগণের অন্যতম একজন হলেন হজরত ইউসুফ (আ.); যিনি পরম স্রষ্টা প্রদত্ত অশেষ গুণ ও বৈশিষ্ট্যকে স্বীয় জীবন ও কর্মে ধারণ ও বাস্তবায়ন করে মানব ইতিহাসে সুখ্যাতি লাভ করেছেন।
কোরআনুল কারিমে তার চারিত্রিক-মাধুর্যের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। তাঁকে নানাভাবে প্রলোভনের ফাঁদে ফেলার অপচেষ্টা হয়েছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাবানদের একজন তৎকালীন আজিজে মিশরের স্ত্রী জোলায়খা তার সৌন্দর্য, মমত্ববোধ, ভালোবাসা, সম্পদ আর ক্ষমতার সম্ভাব্য সকল উপকরণের অপব্যবহার করেও হজরত ইউসুফের উন্নত নৈতিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মাঝে কোনোরূপ নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হননি; কৌশল, ফন্দি আর মস্তিস্কপ্রসূত বুদ্ধিমত্তার সামগ্রিক নির্যাস ঢেলে দিয়েও তার কুমতলব চরিতার্থকরণে কোনো কাজেই আসেনি।
সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রসুল হজরত মোহাম্মদ (সা.) বাদে পৃথিবীর সর্বোত্তম সৌন্দর্যমণ্ডিত মানবকুলের মাঝে হজরত ইউসুফের (আ.) স্থান সর্বাগ্রে; ঈর্ষণীয় সৌন্দর্যের সমস্ত উপকরণ তার মাঝে নিহিত ছিল।
সমকালীন নারীকুল রূপকথার মতোই তার সৌন্দর্যের মোহনীয় বয়ান শুনেছিল এবং তার প্রতি সকলের মাত্রাতিরিক্ত আবেগ ও অনুভূতির মায়াজাল বিস্তৃত হয়ে পড়েছিল।
কিন্তু উচ্চবিত্ত জোলায়খার প্রভাব-বলয় ও ক্ষমতার চৌহদ্দির কারণে হজরত ইউসুফের (আ.) সৌন্দর্যের আলোকচ্ছটা অন্যদের দৃষ্টিসীমার বাইরেই থেকে যেত। প্রাসাদ জীবনের জৌলুস ও ভোগ-বিলাসের উন্মত্ততা মতলববাজ জোলায়খাকে হজরত ইউসুফের (আ.) কল্পনাতীত সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্বের প্রতি মোহাবিষ্ট করে তুলেছিল।
তার সর্বক্ষণিক প্রচেষ্টাই ছিল কী করে ইউসুফকে (আ.) পটানো যাবে, নিজের প্রতি আকৃষ্ট করতে পারবে এবং তার হৃদয় গহিনে সুপ্ত বাসনা চরিতার্থ করতে সক্ষম হবে। রাজপরিবারের সীমাহীন আয়েশ ও অফুরান বিলাসিতা এক মুহূর্তের জন্যও হজরত ইউসুফকে (আ.) বিভ্রান্ত করতে পারেনি।
নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার সাজানো প্রাসাদ- যা ছিল জোলায়খার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণাধীন, সেখানেও সততার মূর্তপ্রতীক ও চারিত্রিক দৃঢ়চেতা ইউসুফকে (আ.) কোনোমতেই টলানো যায়নি; হাজারো অপচেষ্টার ইন্দ্রজালে ক্ষণিকের তরেও বিন্দুমাত্র আটকা পড়েনি তাঁর পরীক্ষিত নৈতিকতাবোধ।
বরং ‘বুদ্ধি কম ছলনা বেশি’ সেই জোলায়খাকেই পরাস্ত হতে হয়েছিল প্রতিশ্রুতিবদ্ধ মহান পয়গম্বরের উন্নত চরিত্রের কারিশমার কাছে; তাই আজকের সমাজেও নৈতিকতার সেই অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী হজরত ইউসুফ (আ.) আমাদের কাছে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।
বিশেষ করে অতিসাম্প্রতিক আমাদের দেশে চরিত্র ও নৈতিকতার স্খলনের যে চরম পর্যায় আমরা অতিক্রম করছি তার অবসানে উম্মতে মুসলিমাহকে দৃষ্টান্তমূলক অতীত ঐতিহ্যসমূহ স্মরণ ও বরণপূর্বক ইতিবাচকতা ও সামগ্রিক উত্তরণের স্বার্থে কাজে লাগানো অত্যাবশ্যক বলে মনে করি।
মুসলিম উম্মাহর অনুকরণীয় আদর্শ ও সমগ্র বিশ্বের জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য করুণার মূর্তপ্রতীক হিসেবে প্রেরিত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হলেন হজরত মোহাম্মদ (সা.); যাঁর বরকতমণ্ডিত ও কীর্তিময় জীবন ইতিহাসেও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অনবদ্য প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে।
আরবের সবচেয়ে সুন্দরী-সুশ্রী নারীর সংসর্গ ও কল্পনাতীত ভোগ-বিলাসের প্রস্তাবও তাঁকে ক্ষণিকের তরেও মোহাবিষ্ট এমনকি স্পর্শও করতে পারেনি। আর সেজন্য তিনিই আমাদের অনুসরণীয় আদর্শ- ‘লাকাদ কানা লাকুম ফি রাসুলিল্লাহি উসওয়াতুন হাসানা’ অর্থাৎ তোমাদের জন্য রসুলের জীবনের ভেতরেই রয়েছে মহত্তম জীবনাদর্শ।
তাই মুসলিম অধ্যুষিত এই জনপদে কোনো কন্যা, স্ত্রী বা মা যে কোনো পর্যায়ে লাঞ্ছিত হবে বা সম্মান হারাবে- আখেরি নবীর উম্মতের দাবিদার কারও পক্ষে তা কল্পনাও করা যায় না।
মানবের আত্মার সংশোধনও হতে হবে মানবাত্মার গভীর থেকেই; আর এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় নির্দেশনা, ঐতিহ্য, প্রণোদনা, কঠোর বার্তা ও নৈতিকতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ অনুশাসনই মুখ্য নিয়ামক হতে পারে।
আমরা যাঁদের গৌরবময় ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছি, তাদের মাঝেও যৌবনের অস্তিত্ব ছিল কিন্তু উন্মাদনা ছিল না, কামনা-বাসনাকে চরিতার্থ করতে গিয়ে তারা কখনোই অনৈতিকতার আশ্রয় গ্রহণ করেননি; আজ আমরা যদি তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণের কথা বলি তবে শুধু মুখের কথায় নয় বরং আমাদের প্রাত্যহিক কাজেই তা প্রমাণ করতে হবে।

সম্প্রতি উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যাওয়া অমানবিক এসব ঘটনার অবসানে আমরা যদি ঐতিহ্য-সচেতন হই এবং গৌরবের উপরোক্ত স্বর্ণোজ্জ্বল অতীতকে নব্য জাহিলিয়াতের তিমিরে আলোকবর্তিকা হিসেবে গ্রহণ করি, তবেই আমাদের সমাজকে সব শ্রেণির মানুষের জন্য বসবাসের আরও উপযোগী ও নিরাপদ করে গড়ে তুলতে সক্ষম হবো।

চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়